“শ্বশুর” থেকে “বাবা” বা “ছেলের বউ” থেকে “মেয়ে” হওয়ার গল্প

তাসনুভা চৌধুরী:

লুডু খেলার আগে-

সারাজীবন ‘বাংলা ব্যাকরণ’ আর ‘বাংলা ব্যাকরণ-এর শিক্ষক’ খুবই ভয় পেতাম। Mediocre ছাত্রী হওয়ায় এই দু’য়ের কোনটিই আমার সাথে খুব বেশী যেতো না। অমির সাথে পরিচয়-এর পর জানতে পারলাম, ওর বাবা বাংলার শিক্ষক। শুধু তাই না, উনি আমাদের বাংলা প্রথম পত্রের বইয়ের লেখক এবং সংকলক, আবার বাংলা দ্বিতীয় পত্রে আমি উনার লেখা বই পড়ে ফেলেছি!

উনার সাথে দেখা করাতে অমি নিয়ে গেলো বাংলা একাডেমী, তাও উনার বই প্রকাশিত হয়েছে (যা উনার জন্য প্রতিদিনের ব্যাপার) বই মেলার এমন দিনে! প্রথম দেখায় উনি আমাকে বলেছিলেন, আমি আর অমি যেন চা-নাস্তা করে যাই, ভয়-এ পেটের ভেতর দুপুরে খাওয়া ভাত চাল হয়ে যাবার জোগাড়, আর চা নাস্তা! চলে আসলাম বিদায় জানিয়ে। এরপর উনাকে যতবার দেখেছি (বিয়ের পরেও কিছুদিন) শুধু মনে হয়েছে-

ডোরা কাটা পাঞ্জাবি, কাঁধেতে ঝোলা,
রাশভারী শ্বশুর আমার, নন আলাভোলা!
চশমার ফাঁকেতে কড়া চোখে তাকান,
খুব যদি হাসি পায়, মুখখানি বাঁকান!

লুডু খেলার পরে:

বউ হয়ে শ্বশুরবাড়ি “অন্তরা”তে গেলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কিছু সময় আমার ওখানে কেটেছে! আমি একদম অন্য পৃথিবী থেকে আর এক পৃথিবীতে গেলাম, যেখানে মানুষগুলোকে যত ভালোবাসা যায়, তাও কম!
আমার শাশুড়ি আমাকে আগলে রাখতেন, শ্বশুরকে তখনো ভয় পেতাম! কিন্তু আমিও চৌধুরী বাড়ির “Real Chowdhury” (আমার আব্বা বলেছেন!)! জানতে পারলাম এই বাড়ির সবাই লুডু খেলায় ভয়ানক, মাহির আর আমার শ্বশুরকে হারানো অসম্ভব ব্যাপার! ঠিক করলাম লুডু খেলা খেলবো এবং উনাকে হারাবোই! এতো অহংকার লুডু খেলা দিয়েই করতে হবে খর্ব!

আমি আর আমার শাশুড়ি (উনি কিন্তু একদম প্রথম থেকেই আমার চোখে আম্মু, তাঁর গল্প আর একদিন!) এক দল, আর আমার শ্বশুর এবং অমি একদল!! রাত-দিন এক করে খালি খেলা আর খেলা! খেলার টেবিলে খুবই গলা শোনা যেতো আমার আর আমার শ্বশুরের।
আম্মু বেচারি মাঝে মাঝে ভুলে যেতো উনি খেলায় কোন দল! দান দেয়ার আগে সবার জন্যই দোয়া করে ফেলছেন! এমন দয়ালু Partner নিয়ে খেলা কি জেতা যায়! নাহ ১০ টা খেলাতে আমি আর আম্মু জিতি ২-৩ টা তে!! ব্যস আব্বু ক্ষ্যাপানো শুরু করলো।

একদিন সারাদিন হারার পর, উনার ক্ষ্যাপানোতে অস্থির হয়ে আমি কাঁদো কাঁদো অবস্থায় ঘোষণা দিলাম, “এরকম করলে আপনাদের বাসায় আর আসবোই না”, বলে রাগ করে ভিতরে চলে গেলাম, যথারীতি আমার দয়ালু partner বুঝিয়ে নিয়ে আসলেন! আবার খেলা শুরু! এই ভদ্রলোকের বিপরীতে জেতা হয়ে গেলো কঠিন! খেলাতে জিততে না পারলেও এই ফাঁকে চৌধুরী ঠিকই নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেই ফেললো! আমি শ্বশুরের মন জিতে নিলাম! আর উনি কখন জানি হয়ে গেলেন আব্বু!
দিন গেলো, ভয়ও গেলো, অধিকার পেয়ে,
বন্ধুত্ব হয়ে গেলো লুডু খেলা দিয়ে!!

দিন গেলো কত! আব্বুর সাথে অনেক যুক্তিতর্ক করেছি, রাগ করেছি, অভিমান করেছি! আবার সব বলেও দিয়েছি! উনি যে আমাকে ভালবাসেন তা আমি বুঝতে পারি। উনিও বুঝেন আমি জানি। আব্বু-আম্মু এই দেশে বেড়াতে আসার পর এমন হয়েছে যে, আব্বু ঘুমাতে না গিয়ে বরং আমার সাথে নানা বিষয় নিয়ে যুক্তিতর্কে মেতেছেন! উনার নাকি আমি রাগ করলে মজা লাগে!

ওই মুখ বাঁকিয়ে অল্প হাসা মানুষটা আমার সাথে তর্ক করতে করতে প্রাণ ভরে উচ্চ স্বরে হাসতেন। আমি রেগে গেলে আরও হাসতেন! এমন মানুষের সাথে রাগ করা যায়? আমাদের বাবা মেয়ের গল্প/ তর্ক-বিতর্ক চলতো! উনার চোখে আমি আমার জন্য দেখেছি অনেক স্নেহ আর মমতা। তা শুধু এবং শুধুই বাবার চোখে মেয়ের জন্যই থাকে। আজকে আব্বু, Dr. Mahbubul Haque-এর জন্মদিন।

উনি দেশের গর্ব, আমাদেরও গর্ব। আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি এমন একজন মানুষ আমাকে তাঁর ছেলের বউ নয়, মেয়ের স্থান দিয়েছেন। জন্মদিন খুবই আনন্দের দিন, এমন আনন্দ আপনার সারাজীবন ভরে থাকুক আব্বু।

শুভ জন্মদিন
আপনার স্নেহধন্য মেয়ে নুভা।
৩ নভেম্বর, ২০১৭।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.