শারীরিক গঠন, রঙ, সৌন্দর্য এবং আমাদের মাথাব্যথা

নাসিব নিতু:

আমি ছোট থেকেই মোটা। কেন এমন মোটা সেই ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা নেই। আমার কাছে এটা কোনো ব্যাপার না। তো মোটা হবার কারণে ছোট থেকে এখন পর্যন্ত অনেক মন্তব্য আমার শুনতে হয়েছে, হচ্ছে। কোন দোকানের চাল খাই, রিক্সাওয়ালা আমাকে নিয়ে চলতে পারবে না ইত্যাদি কমন কিছু ইতর বাক্য।

কোনকালেই কেন যেন এসব আমার উপর প্রভাব ফেলেনি। গঠনগত দিক থেকে আমি হয়তো একটু আলাদা ছিলাম। কিন্তু আমি আর দশজনের মতোই নিজেকে খুব কনফিডেন্ট ভাবতাম। নাচ করেছি, গান করেছি, নাটক করেছি। সবার সাথে মিশতে পেরেছি খুব সহজে। এটা আমার কথা। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেক মেয়েই আছে এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে।

আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন আমার কেমিস্ট্রির টিচার আমাকে বলেছিলেন” নিতু, তুমি মোটা দেখে আমি ভাবতাম তুমি বোকা, কিন্তু তোমার মাথা অনেক পরিস্কার”। এখানেও আমাকে প্রথম মেজার করা হলো আমার শারীরিক গঠন দিয়ে। এমনটা কিন্তু হরহামেশা আমাদের মত ডিস্প্রোপরশনেট (সর্বসাধারণের চোখে) মেয়েদের ক্ষেত্রে ঘটে।

হ্যাঁ, আমি অন্য সবার চেয়ে আলাদা, আমি মোটা, তো? আমার ভেতরের সৌন্দর্য উপলব্ধি করার মতো চোখ তোমাদের নেই। আর ছোট থেকে যাদের ধারণা ছিলো আমি মোটা হবার কারণে কিছুই করতে পারবো না, এখন আমি তাদের চেয়ে বেশি সফল। আমি কখনো আমার পেছনে কে কী বললো তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি, ঘামাই না।

আমি কী পরবো, কী খাবো, কীভাবে চলবো, সেটা ঠিক করে দেওয়ার তোমরা কারা? এখনো এমন হয়, কোথাও গেলাম, গায়ে পরে অনেকে আসে উপদেশ দিতে অমুক ডাক্তার, তমুক ডাইটেশিয়ান, ওই বিউটিশিয়ানের কাছে যান। আপনি তিন মাসে অন্যরকম হয়ে যাবেন”।

আরে ভাই আমার তো দরকার নাই অন্যরকম হওয়ার। আমি তো আমাকে নিয়ে বিব্রত না। তোমাদের এতো মাথা ব্যাথা কেন বাবা? বিয়ের পর হাজবেন্ডের অনেক বন্ধুদের সমবেদনা দেখেছি ওর জন্য। ভাবখানা এমন আমাকে আমার হাজবেন্ডের কোলে করে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তারপর শুরু হলো মোটা মেয়েদের তো বাচ্চা হয় না এই মর্মে জ্ঞানদান। এই ক্ষেত্রে নারীকূল পুরুষকুলের চেয়ে দুধাপ এগিয়ে।
বলা বাহুল্য এরা কতজন আমার সত্যিকারের শুভাকাঙ্খি ছিলেন, তা আমি জানি না। সে ধাপ পার করার পর শুরু হলো আমার এনার্জি কতটুকু তা নিয়ে বিশ্লেষণ। সংসার, জব, বাচ্চার দায়িত্ব মোটামুটি আমি একাই সামলে চলি। আমার এনার্জি কতটুকু তা নিশ্চয় পরিমেয়?

এবার আসি রঙ এর কথায়। আমাদের সমাজে গায়ের রঙ কালো নিয়ে জন্মানোর বিড়ম্বনা নিয়ে নতুন করে কথা বলার কিছু নেই। আমার এক বন্ধু আছে ওর গায়ের রঙ কালো। এ নিয়ে ওকে নিজ পরিবারসহ অনেকের গঞ্জনা শুনতে হয়েছে। পুরুষ কুলের জন্য অবশ্য সব মাফ। তাদের জন্য প্রবাদ রেডি আছে, “সোনার আংটি বাঁকাও ভালো”। সেই কালো মেয়েটার বাবা-মা ছোটকালে মারা যায়। সংগ্রাম করেই সে এমএ পাস করে। এখন সে সফল একজন ব্যবসায়ী। তার চেয়েও বড় কথা, ওর মধ্যে যে মানবিকতা বোধ আমি দেখেছি, অনেক সো-কলড সুন্দর মানুষের সেই মানবিকতা থাকে না।

আমার আরেক বন্ধু, সেও ছিলো অনেক কালো, কিন্তু সে এখন একজন নামকরা ডাক্তার। ওদেরকে কখনো নিজেকে নিয়ে আক্ষেপ করতে দেখিনি।
রঙ, গঠন এইসব নিয়ে পুরুষরা যতটা উদ্বিগ্ন তার চেয়ে অন্য মেয়েরাই বেশি উদ্বিগ্ন। একটা মেয়েকে পুরুষ টেনে নামায় একবার, দুবার, তিনবার। কিন্তু মেয়েরাই মেয়েদের অপদস্থ করে বারবার। এ কেমন আচার সমাজের?

অমুকের বাড়ির বৌ খুব সুন্দর। কেন? তার গায়ের রঙ ফর্সা। কিন্তু নিজের ঘরের বৌটি সর্বগুণসম্পন্না একজন মেয়ে, যার কোন মূল্যায়ন নেই। এই পার্থক্যটা গড়ে দেয় প্রথমে নারীরাই। পরবর্তিতে তা চর্চিত হতে থাকে পুরুষতান্ত্রিকতায়। আমাদের অস্থি ,মজ্জায় শারিরীক সৌন্দর্য এমন করে গেঁথে গেছে, যে নারী মানেই রূপের আধার। আমাদের নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন সবখানেই শারিরীয় সৌন্দর্যের জয় জয়কার। আর অসুন্দর মেয়েরা গুমরে মরে আঁধার কোণে।
এতোদিন পর এসে এই কথাগুলো বলার কারণ এই না যে, আমি এগুলো নিয়ে বদার করছি। উইমেন চ্যাপ্টার এখন অনেক মেয়েই পড়েন, তাদের মধ্যে হয়তো কেউ আছে যাকে এসব শুনতে হয়, আর প্রতিনিয়ত গুটিয়ে নিতে হয়, হেরে যেতে হয়। তাদের জন্যই বলা।

পাছে লোকে কিছু বলে এ নিয়ে বসে থাকলে আজীবন শুনেই যেতে হবে। হেরে যেতে যেতে একবার সাহস করে যদি নিজের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যকে আমরা উপলব্ধি করি,তাহলে হয়তো মানুষের বলার মুখটা বন্ধ হবে একসময়। তার চেয়েও বড় কথা তুমি মেয়ে কার চেয়েই কোন অংশে কম নও। এই বোধটা তোমাদের মধ্যে জাগে না কেন? কেন শামুকের মতো গুটিয়ে যাও। শামুক গুটিয়ে গিয়ে কি মানুষের পদাঘাত থেকে রেহাই পায়? বরং খোলস সহ গুঁড়িয়ে যায়।

আজকে তুমি যাদের কথায় নিজেকে হেয় মনে করে গুটিয়ে যাচ্ছ, তারা কিন্তু তোমার হেরে যাওয়ার দায় নেবে না। কিন্তু তুমি যদি নিজেকে উপলব্ধি করতে পার, নিজের সত্ত্বাকে সম্মান দাও এরাই তোমার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করবে।
এমন অনেক উদাহরণ আছে যারা শারীরিক সৌন্দর্যের তথাকথিত বেড়াজাল উপেক্ষা করে নিজেকে পৃথিবীর সামনে প্রকাশিত করেছেন। তাদের আলোয় অনেকেই আলোকিত এখন। তবে তুমি কেন গুটিয়ে থাকবে? আলোতে আসো। আপন আলোয় মেলে ধরো নিজেকে। সুন্দরের পুজারী আর পিপাসার্তদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দাও “আমিও পারি”।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.