মিলান কুন্ডেরার ফেইসবুক আইডি নাই ক্যান?

উম্মে ফারহানা:

গল্পটার নাম হবার কথা ছিল, ‘লেখক’। শুধুমাত্র চরিত্র ভাইবা নিয়াই আমি নাম ঠিক কইরা ফেলছিলাম। কিন্তু লেখার সময় দেখলাম নাম পালটায়া গিয়া হইয়া গেল “মিলান কুন্ডেরার ফেইসবুক আইডি নাই ক্যান”। গত বছরেও নোবেল পুরষ্কার ঘোষণার আগে আগে কে নোবেল পাইতে পারেন সেই জল্পনা কল্পনার সময় মিলান কুন্ডেরার নাম আসছিল, এইবারও আসছে। কিন্তু গল্পের নামে শহিদুল জহিরের প্রভাব আছে দেইখ্যা ভাইবেন না যে কোন জাদুবাস্তবতাসমৃদ্ধ উত্তর আধুনিক গল্প ফাইদা বসতেছি।

আসলে এইটা একটা সাদামাটা গল্প, এক লেখক ভদ্রলোকেরে নিয়া, কিংবা আমার লেখক সংক্রান্ত তিতা অভিজ্ঞতা নিয়া। আসলে আমি কোন তিতা কিচ্ছা কইতেই চাইনা, কিন্তু ফেইসবুক জিনিসটাই এমন যে আমারে খালি তিতা অভিজ্ঞতাই দেয়। এইবার মিলান কুন্ডেরা যদি নোবেল প্রাইজ পাইয়া যান, তাইলে আমি অবশ্যই সুধীর ঘোষের সন্দেশ খায়া আর খাওয়াইয়া সেইটার উদযাপন করমু। তার আগে মিলান কুণ্ডেরার নাম দিয়া সার্চ দিয়া দেখলাম অনেক অথর পেজ আছে এই নামে, লাইক দেওয়া সম্ভব, কিন্তু ব্যক্তি মিলানের সঙ্গে যোগাযোগ নিশ্চয়ই সম্ভব না। আমার নিজের শহরের লেখক তসলিমা নাসরিনও আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নাই। আর কুন্ডেরা ত অনেক সুদুরের ব্যাপার। যদি উনি ফরাসি ভাষায় কোন আইডি চালায়াও থাকেন সেইটা ফলো কইরাও ত আমি কিছুই বুঝমু না, ছাত্রজীবনে অনেকবার অলিয়স ফ্রসেতে ভর্তি হইতে চাইছি, পয়সা জমায়া উঠতে পারিনাই। শুধু একটা ফরাসি বাক্য আমি কইতে পারি, সেইটা হইল ‘সে বঁ’ মানে ‘এইটা ভাল’।

ফরাসির মতন উর্দুও আমি জানিনা, কিন্তু উর্দুভাষী গায়ক আলি জাফরের প্রেমে পইড়াও অনেক হাবুডুবু খাইছি এক সময়, যেইভাবে মিলান কুন্ডেরার প্রেমে পইড়া খাবি খাইতেছি এখন। আমার এক বাল্যবন্ধু খুব হাইসা উড়াইয়া দিয়া কইছিল এইসব একতরফা প্রেমের মানে কী হইতে পারে। আমার কাছে প্রেমের এক তরফ বা দুই তরফে কোনদিনও কিছু আয়া যায়নাই। প্রেম হইল নিজে অনুভব করার বিষয়, অন্য তরফে কি আছে তাতে কি লাভ আর কি ক্ষতি? আলি জাফর কোক স্টুডিওতে এক দুর্বোধ্য গান করছেন, গানের টাইটেল হইল ‘ইয়ার ডাডি’। আমার মা খালারা শক্তরে কলোকিয়ালে কন ডাডি, ‘বাত ডাডি হইয়া গেছে’ মানে ‘ভাত শক্ত হয়ে গেছে’। আমি আলি জাফরের সেই গান শুইন্যা মোটাহমুটি ফিদা হইয়া গেছিলাম। প্রতি রাত্রে ঘুমাইতে যাইবার আগে অন্তত পাঁচ ছয় বার ওই গান দেইখা ঘুমাইতে যাইতাম।

গান আসলে শুনবার বিষয়, কিন্তু গায়কের এক্সপ্রেশন দেখারও জিনিস। কিন্তু লেখকদের প্রেমে কেউ ক্যান পড়ে? তাদের ক্ষেত্রে তো শোনা বা দেখার কিছু নাই। কৈশোরে আমি ‘নীললোহিত’ নামের এক লেখকের প্রেমে পড়ছিলাম, জানতাম ওইটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় নাই। সুনীল তখন একজন বুড়া মানুষ আর নীললোহিতের বয়স সাতাইশের বেশি কোনদিন হয় না, আমি সপ্তদশী কিশোরী বা তরুণী হিসাবে এই লেখকের কিংবা বলা ভাল এই চরিত্রের প্রেমে পড়তেই পারি। চেহারা বা গলার স্বর কল্পনায় ভাইবা নেওয়া যাইতে পারে। বইয়ের ফ্ল্যাপে অবশ্য সুনীলের ছবি থাকত। ‘দ্য গ্রাউন্ড বিনিথ হার ফিট’ পড়বার পর আমি সালমান রুশদীর প্রেমেও পড়ছিলাম, কিন্তু প্রেমটা কি আমার আব্বার বয়সী লেখকের সঙ্গে হইছিল না কি উপন্যাসের ন্যারেটর উমিদ মার্চেন্টের লগে সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত না।

মিলান কুন্ডেরার ব্যাপারটা একটু আলাদা, উনার কোন চরিত্রের প্রতি আমি আসক্ত না, লুদভিক বা টমাস আমারে অত মুগ্ধ করেনাই যতটা করতে পারছেন নানার বয়সী কুন্ডেরা নিজে। মজার ব্যাপার হইল উনার বুড়া বয়সের ছবি ছাড়া আর কুন ছবি আমি দেখিনাই, কোন ইন্টারভিউও দেখিনাই।

আসল প্রসঙ্গে আসি, যেই লেখকের কথা কইতেছি উনার লগে আমার আলাপ হইছিল ফেইসবুকের বাইরেই, মানে বাস্তবেই। কথা হইতেছিল ফেইসবুকের চ্যাটবক্সে, কুন্ডেরার ব্যাপারেও মত বিনিময় হইছিল। আমার ফেইসবুকে দুই তিনজন কবি, গায়ক আর লেখকও আছেন যারা বিখ্যাত, এই ব্যাক্তিও বিখ্যাত, তাই নাম কইলাম না। উনি দেখলাম সাহিত্যের বদলে ব্যক্তিগত আলাপে বেশি উৎসাহী। কিছুক্ষণ আলাপের পরেই উনার কথাবার্তা আদিরসের দিকে ঝুইকা যায়। তখন আমি একজন সিঙ্গেল নারী, পূর্ণবয়স্কা ও সুন্দরী না হইলেও স্বাস্থ্যবতী, অনেক রাতে উনার লগে ফেইসবুকে আলাপচারিতা চালাইতেছি বইলাই কি উনার কুড়কুড়ানি উইঠা গেল কিনা বুঝলাম না। এই রকমের কুড়কুড়ানিওলা অনেকেরে আমার আনফ্রেন্ড এবং ব্লক করতে হইছে আগে। দুইএকজন বাস্তবের পুরুষ বন্ধুর লগেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হইছে। একজন মেয়ে একা আছে এবং তার কোন স্বামী বা স্থির প্রেমিক নাই বইলাই আর সে উন্মুক্তভাবে সকলের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে বইলাই সে সকলের জন্যেই দুই পা ফাঁক কইরা দিবে এমন ভাইবা নেওয়া লোকের সংখ্যা কম নাই।

কিন্তু কথা হইল, এইটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে এই লেখকের মতন অন্যন্য ব্যক্তিরাও কিন্তু নিজেদের ঘর, স্ত্রী কিংবা প্রেমিকারে সামলাইয়া চলতে জানেেন। উনাদের যখন সুবিধা হয়, মানে স্ত্রী বা প্রেমিকা আশেপাশে থাকেন না, তখন উনারা আমারে নক করেন। ত সেই লেখক ভদ্রলোক আবার আমারে লেখার বিষয়ে উৎসাহও দিছিলেন, আমি মেইল কইরা উনারে আমার লেখা গল্প পাঠাইলাম, উনি পড়বার সময়ও পান নাই। কিন্তু ফেইসবুকের চ্যাটবক্সে প্রায় সময়েই কুশলাদি জিগান। উনার লেখার লিংক ছাড়া আর কোন এক্টিভিটিজ দেখি না, জন্মদিন বিবাহবার্ষিকী, ঈদ পূজার বেড়ান বা অন্য কোন ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক পোস্ট দেখতে পাইনা। রিডিং অমক বই বা ওয়াচিং অমুক ফিল্ম, এই ধরনের পোস্টও দেখি না। খালি উনারে অনলাইনেই দেখি। আমি ফেবুতে ঢুকলেই উনার একটা মেসেজ পায়া যাই। আমি জানি না উনার স্ত্রী কি করেন, সন্তানটি পুত্র না কন্যা, উনার স্ত্রীর লগে উনার সম্পর্ক কি রকমের তাও জানি না।

উনারে ব্লক করতে গিয়াও আমার মনে হয়, ভার্বাল অ্যাবিউজের অভিযোগ তোলা যাবে না, নেহাত ব্যক্তিগত অস্বস্তির ভিত্তিতে উনারে ব্লক করাটা কি উচিৎ? আমার ফেইসবুকে আমি কারে রাখমু আর কারে রাখমু না এই সিদ্ধান্ত ত আমার নিজের। উচিৎ অনুচিতের ফয়সালা আর কে করবে? উঠতি বা প্রতিষ্ঠিত কবি দুই একজন আমার লিস্টিতে আছেন, উনাদের কবিতার লিংক পাইলে পড়িও, বুঝার চেষ্টাও করি, যদিও কবিতা তেমন একটা বুঝি না। গদ্য লেখক, বা বলা ভাল কাহিনীকার মানুষের প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে, নিজেই টের পাই। ব্লক না করার পিছনে এইটা একটা কারণ হইলেও হইতে পারে। কিন্তু এই দুর্বলতা ত আর প্রেম না। যেভাবে সালমান রুশদীর বা মিলান কুন্ডেরার প্রেমে ছিলাম বা আছি তা উনার জন্যে সম্ভব না। আমি উনার লেখা তেমন পড়িওনাই। যেইটুক পড়ছি তাতেও মুগ্ধ হইনাই। তবু উনি লেখক, এইটাই একটা গুণ উনার, যেই গুণের লাইগ্যা উনি মাফ পায়া যাইতেছেন। আমি ত আর লেখক হইতে পারমু না।

কার য্যান কবিতায় পড়ছিলাম, মেয়েরা লেখলে সেইটা কবিতা হয়না, ‘পদ্য’ হয়। গদ্য লেখলে সেইটা হয় পুরুষের কলমে লেখা দুর্বল অনুকরণ। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ভক্ত উর্দুভাষী এক ভদ্রলোক নাকি রবীন্দ্র সংগীত না লালনের গান শুইনা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রে জিগাইছিলেন, “ইস মে সংগীত কাঁহা?” ত আমার এই গল্প শুইনাও আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে কইতেছেন, এইখানে গল্পটা কই? পুরুষের কাছে নারী এক ভোগ্যবস্তু। সে নারী কর্মজীবী শ্রেণীর না শিক্ষিত তাতে কি আয়া যায়? নিশি রাইতে কোন নারীর লগে ফেইসবুকে চ্যাটাইয়া যদি হাত মারা যায় তাইলে লেখকের লাইগ্যা ভালই, শরীর শান্ত হইল, ঠাণ্ডা মাথায় লেখালেখির কাজ শুরু করা যাইল। ওই নারী পড়ুয়া ধরনের হইলে তাঁরে ইম্প্রেস করবার জন্যে না হয় শুরুতে খানিকক্ষণ ‘দ্য জোক’ নিয়া কথা কওন গেল।

এ আর নতুন কি? লেখকেরা লেখেন নারীরে বিষয়বস্তু বানায়া, কেন্দ্রীয় চরিত্র কইরা, সাতকাহন থাইকা পঁচিশ কাহন লেখার সামর্থ্য রাখেন। এই সামর্থ্য অর্জন করার জন্যে উনাদের প্রচুর নারীর লগে বিভিন্ন পদের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করন লাগে। সশরীরে লাগে, ভার্চুয়ালিও লাগে। এই সব অভিজ্ঞতা মিলায়া মিশায়া উনারা নারীর মনস্তত্ত্ব বুঝেন, সেইভাবে চরিত্রচিত্রণ করেন। এইটা উনাদের শিল্পী সত্ত্বার ডিমান্ড। এই নিয়া কথা কওনের কিছু নাই।

‘দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ এর প্রধান চরিত্র টমাস একজন উম্যানাইজার। যারা বইটা পড়ছেন তাঁদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, অইখানে উম্যানাইজাররা ক্যামনে দুই প্রকার তার ব্যখ্যাও দিছিলেন কুন্ডেরা, উনার মতে উম্যানাইজার পুরুষরা দুই পদের- এপিক্যাল আর লিরিক্যাল।

উম্যানাইজার শব্দটা নিয়াও মজার ঘটনা আছে একটা। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন; একবার ক্লাসে উম্যানাইজারের মানে কি কথা উঠলে আমরা কইছিলাম ‘নারীলিপ্সু’। ম্যাডাম খুব বিরক্ত হইয়া কইছিলেন, “এসব উদ্ভট বাংলা তোমরা কোত্থেকে পাও? উম্যানাইজার মানে হলো ‘রমণীমোহন’, মানে নারীরা যেসব পুরুষকে পছন্দ করেন”। আমি তখন নিশ্চিত হবার জন্যে অক্সফোর্ড দেখছিলাম। অবশ্যই নারীলিপ্সু শব্দটা উদ্ভট, আসলে এইটা হইব ‘মাগীবাজ’। মিলান কুন্ডেরা মাগীবাজ অর্থে উম্যানাইজার কি না তা আমি জানি না, তবে ম্যাডামের বলা অর্থে উনি উম্যানাইজার ত বটেনই।

আমার মতন আর অনেক নারী নিশ্চয়ই উনার প্রেমে হাবুডুবু খাইছেন, অনেকে ডুইব্যাও গেছেন। আহা, মিলান কুন্ডেরা যদি আমার ফেইসবুকের লিস্টিতে থাকতেন, আমি দিন-রাত উনার লগে চ্যাটাইতে রাজি ছিলাম। তাইলে আপনে জিগাইতে পারেন, এই লেখক কি দোষ করলেন? নাকি নোবেল পদকের সম্ভাব্য তালিকায় ইনার নাম নাই দেইখ্যা আমার আপত্তি?ভাই, আঙ্গর মমেনসিংগে একটা বচন আছে, কই আগরতলা আর কই উগারতলা। উগারতলা মানে জানেন নাকি? জানেন না? কন কি? তাইলে ত কিচ্ছাডা মাঠে মারা গেল।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.