শেখ তাসলিমা মুন:
ইউরোপে থাকা আমরা নারীরা কেন ইউরোপের মানবাধিকার থেকে কোন শিক্ষা নিচ্ছি না? আমরা কি সৌদি আরবের আইনে ফেরৎ যাচ্ছি না? আমরা কি আইন বহির্ভূত হত্যার সমান অপরাধ করছি না? লিঙ্গ কর্তন একটি অমানবিক কাজ। তাতে একটি পুরুষের পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শেষমেষ মারাও যেতে পারে। পুরুষরা ধর্ষণ করলে যদি লিঙ্গ কর্তন করা হয়, নারীরা পুরুষদের ধর্ষণ করলে কী কর্তন করা হবে? ধর্ষণ করা পুরুষের লিঙ্গ কাটা অসম্ভব। এগুলো প্রতিশোধ পরায়ণ মহিলারা তাদের প্রেমিক বা স্বামীকে ট্র্যাপ করে ডেকে নিয়ে লিঙ্গ কাটে।
লিঙ্গ কর্তনের বিপক্ষে সোচ্চার বিদগ্ধ আক্রান্ত পুরুষকূল। উপরের স্টেট্মেন্টস তার কিছু সামান্য নমুনা।
সম্প্রতি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধন চলছে। এ নিধন সে দেশের সরকার করছে একটি এথনিক গ্রুপের উপর। যারা গ্রামের সাধারণ মানুষ। এ নিধন ঘটছে ক্ষমতাসীন এবং এস্টাব্লিস্টমেন্ট দ্বারা। এটি রায়ট নয়। দুটি গ্রুপের ভেতর দাঙ্গা নয়। একটি দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনরা সেই দেশেরই একটি জনগোষ্ঠীর উপর সরকারি বাহিনী দ্বারা নিধন অব্যাহত রেখেছে। আর এই আক্রান্তরা পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে জীবন বাঁচানোর জন্য।
একজন ধর্ষণের শিকার নারী বা আক্রমণের সময় সে ব্লেড দিয়ে একজন পুরুষের লিঙ্গ কেটে দিয়েছে। সে মেয়েটি একজন ভিক্টিম। একটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন কেউ নয়। কোনো অথরিটি নয়। কোনো বাহিনী নয়। কোনো সংগঠন নয়। কোনো ফোর্স নয়। তার বিরুদ্ধে কলম কেবল কাওয়ার্ডরা এবং অত্যন্ত দায়িত্বহীন রুচিহীন অসংবেদনশীলেরাই করতে পারে। এমনকি ইনিয়ে বিনিয়ে ‘তাদের আত্মরক্ষার জন্য এটা করতেই পারে, কিন্তু ……’ টাইপের কথা লিখেও এই রাজ কলম ধরার বাগাড়ম্বর অবতারণা করাই যে কতটা লজ্জাকর নির্বুদ্ধিতা সেটা বোঝার বুদ্ধি পর্যন্ত এরা ধারণ করে না।
ইউরোপের উদাহরণ টানারা জানেন না ইউরোপের পুরুষেরা এ বিষয়ে তাদের মতো ইনিয়ে-বিনিয়ে এ কসরত কোনদিন করবে না। বরং ঐ মেয়েটি কীসের ভেতর দিয়ে গেছে সেটি বোঝার চেষ্টা করবে। ঐ মেয়েরা কীসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সেটা বোঝার বিষয়ে সকল দিক ঝালাই করবে।
“ধর্ষণ একটি বাজে ধরনের অপরাধ”, “মেয়েটির অবশ্যই রাইট আছে আত্মরক্ষার” … কিন্তু……এরপর তিন পৃষ্ঠা। বাহরে! আমি তো লিখেছি মেয়েদের রাইট আছে আত্মরক্ষার। পরের তিন পৃষ্ঠা আমি লিখেছি আমি কত জ্ঞানী, কত জানি, কত উত্তরাধুনিক, কত পশ্চিমা অধিকার সচেতন সেটি বয়ান করতে।
দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আমরা ফাঁসি চেয়েছিলাম। আমি ইউরোপে থাকি। যেখানে মৃত্যুদণ্ড বহু আগে তুলে দেওয়া হয়েছে।
আবার কিছু “বাট”, “কিন্তু”দেরও দেখা গিয়েছিল। তারা কে এবং কারা সেটাও আমরা চিনেছিলাম।
যে মেয়েটি ব্লেড দিয়ে লিঙ্গ কর্তন করেছেন, কী ধারণা আপনাদের তার বিষয়ে? তার জীবনের গল্প কিছু জানেন আপনারা? একবারও তার পজিশনে গিয়ে দেখেছেন? এ মেয়েটি তার জীবনব্যাপী কত শত বার এ ধর্ষণের মোকাবেলা করে আসছে অনুমান করতে পারেন? কতবার উত্যক্ত করা হচ্ছে জানেন কি?
তার রাতের ঘুম, দিনের জীবন হারাম করছে চারপাশ থেকে জানেন সেটি? একটি মেয়ে রাতে ঘুমুলে তার দরোজায় কতবার টোকা পড়ে। একা বাঁশের ঘরে ঘুমুলে বেড়া কাটা হয় কতবার জানেন কি?
ছ’তলায় গরমে জানালা খুলে ঘুমিয়েছি। পাইপ বেয়ে উঠে কার্নিশে দাঁড়িয়ে উত্যক্ত হবার শিকার এই আমি। এই জীবন্ত আমি। জানতে চান সেসব? যে মেয়েটি অনবরত এ উত্যক্ততার শিকার, তার কাছে ব্লেড থাকা কি খুব অস্বাভাবিক? একবার কি সে জ্বলে উঠতে পারে না? কী যুক্তি দিচ্ছেন আপনারা? যখন এ মেয়েটির সাথে অনেক মেয়ে তাদের অভিজ্ঞতা-যন্ত্রণা শেয়ার করে, তখন তারা বুঝে এটা কখন সে মেয়েটি করে। আর আপনারা যারা নতুন ইউরোপে এসে ইউরোপের আইন দেখে মুগ্ধ হয়ে এক লাফে ইউরোপিয়ান আইন বিষয়ে ভাষণ দেওয়া শুরু করেন তারা ভুলে যান তারা শত বছর ধরে একটি সিস্টেম গড়ে তুলেছে। তার পেছনে অনেক ইতিহাস আছে। অনেক ফ্যাক্টরস রয়েছে। তারা এচিভ করেছে একশত বছর ধরে। আইনের শাসন তারা বাস্তবায়িত করেছে।
একজন নারী নিরাপত্তাহীন নয়, তবু এখানেও যতটা ধর্ষণ ঘটে তার জন্য নারীদের হাতে এক ধরনের ঘড়ি ব্যবহারের সাজেশন দেওয়া হয়েছে। যাতে তারা ঘড়ির বাটনে টিপ দিতে পারে। যার সাথে পুলিশের সাথে যোগাযোগ হবে। এখানেও স্প্রে ব্যাগে রাখার সাজেশন আছে। মেয়েদের সেলফ ডিফেন্সের অংশ হিসেবে অণ্ডকোষে লাথি মারার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এখানে ৫৫% ক্যাবিনেট মন্ত্রী নারী। বড় বড় অথরিটি চালায় নারী। পুলিশ চিফ নারী। এখানে বিশপ প্রিস্ট নারী। কত বছর ধরে যুদ্ধ করে তারা এ পজিশনে এসেছে। তারা কি একদিনে এসেছে? আমি তো মনে করি যে মেয়ে ব্লেড হাতে ধরেছে, সে একটি সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করেছে। ডঙ্কা বাজিয়ে দিয়েছে বিজয়ের।
একটি সামাজে একজন নারীকে কোনভাবে সহযোগিতা করা হয় না। ধর্ষণের জন্য বরং তাকে দায়ী করা হয়। সেই নারী ব্লেড হাতে নিয়েছে। আপনি সুবিধাজনক অবস্থায় বসে তার ব্যাবহারের ঔচিত্য অনৌচিত্য বোধের চুল ছিড়ছেন। তার উপর না হলেও সেই বিষয়ের গুরুত্ব তুলে ধরে আইন ও মানবাধিকার জারি করে চলেছেন, কতটা দায়িত্বহীন পুরুষ আপনি খেয়াল করে দেখেছেন?
একজন নারী যখন ব্লেড হাতে এগিয়ে আসে, আপনি তাকে আইন দেখান, তার হিম্মতের কদর করার সৎসাহস আপনার নাই। এবং আপনার যেহেতু সে ক্ষমতা নেই, আমি আপনাকে একজন জড়বুদ্ধির স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী সাজার স্থুল পুরুষ ছাড়া কিছুই বলবো না। যারা ধর্ষণকেই প্রকান্তরে সাপোর্ট করছেন। যদি তা নাও করেন, মেয়েদের জেগে ওঠার ক্ষমতাকে প্রতিরোধ করার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করছেন। যে পশ্চিমা মানবাধিকারের উদাহরণ দিচ্ছেন, জানবেন আপনাদের মুঢ়তায় একজন পশ্চিমা পুরুষ লজ্জা পাবে।
মেয়েরা যদি ছেলেদের ধর্ষণ করে মেয়েদের কী কাটা হবে? মানুষ কতটা অর্বাচীন হলে এ প্রশ্ন করতে পারে ভেবে অবাক হয়ে যাই। হায়! জানেন না মেয়েদের যখন ধর্ষণ করা হয় তখন অনেকে ধর্ষণে আনন্দ পাওয়ার জন্য ছুরি দিয়ে যোনি কেটে দেয়! তারপর এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেয়! লোহার শিক ঢুকিয়ে দেয় যৌনাঙ্গে!
যদি কোনদিন একটি আট মাসের শিশুপুত্রকে নারীরা ধর্ষণ করে। যদি ১১ বছরের পুত্রকে ১০ জন নারী একসাথে ধর্ষণ করে, তার পিতামাতা বিচার না পেয়ে ছেলেকে নিয়ে আত্মহত্যা করে, যদি ১৫ বছরের একটি ছেলেকে ১০জন নারী ধর্ষণ করে, অসহায় বাবা বলে, বাবারা আমার ছেলেটা ছোট, তোমরা একজন একজন করে যাও, যেদিন মাকে বেঁধে রেখে তার সামনে পুত্রকে ধরে ২০ জন নারী ধর্ষণ করে হত্যা করে যাবে, যখন দেশ রাষ্ট্র আইন নীরব থাকে সেদিন আমি বলবো, সেই নারীদের যোনি কেটে দাও যারা এতো নৃশংস এবং আইন রাষ্ট্র দেশ আইনপ্রণয়নকারী সংস্থা বিচার বিভাগ তাদেরকেই সাহায্য করে।
মানুষ নীরব। প্রশাসন নীরব। ধর্ম নীরব। সমাজ নীরব। এবং আমরা যারা সুবিধাজনক পজিশনে থাকা নারীরা ইউরোপের একশ বছর ধরে গড়া সিস্টেমের এক টুকরো ক্রিম খেয়ে ইউরোপের মানবাধিকার ‘ধর্ষিত পুরুষের’ বিপক্ষে ছবক হিসেবে ব্যবহার করবো, তখন কথা দিচ্ছি, নিশ্চয়ই নারীর যোনি কাটার আন্দোলনে অংশ নেব। ঘুমন্ত বিবেককে জানান দিতে বলবো যে দেখো, যেখানে বিচারের বাণী নীরবে কাঁদছে, সেখানে ঐ ‘ধর্ষক নারীর’ শাস্তি দিতে আমরা ‘ভিক্টিম পুরুষ’ই যথেষ্ট।
নষ্ট দেশ, নষ্ট রাজনীতি, নষ্ট ধর্ম, নষ্ট সমাজ, নষ্ট আইন অবিচারের জন্য এ মেসেজ অত্যন্ত জরুরি।
তার আগে এই আপনারা যারা সুবিধাজনক পজিশনে থেকে একটি ভিক্টিম নারীর বিরুদ্ধে আইনি এবং মানবাধিকারের কলম ধরেছেন, তাদের প্রতি করুণা! লজ্জা রাখার জায়গা পাই না জ্ঞানের এই অপ্রয়োজনীয় মাত্রারিক্ত ডায়রিয়ায়। তাদের জন্য বীমার সাজেশন দিয়েছি আগে একবার। এবার বলবো, এক লিটার পানিতে এক মুঠ গুড় ও এক চিমটি লবণ।