সরিতা আহমেদ:
কাল রাতে বাবার মুখে সে প্রথম এই শব্দবন্ধটা শুনেছে।
”টোটাল ফেলিওর। এটাকে নিয়ে আমার সারা জীবনটা আনলাকি হয়ে গেল। ফুল অফ কার্স!” – গলার ঝাঁঝালো স্বরে একরাশ বিরক্তি মেশানো ঘেন্না আর মায়ের পালটা যুক্তির তুমুল চেঁচামেচিতে শব্দটা শিখে নিতে সময় লাগেনি তার।
এবাড়ির প্রায় দিনের চেঁচামেচির কেন্দ্রবিন্দু যে সবসময় সে-ই হয়, তা নয়; মাঝে মাঝে চিরুনি, গামছা, হাঁড়ির কালি, উঠানে শ্যাওলা, জলে আয়রন, খাবারে নুন, পায়েসে চিনি অথবা চিতি পড়া গেঞ্জির বমি ওঠা গন্ধ নিয়েও অশান্তি হয়।
এরই মাঝে মাঝে, কখন কে জানে, সে লাইম লাইটে এসে পড়ে। এই যেমন কালকের ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট দেখে একপ্রস্থ হলো। তখনই ওই বিশেষণটি তার গায়ে লাগলো। মা অবশ্য এর আগে বাংলায় একই শব্দ বলেছিলেন চায়ের কাপ ভেঙেছিল বলে – ‘জীবনের শনি গ্রহ’!
ভূগোল বইয়ের ছবিতে শনি গ্রহ দেখতে কিন্তু দারুণ লাগে তার। অমন চাকা পরিবেষ্টিত দ্বিতীয় কোনও গ্রহ নেই। সৌরজগতের হিরোর মত চেহারা শনি গ্রহের। কিন্তু তার নামের সাথে যখন ‘শনি’ যুক্ত হয়, সেটা খুব একটা হিরোইক সাউণ্ড করে না।
একবার সাহস করে মানেটা জিজ্ঞেস করেছিল সে। রুটি মাখা হাত নিমেষে থামিয়ে কটমট চোখে জবাব মিলেছিল “কাল… কাল… কাল বুঝিস? সব অশান্তির মূল কারণ। শনির কুদৃষ্টি থাকলে যা হয়।”
বোঝা-না বোঝার মাঝামাঝি সে মাথা নেড়ে তখনকার মতো পালিয়ে বেঁচেছিল ঠিকই, কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, সে ঘুলঘুলিতে আশ্রিত চড়ুই দূটোর চেয়েও অবাঞ্ছিত।
দুধ খাওয়ার ঝকমারি থেকে বাঁচতে সে প্রায়শই পাশের বাড়ির খুশবুদের খাটের তলায় লুকিয়ে থাকে। কিন্তু অফিস ফেরত বাবার বেল্টের দাগ যেদিন হাতে-পিঠে পার্মানেন্ট ট্যাটু বানিয়ে দিল, সেদিন থেকে ছবিটা অন্যরকম হয়ে গেল। না হয়ে উপায় ছিল না, “পাপ বিদায় কর” – এর মতো আরেকটা শব্দ নইলে নামের সাথে জুড়ে যেত।
‘পাপ হয়’ জাতীয় শব্দ সে এতোদিন শুনেছিল, কিন্তু সেটা বিদায় কিভাবে করা যায় সেটা আবছা বোঝা গেল মা যেদিন হাসপাতাল থেকে ‘খালাস করে’ ফিরলেন। সেদিনই সে প্রথম দেখলো বাবা মায়ের কাঁধে হাত দিয়ে ধরে ধরে আনছে। দৃশ্যটা খুব অচেনা, তবু ভীষণ ভালো লেগেছিল তার।
দুর্বল মা-কে বিছানায় শুইয়ে রুমা কাকীমা বারবার বলছিলেন “তিন সপ্তাহের ভ্রূণ! ধকল তো কম গেল না। এই ক’দিন বাপের বাড়িতে থাকলেই ভালো করতে গো।”
কাজের লোক মালতী মাসি ঠক করে দুধের গ্লাস টেবিলে রেখে বলেছিল, “খেয়ে নিও বৌদি।”
জেদ করে মায়ের পাশে শুলেও অনেক রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
– “এখন আবার ন্যাকা কান্নার কী হলো! দু’দুটো মেয়ে পোষার টাকা আমার নেই, বাপের বাড়ি থেকে যখন নিয়ে আসবে, তখন পয়দা করো। তদ্দিন ওসব পাপ খালাস করাই ভালো।” – বাবার ভারী গলা শুনে বিছানার এক কোনায় আড়ষ্ট হয়ে সরে গিয়েছিল সে। মা আর কাঁদেনি।
তারপর যে দশটা দিন মা বিছানায় ছিলেন, সে ক’দিন বাড়িটায় চেঁচামেচি ছিল না। ঝগড়া অশান্তিগুলো যে হতো না তা নয়, স্বরগুলো চাপা হয়ে গিয়েছিল, এই যা।
গভীর রাতে সে যখন পা টিপে টিপে বাথরুম যেতো, তখন রান্নাঘরের ভেতর থেকে আরেক রকম ফিসফিসানি, বাবার গলার ঘড়ঘড়ানি আর চাপা হাসির খুশখুশে শব্দ ভেসে আসতো। আর কী আশ্চর্য্য! যেদিন যেদিন এই অদ্ভূতুড়ে শব্দের হুল্লোড় পাওয়া যেত, তারপরের সকালটায় মুখরা মালতী মাসির মেজাজ ফুরফুরে থাকতো। সারাদিন পানের ডিবে সাজিয়ে গাঢ় করে কাজল-আলতায় সেজে থাকতো মাসি। বিকেলবেলায় কঠিন এলজেব্রাগুলো সল্ভ করতে করতে সে অবাক চোখে দেখতো, বাবার অফিস ছুটিও যেন তাড়াতাড়ি হতো সেসব দিনে।
অনেক পরে, বড়বেলায় যখন সে মা-কে কথাগুলো বলার সাহস পেয়েছিল, তখন উত্তর মিলেছিল “সবই আমার পাপী কপাল। এসব ঢ্যামনামি দেখবো বলেই বেঁচে আছি এখনও!” ফোঁড়নের তেলে পেঁয়াজের কুচির ঝাঁজ নাকি অন্যকিছু, সে জানে না, মা চোখ ঢেকে নেন হলুদ মাখা আঁচলে। তার মাধ্যমিক কানে বাজতে থাকলো “ঢ্যামনামি..”
আরেকটা নতুন শব্দ আনলাকি স্যাটারডে’স চাইল্ড-এর বড়বেলায় যুক্ত হলো। নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে তার পড়ার টেবিলের গোপন নোটবুকে শব্দটা টুকে রাখলো সে।
নিষিদ্ধের তালিকায় ৪২তম শব্দ।