ব্রেস্ট আয়রনিং, Disexualisation, এবং হিজাব

সুমিত রায়:

(ফেসবুকে স্তন চ্যাপ্টাকরণ বা ব্রেস্ট আয়রনিং নিয়ে একটা পোস্ট দেখে একটা কমেন্ট করি, সেখান থেকেই এই লেখা। পোস্টের লেখা এরকম ছিল “বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে আফ্রিকায় কিশোরীদের মধ্যে গরম পাথরের ছ্যাঁকায় স্তন চ্যাপ্টাকরণ বেশ উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলছে। এর শিকার হচ্ছে বয়ো:সন্ধিকালের কিশোরীরা। বয়ো:সন্ধিকালে সুঢৌল হয়ে উঠা স্তনের আকার ছোট আর চ্যাপ্টা রাখতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে স্তন চ্যাপ্টাকরণ সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে…”)

ব্রেস্ট আয়রনিং আসলে মেয়েদের উপর এক ধরনের ডিসেক্সুয়ালাইজেশন, ইসলামে যেমন মেয়েদেরকে সেক্সুয়ালি এক্সপোজড হওয়া আটকাতে হিজাব ব্যবহার করা হয়, ক্যামেরুনসহ বিভিন্ন জায়গায় এভাবে ডিসেক্সুয়ালাইজিং করা হয়। মেয়েরা সেক্সুয়ালি এবিউজড হবে এই ভয়ে মায়েরা এটা করে। ক্যামেরুনে মুসলিমদের মধ্যে মাত্র ১০ পারসেন্ট ক্ষেত্রে এটা দেখা যায় যেখানে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে এটা বেশি। এখান থেকেই এর একটা কারণ বের করা যায়। ক্যামেরুনিয়ান মুসলিমদের কাছে ডিসেক্সুয়ালাইজেশনের আরেকটি অলটারনেটিভ আছে, যার নাম হিজাব। তাই তাদের মধ্যে এটা কম হয়।

সম্প্রতি ক্যামেরুনসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্রেস্ট আয়রনিং বৃদ্ধি পাবার বেশ কিছু কারণ আছে। এখানে আগেই বলে রাখা ভালো যে এর সাথে আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ধর্ম, বা অন্য কোন আইডেন্টিফায়ার পাওয়া যায় নি। গ্রামের চেয়ে শহর অঞ্চলে এটা বেশি হচ্ছে। এর কারণও ডিসেক্সুয়ালাইজেশনের সাথে সম্পর্কিত। শহরাঞ্চলেই সেক্সুয়াল এবিউজের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাহলে বলা যায় এটা অনেকটাই সাম্প্রতিক ফেনোমেনা, পূর্বে হলেও বিভিন্ন কারণে এটা এখন বেড়ে গেছে, কারণ এরা এখন বেশি করে মনে করছে যে মেয়েদের সেক্সুয়ালি এবিউজড হবার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। যাই হোক কেন এটা বাড়ছে, বা কেন এদের সেক্সুয়ালি এবিউজের সম্ভাবনা বাড়ছে বলে এরা মনে করছে সেই কথায় আসি।

গত পঞ্চাশ বছর ধরে ক্যামেরুনসহ আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় যথেষ্ট ডায়েটারি ইমপ্রুভমেন্ট বা খাদ্যে ও খাদ্য তালিকায় উন্নতি ঘটে। এটা মেয়েদের পিউবার্টি বা বয়ো:সন্ধিক্ষণের সময়ে প্রভাব ফেলে, তারা আগের চেয়ে আরও পূর্বে বয়ো:সন্ধিতে পৌঁছায়। সার্ভেতে দেখা যায়, ক্যামেরুনের যে সব মেয়েরা ৯ বছর বয়সের মধ্যেই পিউবার্টিতে পৌঁছায় তাদের ৫০ শতাংশের ব্রেস্ট আয়রনিং করা হয়েছে, কিন্তু যখন ১১ বছরের মধ্যে পিউবার্টি হবার বেলায় এই পারসেন্টেজ ৩৮ এ নেমে যায়। সার্ভের রেজাল্ট থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে মেয়েদের পিউবার্টির সময় মেয়ের অভিভাবকদের মধ্যে মেয়ের সেক্সুয়ালি এবিউজড হবার সম্ভাবনার ভয় কতটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

তার উপর আরেকটা ব্যাপার হলো, এখন বাল্যবিবাহও কমে গেছে। ১৯৭৬ সালের পর এখন ক্যামেরুনে মেয়েদের ১৯ বছর বয়সের নিচে বিবাহের সংখ্যা ৫০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে গেছে। মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার ও চাকরি করার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে আর তাড়াতাড়ি বিয়েও করতে চায় না। সুতরাং মেয়েদের বাল্যকাল আর বিবাহের সময়ের মধ্যে একটা বিশাল ব্যবধান তৈরি হচ্ছে, আর এটা মেয়েদের অভিভাবকদের মধ্যেও মেয়েদের সেক্সুয়াল এবিউজের ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর এর ফলে বাড়ছে মেয়েদের এই অমানবিক পদ্ধতিতে ডিসেক্সুয়ালাইজেশন, যার নাম ব্রেস্ট আয়রনিং বা স্তন চ্যাপ্টাকরণ…

তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটা বেড়ে গেলেও আশার কথা হচ্ছে এখন এটা জাতিসংঘসহ অনেকে মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগের কারণে পরিণত হয়েছে, আর সম্প্রতি ক্যামেরুনেও ব্রেস্ট আয়রনিং এর বিরুদ্ধে আইন পাশ করা হয়েছে। তাই আশা করা যাচ্ছে এটা কমে যাবে। তবে এটা বলা যাচ্ছে না যে অভিভাবকদের ভয়ও এর ফলে কমে যাবে। হয়তো ডিসেক্সুয়ালাইজেশনের একটা নতুন অলটারনেটিভ সেখানে তৈরি হবে, যেটা তুলনামূলকভাবে কম অমানবিক হবে। স্থায়ীভাবে এসব বন্ধ করতে হলে সরকারকে সেই পথেই যেতে হবে, যা সেক্সুয়াল এবিউজের সম্ভাবনাকেই কমিয়ে দেবে। কিন্তু এদের সরকার কি সেই পথে যাবে?

যাই হোক, একটা প্রাসঙ্গিক কথা মাথায় আসলো। যে পরিবর্তনটা গত পঞ্চাশ বছরে ক্যামেরুনসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ঘটেছে, একই পরিবর্তন কিন্তু বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশেও খাদ্য ও খাদ্যতালিকায় উন্নতি ঘটেছে, মেয়েদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার বেড়েছে, কর্মজীবী হবার হার বেড়েছে, বাল্যবিবাহ অনেক কমে গেছে, বাল্যকাল ও বিবাহের সময়ের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এগুলোর ফলস্বরূপ ক্যামেরুনের মত আমাদের দেশেও বৃদ্ধি পেয়েছে অভিভাবকদের মনে মেয়েদের সেক্সুয়ালি এবিউজড হবার ভয় ও ডিসেক্সুয়ালাইজেশনের পরিমাণ। তবে ক্যামেরুনের মতো আমাদের দেশের ডিসেক্সুয়ালাইজেশন এতো অমানবিক না, এখানে ব্রেস্ট আয়রনিং করা হয় না, হিজাব-নেকাবেই কাজ চালানো হয়।

তবে এটা ঠিক যে, পূর্বের চেয়ে আমাদের দেশে হিজাব ব্যবহারের পরিমাণ যে বৃদ্ধি পেয়েছে – এরকম দাবির সত্যতা আছে। আর এর কারণেও যেমনটা দাবি করলাম তার একটা বিশাল অবদান যে আছেই সেটাও না মেনে উপায় নেই। তাই অনেকেই যে দাবি করেন, দেশে ইসলামাইজেশন বা এর বৃদ্ধির ফলেই হিজাব পরিধানের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে – এটাকে পুনর্বিবেচনায় আনা উচিৎ। বলছি না যে ইসলামাইজেশনের প্রভাব নেই, কিন্তু এখানে কোনো উপসংহারে জাম্প করার আগে কোন কোন ফ্যাক্টর কতটা ও কিভাবে কন্ট্রিবিউট করছে সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করাটা জরুরি।

কোন জিনিস এর কারণ কী বা কী কী, কতগুলো ফ্যাক্টর, প্যারামিটার কাজ করে, কিভাবে কাজ করে এসব বিশ্লেষণের দরকার আছে। কারণ এর দ্বারাই কিভাবে সমস্যাটার পরিবর্তন সম্ভব তা বের করা যায়। কথায় আছে, prescriptive value of a theory depends on its descriptive accuracy. অর্থাৎ কোন সমস্যার সমাধানের জন্য একটা থিওরি তত বেশি সঠিক হবে যত বেশি এটা সমস্যার কারণটাকে ব্যাখ্যা করবে।

একটা সমাজে বর্ধিষ্ণু ডিসেক্সুয়ালাইজেশনের পদ্ধতির সাথে একটি ধর্মের প্রতীকের মিল পাওয়া যাচ্ছে বলেই এর সেই ধর্মীয় সংস্কৃতির বৃদ্ধিই যে এর প্রধান কারণ হবে এটা এটা আবশ্যিক নয়, ডিসেক্সুয়ালাইজেশনের স্বাধীনভাবেই কিছু আলাদা কারণ থাকতে পারে, দেশে সেক্সুয়াল এবিউজ বৃদ্ধি এবং অভিভাবকদের মধ্যে মেয়ের সেক্সুয়াল এবিউজের ভীতির বিষয়গুলোকে কখনই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সমাধানের কথা বলতে গেলে ক্যামেরুনের বেলায় যা বলেছিলাম, আমাদের বেলাতেও সেটাই প্রযোজ্য। সেক্সুয়াল এবিউজ কমানোর দিকেই আগে নজর দিতে হবে।

* ডিসেক্সুয়ালাইজেশন বলতে সেক্সুয়ালিটি প্রকাশিত হয় এরকম অবস্থাকে হ্রাস করা বোঝায়। এটার কোন পারিভাষিক শব্দ জানি না। এর পারিভাষিক শব্দ নিয়ে কারও মাথায় কোন আইডিয়া আসলে সাজেস্ট করুন।

শেয়ার করুন: