ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:
ছেলেবেলা থেকেই আমি খুব উৎসবপ্রেমী। ঈদ, পূজা, বড়দিন, নববর্ষ, জন্মদিন, বিয়ে – ধর্মীয় বা সামাজিক, উপলক্ষ সে যাই হোক না কেন! আনন্দে ভেসে যেতো আমার ছোট্ট হৃদয়।
শবে বরাতের রাতে গোসল সেরে সারারাত নামাজ, রোজার সময় সারাদিন রোজা রেখে বিকেলে আমাদের ছোটদের কাজ ছিল ছোলা, পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ জিলিপি, আম, লিচু জাম আর লেবুর শরবতে ট্রে ভর্তি ইফতারি সাজিয়ে নকশাদার কাপড়ে ঢেকে পাড়া-পড়শির বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসা।
দুই ঈদের মধ্যে কেন যেন রোজার ঈদটাই বেশি ভালো লাগতো। অন্যান্য বাড়ি থেকেও একইভাবে ইফতারি আসতো। চান রাতে ঈদের জামা – জুতো, সাথে ম্যাচ করে কেনা ক্লিপ – চুড়ি – ফিতা মাথার কাছে নিয়ে ঘুমানোর সেকী উত্তেজনা! সারারাত আনন্দে ঘুমই আসতো না। আর টেনশন – নিজের সবচেয়ে প্রিয়, কাছের বন্ধুটাও যেন ঈদের আগে ঘুণাক্ষরে জানতে না পারে কী জামা – জুতো কিনেছি! সে এক রহস্য। দেখলে যে সারপ্রাইজটাই নষ্ট হয়ে যাবে!
ঈদে আমার মা চারপাশের আত্মীয়স্বজন সবাইকে কিছু না কিছু দিতো তাই আমাদের কখনোই অতিরিক্ত জামাকাপড় দেয়া হতো না। জন্মদিনেও অস্বাভাবিক বাড়াবাড়ি কিছু হতো না। আসলে আড়ম্বর কতোটা তা মুখ্য ছিল না, মুখ্য ছিল আনন্দটুকু।
ঈদের দিন ভোরে উঠে নতুন সাবান – শ্যাম্পুতে গোসল, সবার নতুন জামা, সেমাইয়ে ঘন দুধ আর এলাচির ঘ্রাণ, পোলাও এর ওপরে ছিটানো জর্দার কমলা রঙ – সবই বড় আনন্দের ছিল। আত্মীয়- অনাত্মীয় আর দেশি – বিদেশি পারিবারিক বন্ধুদের আগমনে উৎসবমুখর থাকতো বাড়ির পরিবেশ। তাদের মধ্যে অনেকেই ভিন্ন ধর্মানুসারী ছিলেন। কিন্তু উৎসবের আনন্দে শামিল হতে কারো কোনো বাধা বা সংকোচ ছিলো না।
বড়দিনে দেখা যেতো আমরা বিদেশি কোনো পরিবারের বাড়িতে নেমন্তন্ন পেতাম। যশোর আকিজ ট্যানারির কর্মকর্তা যুগোস্লাভিয়ান মিরো সাহেব তার ইথিয়পীয় স্ত্রী মেহরাত আর তাদের পালিত কন্যা জুয়েটাকে নিয়ে মিলের একতলা কাঁচের জানালা ঘেরা চমৎকার বাংলোতে থাকতেন। পোষা হরিণ ছিল ওদের বাড়িতে। আমরা তখন নোয়াপাড়া, যশোরের রাজ টেক্সটাইল মিলের বাংলোতে থাকি। খুব আসা-যাওয়া ছিল দুই পরিবারের। ছোট ছোট মরিচ বাতিতে সাজানো ক্রিসমাস ট্রি, সান্তাক্লস, টার্কিশ রোস্ট, হানি কেক আর সুন্দর গান – ওদের বাড়ির বড়দিনের জমজমাট আয়োজনে সন্ধ্যেটা রূপকথার মতো লেগেছিলো।
এমন উৎসব, অনুষ্ঠান, গানের আসর আমাদের বাড়িতেও সারাবছর লেগে থাকতো। আমার বন্ধুবৎসল, অতিথিপরায়ণ বাবা – মায়ের বদান্যতায় বাড়ির পরবেশ সবসময়ই থাকতো উৎসবমুখর। মায়ের হাতের রান্না, পরিবেশন, ঘর সাজানো, শিল্পকর্ম হাসি – গল্প -গানে সে এক নান্দনিক পরিবেশ, অনন্য সময়। বাবা – মা দুজনেই আসর মাতাতে পারতেন গল্পে গল্পে।
আমার বিয়ের পরে, বাচ্চারা যখন বেশ ছোট, বড়দিনে তাদের বাবা একটা আর্টিফিশিয়াল ক্রিসমাস ট্রি এনে বারান্দায় সাজিয়ে দিলো।মজার ব্যাপার হলো ফ্ল্যাটের একদল বাচ্চা রোজ সন্ধ্যা হলেই বারান্দার সামনে এসে জোরে চেঁচিয়ে বলতো, “আন্টি, লাল-নীল লাইটগুলো জ্বেলে দেন না! “
ওরা কেউ খ্রিষ্টান না, সবাই নিজ নিজ পরিবারে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতো, রঙিন বাতিতে ঝলমল করা সবুজ ক্রিস্টমাস ট্রি ওদের শিশুমনে কেবল নির্মল আনন্দটুকুই জাগাতো।
একবার আমার ছোট মেয়ে দাদুবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার বাড়ির কেয়ারগিভার খ্রিস্টান এক মাসী বড়দিনের ছুটি বাতিল করলো, কেননা তার স্বামী তাকে বলেছিলো, অসুস্থ বাচ্চার পাশে থাকবে এটাই তোমার বড়দিন। সেবার বড়দিনে আমরা মাসীকে গির্জায় নিয়ে গেছি, আমার বাচ্চার সুস্থতা প্রার্থনা করে সে গির্জায় গিয়ে মোমবাতি জ্বেলেছিলো।
আমাদের খুব প্রিয় নেপালি বন্ধু বিশাল। বিশালের সত্যিই “বিশাল” অন্তঃকরণ। আমার বরের সাথে চারুকলায় পড়তো। ওদের বন্ধুত্বের সূত্র ধরে বিশাল ও তার পরিবার আমাদের পারিবারিক বন্ধু। বিশালদের ধর্মীয় পরিচয় ওরা বৌদ্ধ। প্রায়ই ওদের রঙিন সব উৎসব উদযাপনের ছবি দেখি। প্রাণভরে জীবনকে উপভোগ করে ওরা।
আশ্বিনের ঝকঝকে নীল আকাশ, তুলোর মতো সাদা মেঘের আনাগোনা, শিউলি ফুলের ঘ্রাণ প্রকৃতিতে একরাশ স্নিগ্ধতা নিয়ে হাজির হতে না হতেই সরল- শুভ্র কাশফুলেরাও গুচ্ছ বেঁধে দাঁড়িয়ে যায়, জানান দেয় – শরত এসেছে।
শরৎ মানেই তো ঢাকের আওয়াজ, পূজার গন্ধ – দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। দুর্গাপূজা তার ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ছাপিয়ে বাঙালির শারদীয় দুর্গোৎসবে পরিণত হয়েছে সেই কবেই। পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল, প্রতিমা দর্শন, সিঁদুরখেলা, মেলা, নাড়ু, গজা, নিমকি , বাতাসা – উৎসবের রঙে রঙিন আকাশ- বাতাস। বাঙালির প্রাণের উৎসব বলতে তো পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ আর দুর্গাপূজার নামই সবার আগে চলে আসে।
বাবার চাকরি সুবাদে দীর্ঘদিন যশোরে ছিলাম।
মফস্বল শহর, রিকশার ক্রিংক্রিং একটা আওয়াজ সবসময় পাওয়া যেতো। মিনু ভিলা বলে যে বাড়িটায় আমরা থাকতাম তার সামনেই দুটো বাড়িতে হিন্দু পরিবার থাকতো। একটিতে আমার সহপাঠী বিকাশরা থাকতো। বিকাশ আর আমার মেয়েদের বাবা ছোটবেলায় হরিহর আত্মা ছিল। একান্নবর্তী পরিবার ছিল বিকাশদের। আদুরী, আহ্লাদী, পূর্ণিমা – ওদের বাড়ির মেয়েদের সাথে খুব বন্ধুত্ব ছিল আমাদের তিন বোনের। ওদের মায়েদের আমরা কাকী ডাকতাম।
আমাদের পাঁচিলে ওদের হেঁসেলের জানালা ছিল। কাকীদের দেখতাম সারাদিন ঘেমে নেয়ে রান্নাবান্না করতে। সেই সাথে পূজা অর্চনা, এক পাল সন্তান লালনপালন, হাঁস – মুরগি, কবুতর, গরুর দেখভাল করা, সন্ধ্যে হলে তাদেরকে ঘরে তুলে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানো, ধূপ দেয়া – কাজের কোনো শেষ ছিলো না। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আমরা মাঝে-মধ্যে তরকারি, মুুুুরগির ডিম আদানপ্রদান করতাম। ছোট কাকী শুকনো লংকা আর পাঁচ ফোঁড়নে বাগাড় দেয়া ডাল, নিরামিষের সাথে প্রমাণ সাইজের গরম গরম মাছ ভাজা তুলে জানালা দিয়ে ডাক দিতেন আমাদের বোনদের নাম ধরে, “তোমার মারে গিয়ে দাও, কেমন? খেয়ে বলেনে রান্না কিরাম হয়েসে।”
কাঁচা সোনার মতো গায়ের রঙ আর দুর্গা প্রতিমার মতো মুখের গড়ন ছিল ছোট কাকীর। মাটির চুলার ধোঁয়ায়, গরমে সেদ্ধ হয়ে সংসারের কাজের পরে সেই ঘর্মাক্ত মুখে হয়তো কিছুটা ক্লান্তির ছাপ পড়তো, কিন্তু মুখের হাসিটা মলিন হতো না কখনোই।
আদুরী দিদির বিয়ের সময় ওদের বাড়ির সাথে আমাদের বাড়িতেও বিয়ের শামিয়ানা টাঙানো হলো। গভীর রাতে বিয়ের লগ্ন। আমরা সারারাত জাগা, অর্ধেক অতিথি আমাদের বাড়িতে। রাতভর খাওয়াদাওয়া, উৎসব, আনুষ্ঠানিকতা চললো।
আমার বিয়ের পরেও বাচ্চাদের সাথে নিয়ে একবার পূজায় গিয়েছি। সেই একইরকম অকৃত্রিম আতিথেয়তা।
আমার নানী আর মামারা থাকতেন আশ্রম রোডে। নানী ছিলেন উদারচিত্ত, আধুনিক, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সচেতন, বইপ্রেমী একজন মানুষ। আমরা তাকে খুব কাছে না পেলেও মাঝেমধ্যে মনে আছে সংসারের রান্নাবান্না নিপুণ হাতে সেরে আমাদের সাথে নিয়ে আশ্রমে পূজোর মেলায় ছুটতেন। আমার মা মেলায় যাওয়ার জন্য একশো টাকা দিতো, তাতেই অনেক মাটির পুতুল, হাঁড়িপাতিল, নানা রঙের ফলের আকৃতির ব্যাংক, বাঁশি, গজা, বাতাসা, কদমা কেনা যেতো। মাটির বরকনে, মা ও শিশু, ঘাড় নাড়ানো থুত্থুড়ে বুড়ো – বুড়ি, হারমোনিয়াম -তানপুরা – তবলা, খুব প্রিয় ছিলো।
আমার মেয়েদেরও আমি যশোরের বিভিন্ন পূজা মণ্ডপ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বনানী আর পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারের পূজা দেখতে নিয়ে যাই। মেলায় নিয়ে ঘুরি।
আমার বাবা – মায়ের ৪৫ বছরের বন্ধুত্ব শচী আংকেল – আন্টির সাথে। মিশতে গিয়ে কখনও মনে আসেনি কার কী ধর্ম! দুই পরিবারের সব ধরনের অনুষ্ঠানে উভয় পরিবারের উপস্থিতি থাকতো। ছোটবেলায় আন্টির হাতের রান্না অমৃতের মতো লাগতো। দেবী দিদি, সৌমি, ঐশ্বর্য আর আমরা ভাইবোনের মতোই মিশেছি। ওরা সবাই এখন দেশের বাইরে থাকে। কিন্তু দেশে এলেই দেখা হয়। যোগাযোগ হয় নিয়মিত।
স্কুলের অংক শিক্ষক দেবব্রত স্যার সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে এসে পড়াতেন। পূজা মানেই লালপেড়ে শাড়িতে সেজে সবাই মিলে স্যারের বাড়িতে যাওয়া। স্যারের মায়ের হাতে লুচি – নিরামিষ – ডাল আর মিষ্টি ছিল পৃথিবীর মধ্যে সেরা। স্যারের বোনের বিয়েতে দিদিকে আমি সাজিয়েছিলাম। আমার বড়বোন সব তদারকি করেছে, আলপনা আঁকলো আমার বাল্যবন্ধু
( বর্তমানে জীবনসঙ্গী)।
শিল্পী হিরণ্ময় ‘দার বিয়েতেও বৌদিকে আমি সাজিয়েছিলাম। পূজাতে হিরণ’দা, শুভাশিস’দার বাড়িতেও নেমন্তন্ন থাকতো।
আমার শ্বশুরবাড়ি যশোরের বেজপাড়ায়। পুরনো বৃটিশ আমলের বাড়ি। পূজার মাঠের ঠিক উল্টোদিকে। সারাদিন ঢাকের আওয়াজ আর উলুধ্বনি। চারপাশে হিন্দুপাড়া। আমার শ্বশুর একজন নিপাট ভদ্রলোক, সৎ, পরোপকারী ভালো মানুষ। নামাজ পড়েন নিয়মিত। তাঁকে কোনোদিন ঢাকের আওয়াজে বিরক্ত হতে দেখিনি। দিনের বেলা মেলায় ঘোরাঘুরি, পূজা দেখা তো হতোই, সন্ধ্যায় ছাদে উঠলে পূজার মণ্ডপসজ্জা পুরোটাই দেখা যেতো।
আমার বরের শৈশবের আরো বন্ধুরা চিনু (চিন্ময়), মিঠু। চিনুর বাড়িতে পূজায় মাসীমা, দিদিরা কী যত্নআত্তিই না করেছেন! আর চিনুর দাওয়াত থাকতো ঈদে।
মিঠুর মাকে কাকী ডাকলেও আমার বরের সাথে তাঁর মা আর সন্তানের মতো মধুর সম্পর্ক ছিল। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগছিলেন। কাকাও বিছানাধরা ছিলেন। জীবনে অর্থকড়ির মুখ দেখা হলো না পরিবারটার। ভাঙাচোরা একটা থাকার ঘর। বাইরে একটা ছাউনির নিচে রান্নাঘর। সেটুকু সংসার মেজে-ঘষে ঝকঝকে তকতকে রাখতেন কাকী। আমার বর গেলে সামান্য বাজার করে কাকীর কাছেই রোজ দুপুরে ভাত খেতো। আমিও খেয়েছি। পাত পেড়ে পরম মমতায় কাকী খাওয়াতেন। আমাকে ডাকতেন “বৌমা” বলে। কাকীর কাছে গেলে শান্তি লাগতো কেন জানি। মন ভালো হয়ে যেতো। কাকী এ জগৎ-সংসারের মায়া ছেড়ে চলে গেছেন বছর দুয়েক হলো।
মনে পড়ে, একবার পূজায় আমি ঢাকা থেকে একটা সকালসন্ধ্যা পাড়ের শাড়ি কিনে পাঠালাম কাকীকে। ফোনে শুনলাম অষ্টমীর দিন সেই শাড়ি পরে কাকী সেবারে প্রথম প্রতিমা দর্শন করেছেন। জগতে কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দ, মায়া – মমতা, ভালোবাসা যে আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে ! আমরা সেসব খুঁজে নিতে পারি না অনেক সময়।
এসবের মাহাত্ম্য না বুঝে, আমরা কেবল ধর্ম, জাত – পাত, সাদা – কালো, ধনী – দরিদ্র নিয়ে বাছবিচার করি, বিভেদ সৃষ্টি করি। আমরা মানুষ চিনি না, চিনি আস্তিক – নাস্তিক, চিনি ধর্মের লেবাস। উৎসবের আনন্দের মাঝেও আমরা কেবল সাম্প্রদায়িকতার লেবেল লাগিয়ে বেড়াই।
অথচ ধর্ম কী মানবতার শিক্ষা দেয় না? নিশ্চয়ই দেয়। রোহিঙ্গাদের অসহায় পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার প্রবারণায় ফানুস না ওড়ানোর সিদ্ধান্ত তো মানবতার কথাই বলে।
আমি যে ধর্মপথের পথিকই হই না কেন, আমার পরিচয় আমি মানুষ। যার যার ধর্ম পালন করে, অন্যের ধর্মকে, বিশ্বাসে আঘাত না করে শান্তির পৃথিবীতে বাস করতে চাই। উৎসব হোক সম্প্রীতির ও সৌহার্দ্যপূর্ণ।
কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আবদ্ধ থেকে উৎসবের আনন্দ নয় বরং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে উৎসব হোক প্রাণের মিলনমেলা –
স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত এবং সর্বজনীন।
#BeHumaneFirst