আসুন, নিজেরাই সতর্ক হই

সাদিয়া সুলতানা:

আমাদের সময় পাঠ্যপুস্তকে যৌন হয়রানি কী বা যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা পড়িনি। মনে পড়ছে না। আমার বাবা-মাও এসব বিষয় কোনোদিন শেখাননি। ছোটবেলায় কেবল শুনতাম, ছেলেধরার গল্প। অপরিচিত কারো কাছ থেকে চকলেট নিতে হয় না, নিলে এরা নাকি বস্তায় ভরে নিয়ে যায়, হাত-পা ভেঙে ভিক্ষে করতে নামায়। ভিক্ষে করতে নামানো ছাড়াই সুদৃশ্য গৃহকোণেও যে সন্তানের জন্য হয়রানি ওঁৎ পেতে থাকতো তার খবর হয়তো তারা রাখতেন না বা জানতেনও না, নীরবে-নিভৃতে তাদের সন্তানেরা কী অদ্ভুত সব যাতনা পুষে বেড়াতো।

কিন্তু আমরা এসময়ের সচেতন বাবা-মা। প্রায় সবারই চোখ-কান খোলা। নিজের সন্তানের নিরাপত্তার জন্য অনেক কিছুই আমরা ভেবে রাখি, প্রস্তুতি নেই। তবে ছেলে ধরা, মেয়ে ধরা গল্পের সাথে সাথে এখন আমাদের সন্তানদের জন্য আরো কিছু ভয়ংকর বিষয় ওৎ পেতে থাকে। তাই হয়তো বড় করে তোলার সাথে সাথে তাদের অন্ধকারের পাঠ দিয়ে তাদের নির্ভীক শৈশব আমরা কেড়ে নিই।

এই তো সেদিন সকালের ঘটনা। পত্রিকার নিয়মিত পাঠক আমার মেয়ে শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকী থেকে গল্পকার মোজাফফর হোসেনের ‘গল্পটি পুরুষের কিন্তু কোনো পুরুষ বুঝবেনা’ গল্পটি পড়ছিল। আমি বললাম, তুই যে এই গল্প পড়ছিস, তুই বুঝবি?’ আমার দশ বছরের মেয়ে গুরুগম্ভীর গলায় বললো, ‘বুঝি আমি সব। আমি জানি ধর্ষণ কী।’ মেয়ের কথা শুনে আমার বুক কেঁপে উঠলো। কোথায় দাঁড়িয়ে আছি! কীভাবে আমি ওর ঘোর লাগা শৈশব কেড়ে নিচ্ছি! নাকি কর্মজীবী মা হিসেবে আমার অধিক সাবধানতা ওকে সময়ের আগেই বড় করে দিয়েছে! কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায় আছে কি?

কর্মজীবী নারী হিসেবে একজন মায়ের তার সন্তানদের নিরাপদে বড় করার জন্য যুদ্ধের শেষ নেই। যারা যুদ্ধ টিকে আছেন তারা অনেক কিছুর বিনিময়ে টিকে আছেন। আর যারা টিকে নেই, তারা নিজের ক্যারিয়ারের বিনিময়ে ভিন্ন এক যুদ্ধে সামিল আছেন। তবু সব মায়ের উৎকণ্ঠা একই। কোথাও না কোথাও সব মায়ের সংগ্রামই এক ও অভিন্ন।

যাহোক একজন কর্মজীবী মা হিসেবে আজ আমি নিজের কিছু অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। খালি উৎকন্ঠায় থেকে থেকে তো আর জীবন চলবে না। আসুন না আরেকটু সাবধান হই। নিজে নিজে আরেকবার ঝালাই করে নেই, বিকৃতমনা পেডোফাইলদের হাত থেকে বাচ্চাদের রক্ষার জন্য কী করবো?

আমি ব্যক্তিগত জীবনে যে সব করার চেষ্টা করি,

১. বাবা-মা ছাড়া বাচ্চাদের বাসায় কোনো অর্ধপরিচিত বা ঘনিষ্ট ছেলে বা মেয়ে আত্মীয়ের কাছে একা বাসায় রেখে যাই না।
যখন কোনো অভিভাবক পেতাম না, অফিসে নিজের রুমে বাচ্চাদের রেখেছি। ডে কেয়ার সেন্টারের সুবিধা পাইনি কখনো, তাই কারো কথার পরোয়া করিনি।
২. বাচ্চাদের কোলে থাকার সময়টাতে অপরিচিত বা অর্ধপরিচিত কারো কোলে দেইনি বা অযাচিতভাবে কারো কোলে দেইনি।
৩. যে কোনো জায়গায় বাচ্চাদের সাথে সাথে ওর বাবা বা আমি বেড়াতে যাই।
৪. প্রতিবেশীর বাড়িতে কখনোই বাচ্চাদের একা পাঠাই না।
৫. ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মেয়ের জন্য মেয়ে শিক্ষক রেখেছি এবং তার পড়ানোর সময়টা নির্ধারণ করেছি, আমরা বাসায় থাকাকালীন।
৬. বাচ্চারা ছোট হওয়ায় (৮ ও ১০ বছর) চেষ্টা করি তাদের বাসায় নিজেরা পড়াতে। বছর দুই আগে শিক্ষক রেখেছিলাম, ছেলের জন্য ছেলে, মেয়ের জন্য মেয়ে। আর শিক্ষক পড়াতে আসার সময়টা রাখতাম নিজেরা যখন বাসায় থাকতাম সে সময়টা। আর পড়ার সময় মাঝে মাঝেই ওই রুমে যাওয়া-আসা করি।
৭. বাচ্চারা নিচে খেলতে নামলে সাথে নিচে কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখি। একটু পর পর নিজেরা খবর নেই, ওরা কোথায়।
৮. বাচ্চাদের যথাযথ সেক্স এডুকেশন দেবার চেষ্টা করি। নিজেদের প্রাইভেট পার্টস চেনাই, সত্যি কথা বলি। প্রাইভেট পার্টস চেনানোর সাথে সাথে ভালো স্পর্শ আর খারাপ স্পর্শ সম্পর্কে বলি (গুড টাচ/ব্যাড টাচ)। ছেলে মেয়ে উভয় বাচ্চাকেই বলি।
৯. ওদের বিভ্রান্ত করি না। পত্রিকা পড়ে মেয়ে যখন জানতে চায়, মা ধর্ষণ কী? তখন ওর ধারণক্ষমতার মধ্যে বুঝিয়ে দেই।
১০. জুডো-কারাতে শেখাবার সুযোগ করতে পারিনি। একটাই সমস্যা আনা নেওয়া। তাছাড়া ঢাকার বাইরে বা মফস্বলে এসব সুবিধা অপ্রতুল। তবে সুযোগ পেলে ইচ্ছে আছে। আপনাদের সুযোগ থাকলে অনুগ্রহ করে শেখাবেন।
আমার বাচ্চারা অবশ্য জানে যে, কেউ উল্টাপাল্টা বা নোংরা টাচ করলে জোরে চিৎকার করতে হয়, খামচি বা কামড়ও দিতে হয় প্রয়োজনে। বিষয়টা খানিকটা হিংস্র শোনাচ্ছে। কিন্তু আমার আর কোনো বিকল্প জানা নেই, জানলে বলবেন প্লিজ।
১১. বাচ্চাদের আচরণ খেয়াল করি। কখনো গম্ভীর হয়ে থাকলে বা মন মরা হয়ে থাকলে বা বেশি উচ্ছ্বাস দেখালেও।
১২. আমার এক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছে, বাচ্চাদের শরীরে কোনো অযাচিত দাগ দেখলেও খেয়াল করতে। সেটাও করছি এখন থেকে।

এছাড়া আরেকটি বিষয়ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাচ্চাদের সাথে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা উচিত যাতে ওরা দ্বিধাহীনভাবে সব বিষয় আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারে। আমি কর্মজীবী মা হিসেবে আমার সীমাবদ্ধতার কথা জানি তবু আমি চেষ্টা করি বাচ্চাদের সাথে এসব চলতি নেগেটিভ ইস্যুগুলো শেয়ার করতে। জানি না শেষ অবধি ওরা কতটুকু শিক্ষা পাবে বা নিরাপদে থাকবে। তবু চেষ্টা করি। কারণ আমি জানি, আমি চাইলেও মানুষের নোংরামি আর মূল্যবোধ পাল্টাতে পারবো না। তার চেয়ে এই ভালো, ওদের লড়াই করতে শেখাই। ওদের বলতে শেখাই, এসব হয়রানির বিষয় কারো কাছে গোপন করে রাখার বিষয় না।

একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শেষ করছি।

আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে আমার এক বান্ধবী আমাকে কেঁদে কেঁদে বলেছিল, সে বাসায় আসা হুজুরের কাছে পড়তে চায় না কারণ হুজুর প্রতিদিন তার বুকে হাত দেয়। লজ্জায় বাবা-মাকে বলতে পারছিল না ও। তারপরের কিছু মনে নেই আমার। কী হয়েছে, ও কী করেছিল, ওর নাম কী, মনে নেই কিছুই। কিন্তু ওর আতংকটা আমার অন্তরমহল জুড়ে আজো আছে। আমার মেয়ের সাথে আমি এসব শেয়ার করি। এখন আমার মেয়েও আমাকে তার বান্ধবীর গল্প শোনায়। একদিন ওর কাছে শুনি একই গল্প। ওর বান্ধবী ওর কাছে মন খারাপ করে বলেছে, ওর হুজুরটা পচা, ওর গায়ে হাত দেয়। ওর পড়তে ইচ্ছে করে না। আমি মেয়েকে বুঝিয়ে বলেছি, যেন ও (মামণিটার নাম লিখলাম না) ওর বাবা মাকে বিষয়টা জানায় না হয় আমাকে ফোন নম্বর এনে দেয়। পরে আমার মেয়ে জানায় যে ওরা হুজুরটাকে বাদ দিয়েছে।

আমার মেয়ে জানতে চায়, মা তুমি আমার বান্ধবীর গল্পটা লিখেছো? আমি বললাম, হুম মা, আমি তোমার আর আমার দুজনের বান্ধবীর গল্পই লিখেছি। যেই গল্পগুলো এতো বছর পর একই আছে।
খুব ইচ্ছে করে এবার গল্পগুলো বদলে দেই। ওদের শৈশব আলোয় ভরিয়ে দেই। পারি না। তবু চেষ্টা করি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.