মাতৃত্বও যখন অন্যতম ক্যারিয়ার

রুমানা রশিদ রুমি:

শুধুই মা হতে পারাটা সহজ কিছু নয় । মাকে হতে হয় ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব শেষ করে, চারপাশের মানুষের নানান মিঠা কথা আর তেতো কথা শুনে, নিত্যদিনের নানা প্রতিবন্ধকতাকে পার করে প্রাণের সন্তানকে বুক দিয়ে আগলে রাখা অনেক বড় আর গুরু দায়িত্ব। তাই শুধু মা হওয়াটাও একটা ক্যারিয়ার।
আমার স্কুল জীবনের শেষ দিনটায় ফেয়ারওয়েলের দিনে আমি সব শিক্ষকের কাছে খাতা নিয়ে তাদের স্বাক্ষর নিচ্ছিলাম। সাহেরা বেগম নামে আমাদের গার্হস্থ্য অর্থনীতির শিক্ষিকা আমার খাতায় গোটা গোটা করে লিখে দিলেন, দোয়া করি বড় হয়ে খুব ভালো মা হও। তখন তো আমার মনে মনে বড় হয়ে ডাক্তার হবার শখ। একটা লাল রঙের গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে যাবো। খুব রাগ হয়েছিল ম্যাডামের লেখাটা পড়ে।

যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসনে পড়ি সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক লুৎফুল হক স্যার বলতেন, একজন মায়ের তাঁর সন্তানকে সময় দেয়াটা অনেক জরুরি। বিদেশে এ জন্য বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়। যাতে মা তাঁর সন্তানকে লালন পালনে বেশি মনোযোগী হতে পারেন।

আমার ছয় মাসের ছোট্ট ছেলেটাকে বাসায় রেখে তখন স্যারের ক্লাসে আমি। স্যার বললেন, তুমি চলে যাও, তোমার ছেলেটাকে গিয়ে সময় দাও। আজ ক্লাসে তেমন কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে না। আমার মন খারাপ হতো , ভাবতাম আর ক্যারিয়ার হলো না। যখন এমবিএ করতাম, রিসার্চ্ অ্যানালাইসিস এর এক শিক্ষক বলতেন, তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও তাঁর স্ত্রী উভয়ই নিজেদের কর্মক্ষেত্র নিজে এতো ব্যস্ত থাকতো যে, তাদের সন্তানটি অবশেষে মাদকাসক্ততে আক্রান্ত হয়ে গেছে। মায়ের ভূমিকা যে নেহাৎ কম নয় তিনি বারবার কথার মাঝে বুঝিয়ে দিতেন।

তাই অফিসে ক্যারিয়ার আর মা হয়ে ক্যারিয়ার এই দুয়ের মাঝে দোদুল্যমান সময়টাতে শুধু মা হয়ে ক্যারিয়ার করার সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুব সহজ কিছু নয়। আজকাল বিজ্ঞাপনে দেখি এক স্থপতি মা বলছেন, মা হ্ওয়ার কোনো ডিগ্রি তো আমার নেই, আমি কি আমার সোনাকে ঠিকমতো যত্ন নিতে পারছি?
আবার অন্য বিজ্ঞাপনে আছে আমার সন্তানের ঠিকমতো যত্ন না নিতে না পারলে আবিরের মায়ের সাথে চোখে চোখ মেলাবো কী করে ?

বিষয় এইটাই যে, শুধু মা হ্ওয়া যে একটা ক্যারিয়ার হ্ওয়া উচিত, পড়াশোনা করা উচিত শিশুর বেড়ে ওঠা নিয়ে, আর তা কাজে লাগানো উচিত সন্তান লালন পালনে, তা নিয়ে কেউ ভাবছে না। এটাকে কেউ হিসাবের মধ্যেই আনছে না। মেয়েরা সন্তান জন্মের পর একটু একটু করে শিখছে মা হওয়া। কিন্তু এটা দীর্ঘদিনের একটা শিক্ষণীয় বিষয় হওয়া উচিত।
এখন দিন বদলেছে, অর্থনৈতিক জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে নারীবাদ মায়ের অংশগ্রহণকে cost benefit analysis হিসেবে দেখতে চায়। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হতে চাওয়া নারীকে যারা স্বাধীনচেতা স্বেচ্ছাচারিনী, এমনকি উত্তরাধিকারের রক্তশুদ্ধির প্রশ্নে জর্জরিত করে পরাধীনতার শেকলে বাধঁতে চেয়েছে, তাদের মুখে ছাই দিয়ে 3R ফর্মুলা এনেছে নারীবাদীরা।

তার প্রথমটি Reorganization দেয়া, যাতে বলা হয়েছে যে নারী ২৪ ঘন্টার ১৮ ঘন্টা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। বাকি ৬ ঘন্টা তার ঘুমের সময় । কিন্তু এই ৬ঘন্টাও অবসরের অংশ নয়। তিনি তার এই শ্রমঘন্টা গৃহব্যবস্থাপনায় ব্যয় করেন। মজার বিষয় হলো, নারীর এই গৃহ ব্যবস্থাপনার সহায়তায় পুরুষের কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা প্রমাণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। সে বিশ্রাম নেয়, মানসিক তৃপ্তি পায়।

সর্বোপরি, জীবিকা অর্জনের যে মূল তাগিদ তার সংসার, সন্তানকে নিয়ে পরিপূর্ণ নিরাপদ জীবন–যাপনের যে অন্তহীন যুদ্ধ সে প্রতিনিয়ত চালাচ্ছে, তার মূল আশায় সে নারীকেই চেতন-অবচেতনে বেছে নিয়েছে। সে অর্থে পুরুষের আয়ের একাংশে নারীর অংশগ্রহণ আছে। যা ব্যাপক অর্থে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নারীর অংশগ্রহণ বলে মনে করেন তারা।
এজন্য দ্বিতীয়ত Reduce শব্দকে ব্যাখা দেন এই হিসেবে যে পুরুষ ৮-১০ শ্রমঘন্টা এবং ৬ঘন্টা ঘুম দেয়ার পরও ৬-৮ ঘন্টা অবসর যাপনের সুযোগ পান। যে সময়টা নারীর গৃহস্থালীর কাজে সাহায্য করতে পারেন। এবং Redistribution এ এসে বলছেন, নারী-পুরুষের যৌথ প্রয়াসে বা সমবন্টনের মধ্য দিয়ে আদি প্রতিষ্ঠান পরিবারটিকে টিকে রাখবে। আর পরিবারকে কেন্দ্র করে সচল থাকা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে নারীর অবদানকে যুক্ত করা হবে একভাবে নারী-পুরুষের সমঝোতা ও সহযোগিতাকে কেন্দ্র করে।

সুতরাং বিষয়টা তো পরিষ্কার, সংসার পরিচালনার জন্য মায়ের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে মায়ের সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়ার মন মানসিকতাকে শক্ত জায়গায় দাঁড় করাতে পারলে একজন শুধু মা হতে পারাটা্ও একটা ক্যারিয়ারে পরিণত হতে পারে ।

ভেবে দেখো তো কাঁচা আমের আঠাতে ছোট্ট মেয়েটার মুখে লাল দাগ হয়ে যাওয়াতে তুমি আনন্দে হেসে উঠলে, আর মেয়ের নাকে নাক ঘষে কাঁচা আমের মধুর রসে রঙিন করি মুখ বলতে থাকলে। কবি জসীমউদ্দিনের এই কথাটায় এতোদিন শুধু কবিতায় পড়েছো, মা হয়ে জীবনেই না হয় তা লেপ্টে নিলে।

কিংবা সুফিয়া কামালের–খুশিতে বিষম খেয়ে আরো উল্লাস বাড়ায়েছি মনে মায়ের বকুনি খেয়ে। মা মেয়ের এই আনন্দের মুহূর্তগুলো জীবনে মা হয়ে ক্যারিয়ার করাটা ছাড়া আর কিসে হতে পারে?
ভয় পেয়েছ; ভাবছ, এলেম কোথা?
আমি বলছি, ‘ভয় পেয়ো না মা গো,
ঐ দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।’

– রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা পড়াতে গিয়ে আপনার গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, কিন্তু জানো কি ওই কবিতাটি মায়ের কাছে রপ্ত করায় তোমার ছোট্ট ছেলেটি মনে মনে কত বেশী আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠলো। সে যেন নিশ্চিত ভবিষ্যত খুঁজে পেল তার জীবনে, তার লক্ষ্য সে সেদিনই অর্জন করে ফেলেছে যে তাঁর মাকে তাকে নিরাপদে রাখতে হবে। এ শিক্ষাটি অন্য কোনো শিক্ষকের কাছে পাওয়া সম্ভব হবে না , যতটা না মা দিতে পারে।
কিংবা নিশ্চিন্তপুরের বাঁকে বাঁকে অপু ও খুকির বেড়ে ওঠার গল্প একসাথে শোনার পরিবেশ তৈরি করে তুমি মা অবচেতন মনে চারপাশের এই স্বার্থপর সময়ে ভাই-বোনের মধ্যে যে পরম মমতার ছোঁয়া মেলে দিলে, তা হয়তো কোনো কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা চেয়ারে বসে দেয়ার চেয়েও কঠিন হবে।

তাই মনের টানাপোড়েন দূর করে ক্যারিয়ারের পাশাপাশি শুধু মা হিসেবে নিজেকে গড়ার মানসিক প্রস্তুতিটা নিয়ে ফেল। অকারণ সন্তান লালন পালনে আমার জীবনে কিছু হলো না, এই সংসার না থাকলে জীবনে এই হতো, সেই হতো সেসব বলে সোনার হরিণের পেছনে অন্তহীন ছুটে চলা থেকে বিরত হও।

একদম ভাববে না একজন মা হতে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নেই। একজন মা হওয়ার জন্যই সবচেয়ে বেশি উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন। তোমার কথায়, চলায়, আচরণকে তোমার সন্তান অনুকরণ করে। তাকে যে পরিবেশ দিবে পরবর্তী সময়ে তার ব্যক্তি জীবন, শিক্ষা জীবন, সংসার জীবন এমনকি কর্মজীবনে্ও এর প্রভাব পড়বে। সে প্রশংসিত হতে পারে, সমালোচিত হতে পারে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে সে বার বার মা, মায়ের শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরতে চাইবে। সুতরাং আজ তুমি মা। তোমার আদর্শ তোমার সন্তানের চলার পথের পাথেয়, কখনো ভেবে দেখেছ কি?

অনেক মা আছেন, যারা দক্ষতার সাথে চাকরির পেশাদারিত্বের সাথে সাথে মা হিসেবে দায়িত্বটিও সুনিপূণভাবে পালন করছেন। সেক্ষেত্রে তাদের কর্মদক্ষতা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে কেউ যে শুধু মা তাই সন্তানের স্কুলের সামনে বসে টিভি সিরিয়ালের গল্প করবেন, গয়না, শাড়ির আলাপ পাড়বেন, কিংবা শাশুড়ি ননদকে কীভাবে জব্দ করেছেন তা বলে টিপ্পনি কাটবেন, তা নয়। নিজ কর্মের জায়গাটিকে শ্রদ্ধার বিবেচনা করে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
মা হওয়াটা এক অন্যরকম ক্যারিয়ার আর এটা অনেক সম্মানের আর অনেক বড় দায়িত্বেরও বটে।

শেয়ার করুন: