ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:
আমরা যারা সুন্দরী প্রতিযোগিতার আদৌ প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না, তাদের জন্য সম্প্রতি একটি টক শোতে শম্পা রেজা চমৎকার একটি কথা বলেছেন,
“তোমার আমার কাছে হয়তো সুন্দরী প্রতিযোগিতার গুরুত্ব নেই, কিন্তু এমন অনেকেই আছে, যাদের জীবনে এটা খুব বড় কিছু। So let them have their fun. ” কথাটা আমার ভালো লেগেছে।
সদ্যসমাপ্ত মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ নিয়ে লিখতে গিয়ে ভাবছিলাম, আমরা যেটাকে বলি, লেবু কচলে তেতো করে ফেলা, যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় তাকে – অর্থাৎ যখন আর কচলানোর কোনো অবস্থাই থাকে না, সে অবস্থাকে বলে ” ছিবড়ে ” করে ফেলা। ” মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৭” নামের প্রতিযোগিতা নিয়ে বলতে গেলে এখন আর
“ছিবড়ে” ছাড়া কোনো যুৎসই শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।
চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার সময় আয়োজকদের মতে প্রথমে ভুল নাম ঘোষণা (জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি), বিচারকদের রায়কে অগ্রাহ্য করে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলকে বিজয়ী ঘোষণা করা, এভ্রিলের বিয়ের ভিডিও ভাইরাল, তথ্য গোপনের অভিযোগে এভ্রিলের মুকুট ফিরিয়ে নেয়া, পুনরায় ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে বিচারকদের পছন্দ অনুযায়ী জেসিয়া ইসলামকে নতুন মিস বাংলাদেশ ঘোষণা দেয়া।
এসবের মাঝে অনলাইনে, টক শোতে ঝড়, ট্রল করা, চরিত্রের গুষ্টি উদ্ধার – লেবু কচলে তেতো করার প্রক্রিয়া তো চলছিলোই।
সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাদ পড়লেন এভ্রিল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত না হবার কারণে বাদ পড়েছেন জান্নাতুল সুমাইয়া হিমিও।
এভ্রিলে আত্মহত্যা করেছেন – এমন ভুয়া সংবাদ প্রচারেও নেমে পড়লো লোকে!
মুকুট ফিরিয়ে দিলেও এভ্রিল অবশ্য লোকের এই ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারেনননি। বরং সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি আত্মহত্যা করার মেয়ে না – অর্থাৎ সে গুড়ে বালি। আপাতদৃষ্টিতে মিস বাংলাদেশ নিয়ে ঝড় থামবে মনে হলেও মানুষ এখনো ক্ষান্তি দিতে রাজী না। জেসিয়ার চেহারা নিয়ে শুরু হয়েছে অসুস্থ সব মন্তব্য। খুব অবাক লাগে, আহত হই, যখন দেখি মেয়েরাও কী অবলীলায় অন্য একটি মেয়ের চেহারা নিয়ে কটাক্ষ করে !
দুদিন না যেতে দেখলাম, নতুনভাবে যিনি দ্বিতীয় রানার আপ হয়েছেন, সেই রুকাইয়া জাহান চমকের বিয়ের খবর প্রকাশিত। জানা গেল চমক বিবাহিত এবং স্বামীর সাথেই একই বাড়িতে থাকেন। যদিও চমক বলেছেন, তিনি একটি committed relationship এ আছেন।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে নাকি জানানো হয়েছে , চমকের বিয়ের ব্যাপারে, আগে না জানলেও পরে তারা জেনেছেন।
তার মানে চমকও তথ্য গোপন করেছেন।
চমক পেশায় একজন ডাক্তার। এভ্রিলের মতো তার বাল্যবিবাহ হয়নি। ডিভোর্সও হয়নি। গ্রামাঞ্চলের মেয়ে এভ্রিলের বাল্যবিয়েকে গা থেকে ঝেড়ে ফেলে চলে আসা, হাইস্পিড বাইকার হিসেবে নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার সংগ্রামকে অনেক বড় অর্জন মনে হলেও পরিবার ও বাবা – মা সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়াটা ঠিক হয়নি বলেই মনে করি।
আসলে এভ্রিল বা চমক কারো বিয়ে নিয়েই আমার সমস্যা নেই কারণ আমার বিশ্বাস, বিবাহিত বা অবিবাহিত দিয়ে সুন্দরকে বিচার করা যায় না। কিন্তু যে মঞ্চে ডিভোর্স হয়ে যাওয়া বাল্যবিয়ের তথ্য গোপনের অভিযোগে বিজয়ীর মুকুট ফিরিয়ে নেয়া হলো, সেই একই মঞ্চে, একইভাবে বিয়ের কথা গোপন করলেও আরেকজন প্রতিযোগী কীভাবে তার অবস্থানে বহাল থাকতে পারেন ভেবে পাইনা।
সত্যমিথ্যার দোলাচলে বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ এবং তুমুল সমালোচিত হয়ে উঠেছে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৭ এর এবারের আয়োজন।
২০০৪ সালে ভারতে লক্ষ্মী পণ্ডিতের কাছ থেকে ” মিস ইন্ডিয়া ” খেতাব ও মুকুট কেড়ে নেয়া হয়েছিল বিয়ের গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণে। যদিও পরে জানা যায়, মুম্বাই শহরে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়ার জন্য লক্ষ্মী নিজেকে বিবাহিত বলে পরিচয় দিয়েছিলেন, তা থেকেই এই দুঃখজনক ঘটনা ।
সুন্দরী প্রতিযোগিতা একজন প্রতিযোগীকে ঠিক কোন দৃষ্টিতে বিচার করে আই ধারণাটা আসলে পরিষ্কার হওয়া দরকার। এটা শুধু মিস বাংলাদেশের জন্য বলছিনা, বিশ্ব সুন্দরীর আসরকে মাথায় রেখেই বলছি।
শরীরের মাপজোখ করে, জীবনে কোনোদিন গান না গেয়ে, নাচ না শিখে বিভিন্ন রাউন্ডে নাচ – গান – অভিনয় দেখানোর বৃথা চেষ্টা করে, দু চারখানা পাখিপড়ার মতো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সেরা সুন্দরীর মুকুট মাথায় তোলা যে কত বিরক্তিকর কনসেপ্ট একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কী আমরা বুঝতে পারছি না?
বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার এই আসর শুরু হয়েছিলো ১৯৫১ সালে। অবাক লাগে, অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময়কাল পার করে এসেও, আজো সুন্দরী নির্বাচনের মানদণ্ড কুমারিত্ব, ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক আর বিকিনিতে আটকা পড়ে আছে! যুগ যুগ ধরে প্রতিযোগীরা এসব উদ্ভট, শর্ত মেনে নিয়ে এতে অংশগ্রহণ করছে! সারাবিশ্ব করতালিমুখর হয়ে উঠছে!
এমন সাহসী মেয়ে দেখলাম না, যে এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে যেতে পারলো যে, আমার শরীরের মাপ কত বা আমাকে বিকিনিতে কেমন দেখায় তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু এ বিশ্বকে দেবার আছে আমার।
আবারো মফস্বলের একটি ঘটনার কথা বলি।
মফস্বল শহরের অর্ধশিক্ষিত একটি ছেলে। কিছুদিন প্রেম করার পর প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেল বাবা – মায়ের পছন্দের পাত্রের সাথে। কিছুদিন বিরহকাল কাটলো। হঠাৎ একদিন মেয়েটি ফোন করে দেখা করতে চায়। দেখা হলো। মেয়েটি কেঁদেকেটে জানালো সে ভুল করেছে। আবার ফিরে আসতে চায়। ছেলেটির জবাব ছিলো,
” তুমার বিয়ে হয়ে গেসে, এট্টা কথা পরিষ্কার শুনে রাখো, টিটো ( ছদ্মনাম) বেচা গরুর দাঁত দেখে না। “
গরুর হাটে গরু কেনার সময় বয়স বোঝার জন্য দাঁত দেখানোর কী সব ব্যাপার থাকে শুনেছি। যে গরু বিক্রি হয়ে যায় অর্থাৎ কেউ কিনে ফেলে, তার দাঁত দেখার কোনো দরকার পড়েনা। সেখান থেকেই ” বেচা গরুর দাঁত না দেখার ” কথাটা প্রচলিত। যে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়, তাদেরকে বেচা গরুর সাথে তুলনা করা হয়। গরু থুড়ি মেয়ে যতই সুন্দর বা কম বয়সী হোক না কেন বিয়ে হয়ে গেল মানেই বিক্রি হয়ে গেল, কারো কেনা সম্পত্তি হয়ে গেল।
সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের অন্যতম প্রধান শর্ত যখন “অবিবাহিত হতে হবে” বলে বেঁধে দেয়া হয়, তখন আমার গরুর হাটের কথা মনে পড়ে যায়। মফস্বলের প্রায় অশিক্ষিত টিটোর “বেচা গরুর দাঁত দেখিনা ” নীতির সাথে জাঁকজমকপূর্ণ সুন্দরী প্রতিযোগিতার নীতিনির্ধারকদের ” অবিবাহিত হতে হবে ” নীতির মাঝে কোনো পার্থক্য আমি করতে পারি না।
সুন্দরী প্রতিযোগিতা বন্ধ হোক সেই দাবি আমি করিনা, কিন্তু আমি চাই অসম্মানজনক ভাবে মেয়েরা উপস্থাপিত না হোক , অযৌক্তিক কোনো শর্ত না জুড়ে দেয়া হোক। চাইনা গরুর হাট আর সুন্দরী প্রতিযোগিতা একই কাতারে এসে দাঁড়াক।
প্রতিযোগীদের প্রতিভা ও মেধা অনুযায়ী তাদের পারফর্ম করতে দেয়া হোক। বিশ্ব দরবারে তাদেরকে মন খুলে বলতে দেয়া হোক, জীবনের গল্প, জীবনযুদ্ধে জয় – পরাজয়, স্বপ্ন অথবা স্বপ্নভঙ্গ এবং মাথা নত না করার গল্প। বের হয়ে আসুক ভেতরে – বাহিরে – অন্তরে অনিন্দ্য সুন্দর কিছু মানুষ, আপন আলোয় উদ্ভাসিত করুন এ বিশ্ব চরাচর।
শুভ কামনা জেসিয়া ইসলাম, মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৭। গতানুগতিকতা ছেড়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, বাংলাদেশের নারীদের “বাধার বিন্ধ্যাচল” পেরিয়ে অনন্যা হয়ে ওঠার গল্প তুলে ধরবেন গোটা বিশ্বের কাছে – এই প্রত্যাশা।