যাত্রা

নিও হ্যাপি চাকমা:

“তুমি হয় রাজনীতি করবে, নয়তো আমার জীবনে থাকবে, দুটো থেকে একটা তোমাকে বেছে নিতেই হবে” বলে অনুপ দরজা জোরে বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো মিনিট দশেক হবে। জয়া সেই থেকে ট্রমার মধ্যে আছে, বিশ্বাস করতে পারছে না অনুপ তাকে ডিভোর্সের হুমকি দিয়েছে। সেই প্রিয় মানুষটি, যাকে ইউভার্সিটিতে অনেকের মাঝে বেছে নিয়েছে সারাজীবনের পার্টনার হিসেবে। যার হাত ধরে ঘুরেছে শাহবাগ, টিএসসি, সংসদ ভবন…। ফেস্টুন হাতে নিয়ে একসাথে মিছিল মিটিং করেছে, ছাত্র রাজনীতির মাঠেই যার সাথে পরিচয়। পয়লা বৈশাখে লাল হলুদ শাড়ি পরেছে তারই আব্দারে, সেই মানুষটা মুখের উপর বলে দিলো?

পাঁচ বছরের একমাত্র ছেলে আবির এসে হাত ছুঁয়ে বললো, “মা আমি নিচে যাই?” হু, বলে বাচ্চার দিকে তাকালো জয়া, একটা ফুটফুটে বাচ্চা, ডিভার্স হলে এই বাচ্চা কার কাছে থাকবে? হঠাৎ, অজানা আশংকায় সে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, “বাবা আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবি না তো?” মায়ের এমন আচরণে হতচকিত আবির, হাত ঝাঁকিয়ে তাড়া দেয়, “কী হয়েছে তোমার, আমি নিচে যাই?” হু, বলে নিজেকে সামলায় জয়া। এরপর, রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। না কান্না পাচ্ছে না, তার কেমন একটা ঘোর ঘোর লাগছে, মনে হচ্ছে একটু আগে যা ঘটেছে সেটা দুঃস্বপ্ন। হঠাৎ মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো, মায়ের বুকে যাওয়ার ইচ্ছেটা তাকে তাড়িত করছে। এমন সময় শাশুড়ি ডাক দিয়ে বললেন, “বৌমা এককাপ চা দেবে?”
পারবো না এখন, খালাকে বলুন বলে চেঁচিয়ে প্রত্যুত্তর করলো। আর বিড়বিড় করে বললো, আমি তো এই বাসার বুয়া, আপনিই বা কম কিসে।

রাত এগারোটা বাজে, মায়ের কোলে শুয়ে চোখ বুঁজে আছে জয়া। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বলে যাচ্ছেন, দেখো, ওসব রাজনীতি টাজনীতি ইউভার্সিটিতে করেছো ভালো কথা, এখন সংসার হয়েছে, আবির আছে, তার লেখাপড়া, দেখাশুনা, শাশুড়ি অসুস্থ। জামাই তো অতটা খারাপ বলেনি মা, তুমি একটু ভাব, কী হবে ওই রাজনীতি করে, ‌নেতা হ‌বে, হয়‌তো এক‌দিন মন্ত্রী হ‌বে, কিন্তু সংসারই য‌দি না থা‌কে ওস‌বের কী মূল্য ব‌লো?

জয়ার এতোক্ষণে খেয়াল হলো, নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। কীভাবে ছাড়বে রাজনীতি, সবে একটা পথশিশুদের স্কুল করেছে, কী হবে ওই স্কুলের। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোর চোখে ক’মাস আগে স্বপ্ন এঁকেছে, ওসব বাচ্চারা কি তাদের স্বপ্নের হিসাব চাইবে না তার কাছে? দড়াম করে উঠে বললো, “বাসায় ফিরবো, ড্রাইভারকে ফোন করে দাও।”
“কী বলো! থাকবে বললে, এখনো কিছুই খেলে না!” বলে মা অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন।
জয়া এবার বিরক্তি নিয়ে বললো, “কী ড্রাইভারকে কল করবে, নাকি অটো রিকশায় যাবো?”

আজ দু’দিন হয় জয়া বের হয়নি, স্কুলের কল রিসিভ করেনি। রান্না করেছে, তবে খাওয়া বলতে যা বলে তা খায়নি। রুমের মধ্যে দরজা লাগিয়ে নিজের সাথে বোঝাপাড়া করছে। অনুপও এখনো তার সিদ্ধান্তে অটল। একটি সরকারি দপ্তরের প্রধান অনুপ, অধীনস্থ অনেক কর্মচারী তার ইশারায় চলে, অথচ বৌটাকে মানাতে পারছে না, এ ব্যথাও তার কম নয়। এই দু’দিন সে নিজের কাজ নিজে করছে, জয়ার হেল্প নিচ্ছে না। সে দেখাতে চায় জয়া ছাড়া তার দিব্যি চলবে, জয়াও এক দু’বার এগিয়ে আসার পর আর আসেনি।

তৃতীয় দিন, নাস্তার পর্ব মৌনতার মধ্যে শেষ হলে অনুপ অফিসে চলে যায়, আবিরকে ড্রাইভারের সাথে পাঠিয়ে ডাইনিং টেবিলেই বসে থাকে জয়া। ফোনটা ভোঁ ভোঁ করে জানিয়ে দিচ্ছে স্কুলের বাচ্চারা তাকে খুঁজছে। সে থমথমে মুখে ফোনটা অফ করে, জল খাচ্ছে ধীরে ধীরে। যেনো একটা মেডিটেশন, মাথার কলকব্জাগুলোকে আইডিয়া বের করার সুযোগ দেয়া।

“কী হয়েছে মা, আমাকে বলবে?” বলে কাঁধে হাত রাখেন শাশুড়ি। মাথায় আইডিয়া আসার আগেই বিচ্যুতিতে কিছুটা বিরক্ত জয়া বলে ওঠে,”না কিছু না, আপনার ওসবে কোন লেনদেন নেই, যান রুমে গিয়ে রেস্ট নিন। আমি কিছুক্ষণ পর এসে ওষুধটা দিয়ে যাবো”। এরপর উঠে আবার রুমে গিয়ে নিজেকে বন্দি করার চেষ্টা করে। মাথার কলকব্জা হরতাল ডেকেছে মনে হয়, এখন রীতিমতো টনটনানি শুরু হয়ে গেছে।

“দেখি হা করুন” বলে শাশুড়ির মুখের উপর টেবলেট নিয়ে দাঁড়ায় জয়া। শাশুড়ি হা না করে জয়ার হাত ধরে বলে ওঠেন, ” বেশ বড় হয়ে গেছো, আমাকে আর দরকার লাগে না বুঝি? কয়বছর আগে তো তরকারিতে লবণ দিতেও ডাকতে। এখন আর লাগে না তাইনা?” টান দিয়ে পাশে বসিয়ে দেন জয়াকে, এরপর বলেন, “ঝগড়া করেছো? বড় মাপের ঝগড়া, ক’দিনেও থামছে না দেখছি?”

জয়া একটু কেশে প্রস্তুতি নেয় নালিশের, আবার ভাবে মায়ের কথাগুলোই বলবেন এই মহিলাও, অতঃপর চুপ থাকে। শাশুড়ি বলতে থাকেন, “না বললে বুঝবো কী করে, মা না ভাবো, প্রতিবেশী ভেবে হলেও একটু বদনামই করে দাও, আমার ছেলের।” জয়া আস্তে আস্তে মুখ খুলে, বলতে থাকে তার সাধ স্বপ্নের কথা, স্কুলের কথা, রাজনীতি সে কেনো করতে চায় সেই কথা। শাশুড়ি সব শুনে বলে ওঠেন, “টেবলেটটা দাও আর বাবুকে ফোন করে বলো, তুমি ডিভোর্স নিতে প্রস্তুত”।

জয়া মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, এই মহিলা মা নন, তার শাশুড়িও নন, শাশুড়িরা এমন হন না। তবে কে ইনি? এতোগুলো বছর একসাথে থেকে সে চিনতে পারেনি, নিজের উপর একটা অপরাধবোধের ধাক্কা লাগে। আজো তার নোনাজল গড়াচ্ছে, তবে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না, যেভাবে মায়ের রুম থেকে পালিয়ে এসেছে। এমন একটা মজবুত হাত জয়া খুঁজেছে অনুপ থেকে, মা থেকে অথচ সামনে পড়ে ছিলো, সে দেখতে পায়নি। মানুষের দৃষ্টিশক্তি খুব দুর্বল মানুষ চিনতে বারবার ভুল করে।
তার চো‌খের নোনাজল অার বাঁধ মা‌নে না, সমু‌দ্রের ম‌তো উত্তাল হ‌য়ে ও‌ঠে।
অাজ ঝড় উঠ‌বেই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.