ফারদিন ফেরদৌস:
কোনো সাইটেশান অর্থাৎ লেখার উৎস বা সূত্র উল্লেখ না করে অন্য কারো লেখা বক্তব্য বা মতামত নিজের নামে চালিয়ে দেয়া হলো প্ল্যাজিয়ারিজম। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষক শিক্ষার্থীমাত্রই জানেন। শিক্ষার্থী যাতে প্ল্যাজিয়ারিজম মুক্ত হয়ে তার গবেষণাপত্র তৈরি করতে পারেন, এজন্য এথিক্স ক্লাসও করানো হয়। তারপরও বিশ্বব্যাপীই গবেষকদের থিসিস পেপার প্ল্যাজিয়ারিজম দোষে দুষ্ট হয়।
আর বাংলাদেশ তো তৃতীয় বিশ্বেরই একটা দেশ। কাজেই এখানে হরহামেশা প্ল্যাজিয়ারিস্ট মেলাটা অসম্ভব বা অবাস্তবতা কিছু নয়। প্ল্যাজিয়ারিজমের সহজ বাংলা লেখা চুরি করা বা মেরে দেয়া। এমন একটি অভিযোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী সামিয়া রহমানের বিরুদ্ধে ওঠেছে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে।
কুম্ভিলকবৃত্তি বা লেখাচুরির মতো ঘটনা সর্বসাধারণের বোধগম্যতার বিষয় নয়। দেশের আপামর জনগণ গবেষকও নয়। তথাপি বাঙালি এখন সামিয়া রহমানকে চোর সাব্যস্ত করে বিচারের দন্ড হিসেবে ধুয়ে দিচ্ছে। বিচারকের কাছে এখন আর বিচারের ভার নেই।
সামিয়া রহমানের অপরাধ বিবেচনার বাইরে গিয়ে সবাই এখন সোশ্যাল মিডিয়ার টাইমলাইনে তাঁর ব্যক্তিজীবনের সমালোচনায় মেতেছে। দেখাই যাচ্ছে এক্ষেত্রে আমরা আমাদের অধিকারবোধের সীমারেখাও অতিক্রম করে ফেলছি। একবার ভাবুন তো আমরা ক’জন জানি ‘প্ল্যাজিয়ারিজম’ শব্দটি? ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকোকেই বা আমরা ক’জন চিনি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমান ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজানের বিরুদ্ধে মিশেল ফুকোর ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি নিবন্ধ থেকে ৫ পৃষ্ঠা লেখা হুবহু চুরির অভিযোগ ওঠেছে। তাদের যৌথ গবেষণা নিবন্ধ ‘আ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার: এ কেস স্টাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোস্যাল সায়েন্স রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই নিবন্ধে মিশেল ফুকোর লেখা থেকে চুরির অভিযোগ উঠে। ১৯৮২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’র ৪নং ভলিউমে ফুকোর ওই নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।
এরইমধ্যে সামিয়া তা অস্বীকার করে এর সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়েছেন শিক্ষক মারজানের ওপর। আর মারজান বলছেন, তার ওপর দায় চাপাতে চাচ্ছেন সামিয়া। বিষয়টি এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তদন্তাধীন।
অন্যদিকে ঢাবি ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধেও লেখা চুরির অভিযোগে আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিভাগের শিক্ষক রুহুল আমিন ও নুসরাত জাহান এবং বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠেছে।
এখন এসব চৌর্যবৃত্তির ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কথা বলা মানে বিচারাধীন একটি বিষয় সুরাহার আগেই উপসংহারে পৌছে যাওয়া। কিন্তু আমরা যুক্তিবাদি মানুষ হিসেবে তদন্তে অপরাধ প্রমাণের আগেই কি কারো শাস্তি দিয়ে ফেলতে পারি?
আমাদের রোজকার ঝাঁঝালো ট্রলে মারজান বা অপরাপর শিক্ষককে কিন্তু টানছি না। ঘুরেফিরে তুলোধুনো করা হচ্ছে সামিয়া রহমানকে। কারণটা খুব সোজা। আমরা জাতিগতভাবে ঈর্ষাপ্রবণ ও নারিবিদ্বেষী। সামিয়া রহমান যেহেতু সংবাদ সেলিব্রেটি ও দেখতে সুন্দরী নারী, তাকে গালাগাল পেরে পুরুষেরা তাদের অবদমিত মর্ষকাম খুব ভালোভাবে মেটাতে পারে।
সামিয়া রহমানের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এসোসিয়েট প্রফেসর হয়েও বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টি ফোরে হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পদে পূর্ণকালীন চাকরি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রুল অনুযায়ী একজন শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করতে পারেন। কিন্তু সামিয়া এক্ষেত্রে দাবি করছেন, তিনি ফ্রিল্যান্স কাজ করছেন এবং তা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়েই। সম্প্রতি প্রাক্তন হওয়া ঢাবি ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও সামিয়াকে টিভিতে কাজ করবার অনুমতি দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন। এ বিষয়টিও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব এখতিয়ার। কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন শিক্ষক হিসেবে সামিয়া রহমানের টেলিভিশনে কাজ করা আইনের লঙ্ঘন হয়েছে তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার তারা সংরক্ষণ করেন। সেখানে আমাকে আপনাকে মতামত দেয়ার জন্য ডাকার আগে কেন কথা বলে জলঘোলা করবো?
নিশ্চিতার্থেই সামিয়া রহমান যদি মিশেল ফুকোর লেখা চুরি করে নিজের গবেষণাপত্র রচনা করেন এবং শিক্ষকতার পাশাপাশি আরেকটি লাভজনক বেসরকারি চাকরিতে রত থেকে আইনের ব্যত্যয় ঘটান নিঃসন্দেহে আমরা তাঁর এমন অপরাধের নিন্দা করব এবং অন্যদেরও একই অপরাধ না করবার অনুরোধ জানাবো।
কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই বা তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার আগেই আমরা এই মিডিয়াকর্মীর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছি কেন? একবার ভাবুন তো, এই মানুষটি তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালনের বাইরে কোনো শিশুসন্তানের মা, কোনো বৃদ্ধ মা বাবার সন্তান। আমাদের সমস্বর বক্রোক্তি বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ্গুলো ওই পরিবারটির ওপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে? চুরি প্রমাণ হওয়ার আগেই সামিয়া রহমানকে যদি তাঁর শিশু সন্তান এখন প্রশ্ন করে, মা, তুমি কি চোর? এর উত্তরে মা কী বলবেন?
সামিয়া কাণ্ডে একাডেমিক একটি গ্রুপ ছবিকে ভাইরাল বানিয়ে ফেলছে ফেসবুক প্রটেস্টাররা। জানা যাচ্ছে, একটি পাবিলিকেশন সেরেমনির পর চা চক্রে একেবারেই অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সেসময়ের ডিন মিস্টার ফরিদ, সামিয়া রহমানের বাবা, একাত্তর টিভির সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু এবং ঐসময়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপার্সন আখতার সুলতানা বসে আছেন। ফটোফ্রেমে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় সামিয়া রহমান দুই শিক্ষকের মাঝে সোফার হাতলে বসে পড়েছেন। এটাকেই হেটাররা বিচ্ছিরি ভাষায় নিন্দা জানিয়ে আসছে। উগ্র বিরুদ্ধবাদীরা বলছেন, তিনি নাকি শিক্ষকের কোলে বসে আছেন! সব ছবির মধ্যেই যদি আমরা যৌনতা খোঁজে ফিরি তাহলে পারিবারিক মূল্যবোধ বা ছাত্রী শিক্ষকের সম্পর্ক বলে আর কিছু কি অবিশিষ্ট থাকে? এই ছবিটাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতিবাচকভাবে ভাইরাল করে দিয়ে স্রেফ আমাদের বিকৃত ও কদর্য রূচিবোধটাকেই উন্মুক্ত করে দিচ্ছি, আর কিছু নয়।
এভাবে চলতে থাকলে কেউ কারও পাশে দাঁড়িয়ে বা বসে ছবিই তুলতে পারবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের প্রিয় ক্রিকেটারদের সন্তান স্নেহে আদর করেন। সেই ছবি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিতও হয়। তবে কি নিন্দুকের বিরুদ্ধ অভিসন্ধি থেকে একসময় এই ছবিগুলোও রক্ষা পাবে না?
আমরা চাই, মানুষ তাঁর কর্মের অনুরূপ ফল ভোগ করুক। আইনের চোখে সামিয়া রহমান ও তাঁর সতীর্থরা অপরাধী প্রমাণিত হলে দেশের প্রচলিত দন্ডবিধি অনুসারে তাঁদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। কিন্তু যদি দেখা যায় সামিয়া রহমান তাঁর সকল ভ্রান্তি কাটিয়ে ওঠে পুনরায় সাফসুতরো জীবন ফিরে পেলেন তখন আমাদের উদ্দেশ্যপ্রবণ ঈর্ষার লজ্জা ঢাকব কি করে? তাহলে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত কি আমাদের তর সওয়া উচিৎ হবে না?
সামিয়া রহমান একজন মেধাবী শিক্ষক, জনপ্রিয় টেলিভিশন উপস্থাপক এবং লেখক। একটা গবেষণাপত্রে কয়েক পৃষ্ঠা চুরির ঘটনাতেই কি তাঁর সকল অর্জন ও দেশের প্রতি অবদান ধুলায় লুটিয়ে যাবে? সব নিন্দা যদি একজন অভিযুক্ত প্ল্যাজিয়ারিস্টের বিরুদ্ধেই ঢেলে দেয়া হয় তাহলে রাজকীয় চোর যারা, যাদের অর্থলোপাট কিংবা ভুলভাল নীতিনির্ধারণে বিপাকে পড়ে দেশের লাখো প্রান্তিক মানুষ, পরিবর্তিত হয়ে যায় দেশের সার্বভৌম ভূগোল তাদের বেলা সমালোচনার তীরে ধার পাওয়া যাবে কোথায়? কাজেই শুধু অশোভন ও অশালীন ট্রলবাজি না করে গঠনমূলক সমালোচনার বিদ্যাবুদ্ধিটাও আমাদের রপ্ত করা চাই। সকলক্ষেত্রে সভ্যতা চর্চা হোক আমাদের আরাধ্য।
ফারদিন ফেরদৌস: লেখক ও সাংবাদিক