মনীষা বিশ্বাস:
২০১৭ শেষ হতে চললো, কিন্তু মৃত্যু আর আত্মহত্যার মিছিল চলছেই। প্রতিটি ঘটনার পরে আমরা হা-হুতাশ করি, ক্ষোভ আর শোক প্রকাশ করি, কোনোটার বিচার শুরু হয়, কিন্তু শেষ হয় না, কোনটার বিচার শেষেও রায় কার্যকর হয় না, আর শেষপর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা এক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবেই থেকে যায়।
কিন্তু এমন ঘটনাগুলো আমাদের সকলের সম্মিলিত ব্যর্থতার খাতায় একটি নতুন ব্যর্থতা যুক্ত করে। আমাদের এতো উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, নারীর ক্ষমতায়ন, সমানাধিকারের সাফল্য গাথাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদের সকলের এতোদিনের সম্মিলিত অর্জন থমকে দাঁড়ায় বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর মেলে না কেবল ঘটে যাওয়া ঘটনার সংখ্যা বেড়ে চলে।
আজ আমি সাতক্ষীরার জয়শ্রীর কথা বলছি। আপনারা কেউ কেউ হয়তো পড়েছেন ওর কথা পত্রিকার পাতায়, কেউবা জেনেছেন ফেসবুকের কল্যাণে। যারা জানেন না, তাদের জন্য ঘটনার কথাটা একটু জানিয়ে দিতে চাই আবার।
মাত্র সতের বছর বয়সে জয়শ্রী আত্মহত্যা করছে! কারণ, কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ুয়া এই ময়েটেি বখাটদেরে আচরণের প্রতিবাদ করার পরে পাল্টা আক্রমণের অপমান সহ্য করতে পারেনি। পরিবারের মানুষজনের কাছ থেকে বা সমাজের কাছ থেকে তো সহজ সমাধান দুটো – হয় পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়া এবং বিয়ে দিয়ে দেয়া।
জয়শ্রীর মা কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থার নানারকম উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে জড়িত। তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। তিন মেয়ে আর এক ছেলের মধ্যে জয়শ্রী ছলি সবচেয়ে ছোট মেয়ে, অভাবের সংসারে বড় দুই মেয়েকে পড়াতে না পারলেও জয়শ্রীকে পড়াতে চেয়েছিলেন সুদিনের আশায়। জয়শ্রীরও আশা ছিল, পড়াশুনা শেষে চাকরি করবে –নিজে স্বাবলম্বী হবে, আর পরিবারে স্বচ্ছলতা আনবে।
ঘটনার দিনও প্রতিদিনের মতো জয়শ্রী কলেজে যায়। এরপরে কলেজ থেকে ফেরার পথে বড়কুপট গ্রামের রঞ্জন মণ্ডলের ছেলে শেখর মণ্ডল তার গতিরোধ করে প্রেমের প্রস্তাব দেয় এবং জয়শ্রী তা প্রত্যাখ্যান করে। শেখর এরপর তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। জয়শ্রীর চিৎকারে আশেপাশের লোকজন ছুটে এলে বখাটে শেখর পালিয়ে যায়। জয়শ্রী বাড়ি ফিরে আসে, কিন্তু পরিবারের কাউকে নিজের কষ্টের কথা জানাতে পারে না। না বললেও নিজের অপমানের জ্বালা সহ্য করতে পারেনি জয়শ্রী। তার ফলাফল রাতে সকলের অজান্তে গলায় রশি দিয়ে জয়শ্রীর আত্মহত্যা।
এ ঘটনায় স্থানীয় থানায় মামলা করা হয়েছে, কিন্তু ইতোমধ্যে বখাটে শেখর পালিয়ে গেছে। এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ও জয়শ্রীর পরিবার অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আশা করছেন, এলাকায় মানব বন্ধন করে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে যথাযথ উদ্যোগ নেবার আবেদন করা হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান বখাটের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাসও দিয়েছেন।
হয়তো শেখর ধরা পড়বে, বিচার হবে, শাস্তিও হবে – কিন্তু জয়শ্রী কিন্তু আর কখনো ফিরে আসবে না! আর এমন কোন নিশ্চয়তাও পাওয়া যাবে না যে, এটাই হবে এমন শেষ ঘটনা!
আমরা কি সত্যি ভেবে দেখেছি কেন আমরা মেয়েরা নিজেদের জীবনটাকে এতো তুচ্ছ করে ফেলি, মরে যাওয়ার আগেই কেন মৃত্যুকে কামনা করি? কারণ আমরা ধর্ম, সংস্কৃতি আর সমাজের দোহাই দিয়ে কেবলই ‘নিখাদ সতী’ ‘নিপাট লক্ষ্মী’ মেয়ে হতে চাই। সবসময় নিজে চাই তা হয়তো নয়, কিন্তু পরিবার, বন্ধু, সমাজ সবাই দাবি করে আর এমনভাবে চাপিয়ে দেয় যে এর অন্যথা আমরা ভাবতেই পারি না, মানতেই পারি না।
আমি চাই আমাদের ঘরে ঘরে মেয়েগুলো সব ‘অলক্ষ্মী’ হয়ে উঠুক, আত্মহত্যা করার বদলে কষে দু’ঘা লাগিয়ে দিক আর উড়িয়ে দিক এসব ঠুনকো অপমানগুলোকে, কিন্তু বেঁচে থাকুক আর লড়ে যাক নিজের স্বপ্ন নিয়ে। আমাদের জয়শ্রীরা জয় করে নিতে শিখুক সব বাধাকে, পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে আর ঘুরে দাঁড়াতে শিখুক নিজেকে নিয়ে, এমনকি আর কেউ পাশে না দাঁড়ালেও!
লেখক: মনীষা বিশ্বাস, বিশ্বব্যাপী প্রভাবক নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপক, অক্সফ্যাম বাংলাদেশ