আসুন, অসাম্প্রদায়িকতার গল্প শোনাই

মামুনুর রশীদ:

বাদলদের বাসাটা কত দূরে ছিল আমাদের বাসা থেকে?
দুই মিনিট – বড়জোর তিন মিনিটের হাঁটা। মধ্যে ফারুকদের বাড়িটা না থাকলে আমাদের পড়ার ঘর থেকে বাদলদের বাসাটা দেখা যেত।

ক্লাসের বিক্রমাদিত্য ছাড়া সেই বয়সে বাদলই ছিল আমার – আমাদের অনেকের একমাত্র হিন্দু ধর্ম পালনকারী বন্ধু!
এলাকায় কয়েক ঘর নাপিত ছাড়া শিক্ষিত কোনো পরিবার ছিল না বাদলরা ছাড়া। সমবয়সী আর প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে প্রথম থেকেই বাদল ছিল আমাদেরই একজন!

চমৎকার মানুষ ছিল (অনেক বছর ওদের কোন খোঁজ জানি না, তাই ছিল লিখছি) বাদলের বাবা আর ওর মা (আমাদের কাকীমা), ওর ছোট বোনেরাও ছিল অনেক মিশুক।
আমাদের সবার বাসায় ওদের যেমন অবাধ যাতায়াত ছিল, তেমনি আমরাও কোন দিন -কোনো কারণে সংকোচ করিনি ওদের বাসায় যেতে।
কোনদিন মনে হয়নি আমরা অন্য ধর্মের অনুসারী বলে কখনো ওদের ঘরে গেলে অশৌচ হবে বা সান্ধ্য পূজায় সমস্যা হবে কিনা, কোন গ্লাসে পানি খেলে কোন সমস্যা হবে কিনা, এনিয়ে ভাববার কথা আমাদের কখনো চিন্তাতেই আসেনি, কাকা – কাকীমাকেও এনিয়ে কখনো মুখ কালো করতে দেখিনি, কারো মুখে শুনিওনি।

ঠিক একইভাবে ওরাও আমাদের এবং অন্যদের বাড়িতেও একইভবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাওয়া-আসা করতো, পানাহার করতো কোন দ্বিধা ছাড়াই।
কতদিন আগের কথা এগুলো?
২০ বছর বড়জোর ২৫ বছর!
আমি বুকে হাত দিয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারি, ৮০ আর ৯০ দশকের প্রায় সবার মনেই এমন অনেক সম্প্রীতির ছবি আছে।
আচ্ছা, বাদলদের কথা এখন থাকুক, অন্য কিছু শুনি…

##
এক সময় গির্জা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আমার! সিনেমা – নাটকে দেখেছি কিন্তু সত্যিকারভাবে তখনো কোন গির্জার ভিতরে দেখা হয়নি!
বারিধারার গির্জার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই আমার ইচ্ছে করতো ভিতরে গিয়ে পাদ্রী সাহেবের সাথে কথা বলতে!
এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী প্রায় না থাকায়, পাশের বাড়ির গারো অনিতা দিদির ভাইটার সাথে সাথে থাকতাম পূর্ণিমার রাতে ওদের ফানুস ওড়ানো দেখার লোভে!!
জয়দেবপুরের রথযাত্রার স্মৃতি আমার শৈশব রাঙানো অনেক আনন্দের একটি ব্যাপার।
বিভিন্ন ধরনের নাড়ু – মুড়ি খাওয়া ছাড়া,
পূজার সময় ধামালকোটের মেলা আর কত কত দেবী বিসর্জন দেখা ছিল – এক অদ্ভুত আনন্দের সময়!!
তাছাড়া রোজার ঈদ আর ফাইনাল পরীক্ষার পরবর্তী সময় ছাড়া – পুজার সময়েই যে স্কুলের সবচেয়ে বড় ছুটিটা পড়তো!

##

বিগত ২০/২৫ বছরে পৃথিবীটা এগিয়ে গিয়েছে অনেক, এগিয়ে না আসলে বলা উচিৎ বদলে গিয়েছে অনেক! পৃথিবীর সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে বদলে গিয়েছে আমাদের দেশটাও – সবচেয়ে বেশী বদলে গিয়েছে দেশের মানুষ গুলো!
উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, আধুনিক সব প্রযুক্তির সহজলভ্যতা আর অসংখ্য ব্যবহার – সবকিছু আমাদের চিন্তা চেতনা, কাজ, মানবতা, ভালোবাসা কে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল অন্য উচ্চতায়!
যেই মানুষ চাঁদকে ছুঁয়ে এসেছে তারও আগে, সেই মানুষের তো এতদিনে মানুষের প্রতি মানুষের টানের, মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধের, মানবিকতায়, একে অপরের প্রতি আশ্বাসে – বিশ্বাসে, ভালোবাসার চূড়ায় থাকার কথা ছিল।
কিন্তু দূর্ভাগ্য আমাদের, হয়েছে ঠিক এর উল্টো!! কী কষ্ট, কী কষ্ট…..!
ভয়াবহ রকমে বদলে গিয়েছে আমাদের চারপাশ।
আমার কেন গির্জা দেখতে ইচ্ছে হতো, ঈদের পাশাপাশি পূর্ণিমার ফানুস, পূজার সময়টাতে এত আনন্দ পেতাম – জানি না!
তবে আশেপাশের মানুষগুলোর আনন্দ দেখতে ভালো লাগতো, তারা ও যে আমাদের ঈদে আমাদের মতোই আনন্দ করতো!!

##
পৃথিবীর বুকে প্রতিটি ধর্ম এসেছে – শান্তি, সৌহার্দ্য আর ভালোবাসার কথা বলতে। অথচ কাল পরিক্রমায় সে “ধর্ম” কেই আমরা ব্যবহার করছি একে অন্যের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে!!
জানিনা, আগামী তে কখনো এই অবস্থার পরিবর্তন হবে কিনা, তবে মনে প্রানে চাই এ অবস্থার পরিবর্তন হোক।
প্রতি বছর রোজা – কুরবানি নিয়ে হাসি তামাশা করেন একদল মানুষ , যারা এগুলো পালন করেন তাদের ধর্মের যৌক্তকতা আর মানবিকতা শিখাতে ব্যস্ত সময় কাটান কিছুদিন।
আবার প্রতি বছর পূজা আসলে একদল মানুষ ব্যস্ত হন প্রতিমা ভাংচুরে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে আর নির্যাতন করতে।
তেমনি একই কথা খাটে অন্য সকল ধর্মের বেলায়ও!
কিন্তু কেন??
আপনি আল্লাহ – রসুল মানেন চমৎকার, আপনি দুর্গা – যীশু মানেন, দারুণ, আপনি কিছুই মানেন না – তাও সুন্দর, সবই যার যার মতামত।
কিন্তু আপনার মতের সাথে, বিশ্বাসের সাথে দ্বিমত হলেই তার সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানো কেন?

কেউ ধর্ম বিশ্বাসে ১৮-১৯ ঘন্টা রোজা রাখতে চায়, রাখে – দিন তাকে রাখতে, সম্ভব হলে সাহায্য করুন।
কেউ ধর্ম বিশ্বাসে কোরবানি করতে চায়, দিন তাকে তার মতো করতে। সেটা নিয়ে রঙ্গ রস – অযাচিত দুঃখবোধ দেখানোর কি খুবই দরকার!

কেউ ধর্ম বিশ্বাসে পূজা করবেন, প্রসাদ খাবেন, গরুর মাংস খাবে না – দিন না তার মতো থাকতে!
কেউ ধর্ম বিশ্বাসে ফানুশ উড়াবে, কেউ ক্রুশ পড়বে – এটাই স্বাভাবিক।
আবার কেউ ধর্ম অবিশ্বাসে এর কিছুই করবে না – না করুক! থাকুক না সে, তারমতো।
দিন না যার যার যার মতো থাকতে, আপনি ও থাকুন নিজের মত। অন্যের মানা না মানা তে কি আপনার খুব বেশী আসে যায়?

##
আমি আস্তিক মানুষ ভালোবাসি, আমি নাস্তিক মানুষ ভালোবাসি, এমনকি এই দুই বিশ্বাসের মাঝামাঝি মানুষদের কেও ভালোবাসি। কিন্তু ধর্ম আর অধর্মের লেবাসে থাকা অমানুষদের অপছন্দ করি, করুণা করি।
মনে হয়, আহারে এই সুন্দর পৃথিবীতে এরা “ভালোবাসা” র মতো সুন্দর একটা জিনিষের রুপ – শক্তি এরা উপলব্ধি করতে পারলো না!
এদের জীবন টা কেটে যায় অন্যের খারাপ বলতে বলতে – করতে করতে।
একটা জীবনের কি অপচয়!!

##
এবারের ঈদ তো গিয়েছে, পূজার মৌসুম চলছে – বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা ভাঙার খবর শুনছি, নির্যাতনের খবর শুনছি মাঝে মাঝে, আর মনটা খারাপ হচ্ছে!
আমার বাদলের কথা মনে পড়ছে, আমার বিক্রমাদিত্যের কথা মনে পড়ছে – এই মনে পড়া শুধু বন্ধুর কথা স্মরণ করা নয়, এই মনে পড়ায় এক ধরনের ভয় মিশে আছে, সেটাই ধার্মিক হিসাবে লজ্জার, বাঙালী হিসাবে লজ্জার- মানুষ হিসাবে লজ্জার!!
আসুন, আস্তিক – নাস্তিক – মুসলমান – হিন্দু – বৌদ্ধ হওয়ার আগে মানুষ হই আর মানুষ না হতে পারলে ধার্মিক হলেই কি আর নাস্তিক হলেই কি?
ধর্ম হোক যার যার, মানবতা হোক সবার…..

(Published as part of social media campaign #BeHumaneFirst to promote secularism in Bangladesh)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.