সম্পর্কগুলোর যত্ন প্রয়োজন

রামিছা পারভীন প্রধান:

আজকাল সর্ম্পকগুলো একটু মলিন হয়ে গেছে। এগুলোকে যত্ন করা খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক, ভাই-বোনের সম্পর্ক, আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক। সব সম্পর্ক রক্ষা করাই আজকাল কঠিন হয়ে পড়েছে। সম্পর্ক তৈরি করার চেয়ে সম্পর্ক সুন্দরভাবে টিকিয়ে রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার ঢাকা শহরে পর পর দুটো জোড়া খুন হয়েছিল। কাকরাইলের নিজেদের বাড়িতে গত বুধবার রাতে খুন হন ধনাঢ্য পরিবারের গৃহিণী ও তাঁর ইংরেজি মাধ্যম পড়ুয়া ছেলে। এর কয়েক ঘণ্টা পরই গত বৃহস্পতিবার সকালে বাড্ডার ঘিঞ্জি একটি বাড়ির এক কামরার সংসারে গাড়িচালক বাবা আর তাঁর তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ের লাশ পাওয়া যায়। পর পর এই দুই খুনের প্রভাব আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে।

আর এটা থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে তা জানার জন্য প্রথম আলোর ফেসবুকের পক্ষ থেকে মন্তব্য করতে বলা হয়েছিল। তাতে যে বিষয়গুলো আমাদেরকে নাড়া দিয়েছে তা হলো-

১. হতাশা
২. পারিবারিক বন্ধন
৩. নৈতিকতার অভাব
৪. কর্মব্যস্ততা
৫. ইগো প্রবলেম
৬. পারিবারিক মুল্যবোধের অভাব
৭. সামাজিক শিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষা
৮. পরকীয়া
৯. মানবিক গুণাবলির অভাব
১০. আইনের সঠিক ব্যবহারের অভাব ও আইনের সংস্কার
১১. সম্পত্তির লোভ লালসা
১২. সংসারে অর্থনৈতিক অভাব
১৩. যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার

এই উপরোক্ত বিষয়গুলোর কারণে সমাজে আজ চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। তাইতো আজ পারিবারিক সংকট থেকে রক্তপাত। এই বিষয়গুলো থেকে আমাদের আগে বের হয়ে আসতে হবে। তবেই সর্ম্পকগুলো বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। আমরা এতই কর্মব্যস্ত থাকি যে কাছের মানুষের খোজঁখবর নিতে ভুলে যাই।

অন্যের কথা আর কী বলবো, নিজের কথাই যদি বলি, সারাদিন অফিস করার পর ছেলের কোচিং, হোম ওয়ার্ক শেষ করার পর যখন ভাবি মায়ের সাথে শান্তি করে দুদণ্ড কথা বলবো, তখন ঘড়িতে বাজে এগারোটা। তখন মনে হয় মা তো এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আর কথা বলা হয় না। কেমন জানি আমরা যান্ত্রিক ও আবেগহীন হয়ে পড়েছি। সময়ের খাঁচায় বন্দি হয়েছি। এ খাঁচা ভাঙতে হবে আমাদের।

সবচেয়ে যে বিষয়টি উঠে এসেছে, তাহলো পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা সবার মধ্যকার ইগোটাকে কমিয়ে আনতে হবে। সবার সাথে সবার যোগাযোগ রাখতে হবে, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াতে হবে, খোঁজ খবর রাখতে হবে। আর্থিক সমস্যা একটা বড় সমস্যা। আর্থিক ও সম্পত্তির অভাবে যেমন সংসারে অশান্তি হয়, আবার আর্থিক ও সম্পত্তির লোভ লালসায় অন্ধ হয়ে মানুষ একে অপরকে রক্তাক্ত করে।

পারিবারিক শিক্ষা ও নৈতিকতার বিষয়টি খুব জোর দেওয়া হয়েছে। বার বার বলা হয়েছে পরিবারের কথা। যে সামাজিক অবক্ষয় শুরু হয়েছে তা ঘর থেকে শুরু করতে হবে। একটি সুন্দর পরিবারে গড়ে উঠে শিশুর মানসিক বিকাশ, মানবিক গুণাবলী ও নীতি নৈতিকতা। আর পরিবারই হলো শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখান থেকে সে প্রতিনিয়ত শিখবে। আর একক পরিবারে যাদের মাধ্যমে শিশুরা মানবিক গুণাবলীতে বিকশিত হবে সেই বাবা-মাকে হতে হবে নির্মল। তারা যদি নিজেরাই অন্ধকারে বাস করে, তাহলে ছেলেমেয়েদের আলোর পথ দেখাবে কী করে! সত্যি আমরা নিজেরাই অন্ধকারে ডুবে আছি । তাই বাবা-মায়ের সম্পর্ক ভালো রাখা খুব জরুরি।

আর একটি বিষয় হলো পরকীয়া। একটি সম্পর্ক থাকাকালীন যখন আর একটি সম্পর্কে কেউ নিজেকে জড়ায় তখন সে চরম হীন মনমানসিকতার পরিচয় দেয়। আসলে বিবেকহীন চরিত্রহীন মানুষেরাই এ ধরনের কাজ করে। আর তখনই সংসারে ভাঙ্গনের সুর বেজে উঠে। আমাদের দেশে আইনের সুশাসন নেই। অপরাধকারীদের দ্রুত বিচার করে যথাযথ শাস্তি প্রদান করা হয় না। ফলে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমে গেছে। তা না হলে বখাটের অত্যাচারে জয়শ্রীরা আত্মহত্যা করতো না। এই বিষয়গুলোকে যথাযথ গুরুত্ব দিলে হয়তো আমরা পারিবারিক সংকট থেকে কিছুটা উত্তরণের পথ খুঁজে পাবো।

যাই হোক একটি সুন্দর পরিবারই দিতে পারে আর একটি সুস্হ ও সুন্দর পরিবেশ। আগে আমাদের পরিবারের মধ্যকার সম্পর্কগুলোকে যত্ন করি। একে অপরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। এ জীবন তো একটাই। তাই নিজেদেরকে সংশোধন করে এই পৃথিবীকে আরও সুন্দর ও বাসযোগ্য করে যেতে হবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.