গ্ল্যামার, জ্ঞান, নিউজ অ্যাংকর এবং ক্যারিয়ার

খাদিজাতুল কোবরা:

নব্বই দশকের শেষ দিকে স্যাটেলাইট এর আলো যখন আমার মতো মফস্বলবাসীর কাছে পড়তে শুরু করেছে, তখন থেকেই গ্ল্যামার শব্দ ও এর ব্যবহার সম্পর্কে জানি। এর মধ্যে বিটিভির সাদামাটা আর একঘেয়ে সব জগত থেকে বের হতে শুরু করেছে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়াও।
বছর ঘুরে তখন নতুন নতুন চ্যানেল জায়গা করে নিচ্ছিলো বাসার টেলিভিশনে। দেশ-বিদেশের ঘটনার সংগে যুক্ত থাকতে জনপ্রিয় হতে থাকে চ্যানেলেগুলোর খবর। সাংবাদিকতা পেশার নতুন জগত উন্মুক্ত – রিপোর্টিং, ভিডিওগ্রাফি, এডিটিং, আইটি সব ক্ষেত্রেই কাজের অবারিত সুযোগ।

যার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষঙ্গ যোগ হলো খবর পাঠের ক্ষেত্র। দ্বিতীয়বার আমি খবর পাঠকের সঙ্গে গ্ল্যামার শব্দটি যুক্ত হতে শুনি। ভীষণ ভালোলাগে তাদের শুদ্ধ উচ্চারণ, পরিপাটি বেশ, সুন্দর শাড়ি পরা। একেবারে পুতুলের মতোন যেন, নড়ে না, চড়ে না। একগাদা মেকাপ নিয়ে তারা স্টুডিওতে এসে বসেন, পারতপক্ষে কথা বলেন না। তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে।

২০০৯ সালে শেষ দিকে একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করি আমি। এর আগে বেশ কিছুদিন অনলাইন নিউজ পোর্টাল আর একটি দৈনিক পত্রিকাতেও কাজ করেছি। তবে টেলিভিশনটা একদম আলাদা। এর ভাষা, ছবি, প্রকাশ সবকিছু দিয়েই একটি প্রতিবেদন রূপ পায়।
তখন নিউজ অ্যাংকরদেরও কাছ থেকে দেখা শুরু হয়। মেকআপ নিয়ে বুলেটিন শুরুর দশ-পনেরো মিনিট আগে তারা আসতো নিউজ রুমে। খুব সুন্দর সাজগোজ করা নারী কিংবা পুরুষটি নিউজরুমে আসার পরই সবার চোখ একবার হলেও তাদের দিকে পড়তো। অর্থাৎ আলাদা একটা আকর্ষণ কাজ করতো। সারাদিনের সংবাদ কিংবা দেশ বিদেশের সব ঘটনাবলীর সংগে তারা কতটুকু যুক্ত থাকতো আমি জানি না।

কিন্তু একবার এক প্রেজেন্টার আমার পাশের ডেস্কে বসে কংস্ উচ্চারণ করছে, আমি তার দিকে তাকাতেই জিজ্ঞেস করলাম কংস্ বলছেন কেন, এটার উচ্চারণ তো কংস (সো) উনি বললেন, এটার মানে কি?
২০১০ সালের দিকে দ্বিতীয় বারের মত নিউজভিত্তিক চ্যানেলের আগমন। যার একটিতে আমি কাজ করছি। প্রযুক্তির নতুন নতুন সুবিধা, নতুন চিন্তা আর কিছুটা অভিজ্ঞতায় বেশ অনেক পরিবর্তন হয়েছে গত আট দশ বছর থেকে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় নিউজ সরাসরি সম্প্রচার, ঘটনাস্থল থেকে প্রতিবেদকের সরাসরি যোগাযোগ – তাৎক্ষতিক অনেক কিছুর সঙ্গেই দশকরা থাকতে পারছেন।খবর পাঠকদেরও হতে হয়েছে আরও স্মার্ট। খবরের সঙ্গে থাকা, প্রতিবেদকদের তাৎক্ষণিক প্রশ্ন করা, বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষকদের সঙ্গে আলোচনা – সব মিলিয়ে তারা নিজেদেরে করে তুলেছে আরও দক্ষ। জ্ঞানভিত্তিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পোশাক ও সাজেও পরিবর্তন হয়েছে অনেক।

সাধারণত আমাদের এখনকার যারা নিউজ অ্যাংকর আছেন, তাদের মধ্যে মেয়েদের বয়স ২২ থেকে ৪২, ছেলেরা আরও একটু বেশি হতে পারে, দুই চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া। সবকিছুতে বিশ্বের আধুনিক সব চ্যানেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করলেও এখানে পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। কারণ আমাদের অ্যাংকরদের সঙ্গে এখনো যুক্ত আছে গ্ল্যামার শব্দটি। বিদেশী চ্যানেলে বয়স বাড়লে অভিজ্ঞতার কারণে সাংবাদিকদের নিউজ পড়তে দেখা যায়। একেকজন দীর্ঘ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে তারপর নিউজ পড়েন, সেখানে চেহারা বা গ্ল্যামার কোনো কাজেই আসে না।

এখানে তার উল্টো। বয়স বাড়লে গ্ল্যামার শেষ, তার প্রয়োজন্ও শেষ। বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে এখন পর্যন্ত যারা নিউজ বা প্রোগ্রাম অ্যাংকরিং করছেন তাদের বেশিরভাগই মাঠে সাংবাদিকতা করে এসেছেন। অর্থাৎ তারা তাদের অভিজ্ঞতাকে আরও কাজে লাগানোর সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু যে প্রেজেন্টার দশ বারো বছর, পনেরো বছর খবর পড়লো তার আর কোনো ক্যারিয়ার নাই। কারণ গ্ল্যামার নাই।

এই মানসিকতার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ভিকটিম হন নারী। এই ফারাক আমরাই তৈরি করেছি। তথ্যের বিশ্বের সঙ্গে থাকতে হলে এই গ্ল্যামার ট্যাবু থেকে অচিরেই চ্যানেলগুলোকে বের হয়ে আসতে হবে। যার জন্য তৈরি হতে হবে আমাদেরও। নিউজ অ্যাংকর এখন আর শখ আহ্লাদের পেশা নয়। আমার মনে হয় জ্ঞান বিজ্ঞানে, তথ্যে এগিয়ে থাকা সবচে স্মার্ট ব্যক্তিটিই সবচে ভালো অ্যাংকর হয়ে গড়ে উঠতে পারবে।

যে কারণেই নিউজ রুমের সঙ্গে যুক্ত থাকা বা মাঠ থেকে উঠে আসার প্রতিবেদকটিরই ভালো সুযোগ নিজের ক্যারিয়ারকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবার। তাই চলুন গ্ল্যামারের পেছনে না ছুটে জ্ঞানের পেছনে ছুটি।

শেয়ার করুন: