নারীদের জেগে উঠায় ওদের ভয়

রেন্টিনা চাকমা:

“প্রয়োজনে আইন মানে না”- কথাটির স্পষ্টতা সম্পর্কে অনেকেই অবগত। কীরকম সত্যতা বহন করে চলেছে এই কথাটি তা সখিনা, বিউটিদের সাথে কথা বলে নিজের কাছে আরও বেশি করে উপলব্ধির বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। শুধু সখিনা, বিউটি কেন? তাদের মতো বহু নাম না জানা নারীর জীবনের গল্প আমরা অহরহ দেখতে পাই এখনো।

প্রতিদিন কর্মস্থলে যাবার সময় শাক সবজি নিয়ে বসে থাকা বিউটি নামের মহিলাকে দেখতে আমি অভ্যস্ত।এমনকি যখন ফিরি তখনও।তো একদিন নজরে আসে সখিনা নামের মহিলাটিকেও।সখিনা কিন্তু সবজি বিক্রেতা নয়, সে ঢালাইয়ের কাজের সাথে জড়িত।

অদ্ভুত ব্যাপার, অনেকদিন আগে থেকে বিউটিকে দেখেও আমার কখনো মনে প্রশ্ন জাগেনি, প্রশ্নের ডালপালার জন্ম হলো সখিনাকে দেখে! মনে প্রশ্ন জাগে, নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ে। কর্ম আর পোশাক আলাদা করে দিয়েছে নারী আর পুরুষকে, এমনকি চিন্তা ভাবনাগুলোও আলাদা নারী পুরুষের, এমনটাই ভেবে বসেন সমাজের অনেকেই। কারণ, প্রায়ই বলতে শোনা যায় বা চেহারাতে তারা বুঝিয়ে দেয় – “তুমি মেয়ে বলেই এমনটা ভাবছো”। অথচ তারা এটা বুঝিয়ে দেয়ার যোগ্যতা রাখে না যে -“সত্যি বলেই তো এমন ভাবছে”!

প্রায় ৪০ বছর বয়সি বিউটি তার জীবন সঙ্গীর সাথে সবজি ব্যাবসায় জড়িত দুই বছর ধরে। এক মেয়ে, দুই ছেলেকে নিয়ে সখিনার সংসার জীবন। হিসাব নিকাশ, কথা বলা, সবকিছু মিলিয়ে সবজি বিক্রির কাজটি সামলিয়ে যাচ্ছে সে খুব দক্ষতার সাথে।

যখন প্রশ্ন করেছি, কত বছর ধরে এ কাজের সাথে জড়িত, বিউটি চোখে দ্বিধা নিয়ে একটু হকচকিয়ে বলে, “আপা আমি এই কাজ করতাম না, ঘরেই কাজ করতাম”। দ্বিধার কারণ হিসেবে ঘেঁটে দেখলাম, সখিনা আমার বাচনভঙ্গিকে ভিন্নভাবে নিয়েছে। ভেবেছে, সমাজ ও নারীর মঙ্গল হবে এমন কিছু তৈরি করা আইনকে সে লঙ্ঘন করেছে। তাঁর দ্বিধাকে মুছে দিতে আমি বললাম- এটা খুব ভালো যে নিজে পরিশ্রম করছেন, উপার্জন করছেন আত্মসম্মানবোধের সাথে। কারো ক্ষতি করছেন না। তৎক্ষণাৎ বিউটির প্রতি উত্তর- “জী আপা, আমি তো কাউরে ক্ষতি করতেসি না, নিজে কর্ম করে খাইতেসি”। বিউটির চোখে-মুখে তৃপ্তি মাখা প্রাণবন্ত আত্মবিশ্বাসী হাসি!

সখিনার গল্পটিও আমার কাছে নিতান্তই ছোটো। ইট,বালু,সিমেন্টের সাথে জড়িত সে ১০ বছর ধরে। শুধু ঢালাই নয়, ইট মাথায় করে নেয়া, বালু টানা সব কাজই করে সখিনা। একটি দলের সাথে জড়িত থেকে সে কাজটি করে যাচ্ছে। এই দলে তাঁর জীবনসঙ্গীও অন্তর্ভুক্ত।

প্রশ্ন রেখেছিলাম, এই কাজ নিয়ে তাঁর শ্বশুরবাড়ির মতামত কী? সখিনা বলে, বাসা ভাড়া ৩৫০০ টাকা, খাওয়া, ছেলেমেয়ের খরচ এগুলা কি তারা সামলাইতে পারে? হেল্লাইগা কিছু কইতে পারে না। তারা আরও খুশি হয় টাকা ইনকাম হইলে। দিনে কত টাকা আয় হয় এই প্রশ্ন করতেই তাঁর চোখে দেখলাম, তাঁর আত্মসম্মানবোধের জায়গাতে আঘাত করেছি আমি। তারপরও সে উত্তর দেয়- ৩০০/৩৫০ টাকা।

আত্মসম্মানবোধের বিষয়টা এই কারণে বলা- সখিনার সাথে কাজ করছে সঞ্জীব নামে একটা ছেলে। পেশায় মিস্ত্রী, ভালো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কত টাকা পান? সে জবাব দেয়, ৬৫০ টাকা। মিস্ত্রী বলেই সঞ্জীব পায় ৬৫০ টাকা। সঞ্জীব বাদে অন্য যে ছেলেরা কাজ করছে তারা পায় ৩৫০ টাকা। সঞ্জীব এটাও জানিয়ে দিতে ভুল করে না যে নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে ৫০ টাকা কম পায় সবসময়। কারণ হিসেবে সঞ্জীব বলে, মেয়েরা কি পুরুষদের মত কাজ করতে পারে?

আমার চোখ সখিনার চেহারার অস্বস্তির ছাপ এড়িয়ে যায় না! আমি সখিনাকে স্বাভাবিক করতে বলি- আপা, প্রয়োজনে কি আইন মানে? সমাজে আমরা যারা মেয়েরা কাজ করে খাই, আমাদের অনেক প্রশ্ন/কথা শুনতে হয়। তুমি এই কাজ করো, ওই কাজ করো? কেন করো? ছি!ছি! মেয়ে মানুষ হয়ে এই কাজ করো? কিন্তু আপনি সেই ধাপ অতিক্রম করেছেন! মানুষ যখন অভাবে ক্ষুধা নিয়ে থাকে, তখন যারা ছি!ছি! করছে, তারা কি কেউ এই কষ্টের টাকাটা হাতে তুলে দেয়? কেউ দেয় না। আপনি আত্মসম্মানবোধের সাথে কাজ করে যান, এতে লজ্জার কিছু নেই। দেখবেন এমন একদিন আসবে যেদিন আপনাকে আর দ্বিধা নিয়ে কারো প্রশ্নের উত্তরে ৩০০/৩৫০ টাকা বলতে হবে না। তখন শুধু বলবেন ৩৫০ টাকা!

এই হলো সখিনা, বিউটিদের কর্মজীবনের সংগ্রামী ছোট্ট গল্প। শুধু সখিনা, বিউটি কেন? চারুকলা বা শাহবাগ এরিয়া বা ধরুন অন্য কোনো নাম না জানা এক এরিয়া, যেখানে আমরা সখিনা, বিউটিদের মতো বহু মেয়ের ব্যস্ত কর্মজীবনের মুহূর্তগুলি দেখতে পাই।
এই ছোট্ট গল্পগুলি তুলে ধরার কারণটাও নিজের কাছে অদ্ভুত মনে হয়।

কয়েকদিন আগে ফেসবুকে কেউ একজন শেয়ার করেছিল একটি ভিডিও। যেটি ছিল “হজরত শায়েখ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ” নামে এক ব্যক্তির। ভিডিওটি দেখে আমি মর্মাহত হই বটে! ভিডিওটির কয়েকটি কথা আমাকে উল্লেখ করতেই হচ্ছে:

১। নারীর জন্ম হয় সেবার জন্য, ২। নারী হলো বাড়ির সম্পদ (জিনিসের মতো),৩। স্ত্রীকে স্বামী বিক্রি করতে পারে, স্বামী নির্যাতন চালালেও স্ত্রী চলে যেতে পারবে না, ৪। নারী ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে পারবে না, ৫। পুরুষ তুমি কি দেখতে পাও না? তোমার স্ত্রী কেন পটল কিনতে যায় বাজারে অন্য পুরুষের ধাক্কা খেয়ে খেয়ে? পুরুষ তুমি কি মরে গেছো? তুমি মানুষ নাকি গরু? তিনি তাঁর বক্তব্যে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইহুদি ধর্মের কথা উল্লেখ করেছেন, যার সার সংক্ষেপে নারীর জন্মকে “অলক্ষুণে” বানানো হয়েছে।
বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণকারী পরিবারে জন্ম হওয়ায় বলছি, আমি আমার ৩০ বছরেরও বেশি জীবনে কথাগুলি শুনিনি। “অলক্ষুণে” হলে একটি নারী কখনো একটি পুরুষের প্রিয়তমা স্ত্রী হতে পারতো না, একজন পিতামাতার গর্বিত সন্তান হতো না, হতে পারতো না কখনো কারো একজন ভালো বন্ধু কিংবা কখনো একজন পুরুষ হতে পারতো না একজন মানুষ!

যেটা বলছিলাম, নারী তাহলে কি স্বামী মারা গেলে বাইরে বের হতে পারবে? পটল কিনতে যেতে পারবে? অফিস যেতে পারবে? তাহলে উত্তর দেন, যে শুধু একজন মাদ্রাসার শিক্ষক নয়, সাথে মসজিদের ইমামের তকমাও আছে, সে কেন চার বছরের অবুঝ শিশুটিকে ধর্ষণ করলো? কেন রূপার যাত্রা শেষ হলো না? কেন পাহাড়ের সরল মেয়েটিকে গরু চড়াতে/খাবার খুঁজতে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন/মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হলো? কেন বাসের সিট না পেয়ে বোরখা পরা দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির গায়ে অপর প্রান্তের পুরুষটি তার যৌনাঙ্গ বের করে শারীরিক চাহিদা মেটায়? কেন ব্যক্ত করতে না পারা মেয়েটির ছলছল দুটি চোখ দেখতে হয় আমাদের? কেন মেয়েটির করুণ মৃত্যুকে দেখতে/শুনতে হয়?

এখানে বলার কোনো সুযোগ নেই যে তারা কেন বাইরে গেল? কারণ তারা সবাই প্রয়োজনেই বেরিয়েছে। আরও প্রশ্ন জেগেছে নিশ্চয়ই, মেয়েটির পোশাক কি ভালো ছিল? কেন, রূপা তো হাঁটু দেখিয়ে বাসে ছিল না, চার বছরের শিশুটি কি জানে পোশাক কী? কেন পোশাক পরিধান করা হয়? কিংবা পাহাড়ের মেয়েটিরও কি স্তন দেখানো ছিলো? বাসে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিও তো বোরখা পরা ছিলো। তাহলে?

মেয়েদের জন্য আর কত নিয়ম/আইন তৈরি হবে?? এমন আইন কি তৈরি হতে পারে না যে আইনে স্বামী-স্ত্রী হবে একজন আরেকজনের বন্ধু, যেখানে নারী পুরুষের সমান সম্মান থাকবে? অযথা আইনের চেয়ে যথার্থ প্রয়োজনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় কি?
তাইতো সখিনা, বিউটিরা এখন জেগে উঠছে, দেয়াল ভাঙছে। আরো বহু নারী জেগে উঠার প্রহর গুনছে, পণ করছে। কারণ তাঁদের যে জেগে উঠতেই হবে!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.