মেয়েটি যখন ‘শিক্ষিত’ হলো!

নাহিদ খান:

আলেয়া, মা মরিয়ম যাকে আদর করে ডাকেন আলো, গ্রামের অন্য বাচ্চাদের চেয়ে একটু বোধহয় বেশি দুরন্ত ছিল। গাছে ওঠা, নদীতে ঝাঁপানো, মাঠে খাবার নিয়ে যাওয়া, এইগুলো বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রামের ছেলেমেয়েরা করে। আলো আরেকটু বেশি করতো, গরুর পিঠে ওঠার চেষ্টা করতো, মাছ ধরতে যেতে চাইতো।

বিধবা মরিয়মের একটাই স্বপ্ন, মেয়েকে শিক্ষিত বানাবেন, খুব শখ করে মেয়েকে স্কুলে পাঠালেন। দুরন্তপনার ইতি টেনে বই-খাতা নিয়ে আলো প্রতিদিন স্কুলে যায়, দেখে মা’র চোখ জুড়িয়ে যায়।
বাড়িতে থেকেই মাধ্যমিক পাশ করে ফেললো আলো, উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য তাকে শহরে পাঠালেন মা। পুরো গ্রামের জন্য অভিনব ব্যাপার ছিল সেটা।

শহরের কলেজে পড়তে গিয়ে আলো প্রথমবারের মতো নিজের পরিবারে ‘আদব-লেহাজ’ আমদানি করলো… ছুটিতে বাড়ি এসে উঠানে ধান মাড়াইরত মা’কে সে বললো- ছি: মা তোমার পিঠ দেখা যায়…
আলোর মা যারপরনাই বিস্মিত হলেন, এই জাতীয় কথা জীবনে প্রথম শুনছেন তিনি… ধানের মরশুম, দম ফেলার সুযোগ নেই, পিঠ দেখা যায় সেটা খেয়াল করার অবকাশ আছে? আর পিঠ দেখা গেলেই বা কী! গ্রামের বউ-ঝিরা তো আজন্ম এইভাবেই কাজ করেছে!

উচ্চ মাধ্যমিক ডিঙিয়ে আলো বিএ তে ভর্তি হয়, এমন আশ্চর্য ঘটনাও এই গ্রামে প্রথম। বিএ তে ভর্তি হয়ে আলো আজন্মের চেনা গ্রামে আসে একটা বিরাট ওড়না গায়ে জড়িয়ে। আলো জানায়, মা আমার এক রুমমেট আপা আছে, উনি আমার জীবন পালটে দিয়েছেন। তুমি আমাকে ঠিক মতো ধর্মশিক্ষা দাওনি, এর জবাব তোমাকে আখেরাতে দিতে হবে। আর তুমি এই যে পুরুষ মানুষদের সাথে কাজ করো এইগুলো ঠিক না!

মরিয়ম আমতা আমতা করেন, আমি নিজে তো বেশি জানি নারে মা, যেটুকু জানি শিখাইছি, মানুষরে সম্মান করতে শিখাইছি, অন্যায় না করতে শিখাইছি… আর গেরস্থালী কাজ যাদের লগে করি ওরা পুরুষ মানুষ কীরে, ওরা তোর চাচা,ভাই বেরাদর, আমার ভাইয়ের লাহান, পোলার লাহান, আমারে কতো সম্মান করে। তুই বাড়াবাড়ি করতেছিস রে আলো!
আলো মুখ ঝামটা দিয়ে বলে -মা আলো আলো করো নাতো, নামটা ঠিকমতো ডাকো- আলিয়া!

মরিয়ম প্রতিবাদ করে বলেন- এই গ্রামের প্রথম বিএ পাশ মেয়ে তুই, তোরে আলো ডাকলেই বেশি মানায়…
আলো গর্জে উঠে- এই গ্রামে আসতে আমার লজ্জা লাগে! মেয়েগুলো বেপর্দা ঘুরে বেড়ায়, বাড়িগুলোর বাইরে দেয়াল নাই, কোনো পর্দা নাই, নোকায় ছই নাই…

বিএ পাশ আলো বিয়ে করে ‘আবদুর রশিদ’ কে, ওর সেই রুমমেটের ঘটকালিতে। শ্বশুরবাড়ির পরিবার ভীষণ ধার্মিক, পর্দানশীন। নিজের মা আর গ্রাম নিয়ে আলো’র খুব গ্লানিবোধ হয়। গ্রামের সঙ্গে তার কিছুটা দূরত্বও তৈরি হয়। কিন্তু দুই মেয়ের জন্মের পর সেই দূরত্ব কমতে শুরু করে, মরিয়ম গায়ে পড়ে হাজির হতে থাকেন নাতনিদের টানে। আলোও বছরে-দুবছরে একবার আসে গ্রামে, মেয়েদের খুব আগলে রাখে। এই গ্রামের বেহায়া মেয়েদের আর মূর্খ মা-বাপদের দেখে আলেয়া প্রচণ্ড বিরক্ত হয়।

একবার তিন বছর পর নানাবাড়ির গ্রামে আসে আলোর মেয়েরা, নয় বছরের ফাতিমা আর সাত বছরের জান্নাত। আনন্দে দিশেহারা দুই শিশু নানীর সাথে নদীতে যায়, তারপর আব্দার করে নৌকা চড়বে। মরিয়ম একটা ছেলেকে ডেকে নৌকা জোগাড় করান, বলেন আমার নাতনিদের একটু ঘুরায়ে আনতো, আমি ঘাটে বইসা আছি, বেশি দূর যাইস না…
সাত বছরের জান্নাত শাপলা দেখে সেটা নিতে চায়, মাঝি ছেলেটি সাবধান করে- নইড়ো না, সোজা হয়্যা বইসে থাকো, নৌকা উল্টাইবো! জান্নাত তবু ঝুঁকে শাপলা ধরতে যায় আর নৌকা যায় উল্টে…

মরিয়ম ঘাট থেকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করেন, আশেপাশে থেকে অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাচ্চা দুটিকে তুলে আনা হয়। জান্নাতের জামা ছিঁড়ে গেছে, ফাতিমার ওড়না ভেসে গেছে, সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, বাচ্চা দুটোর কিছু হয়নি, জান্নাত বলে আমার শাপলা, সবাই হাসে ‘অখনও শাপলা?’…
এমন সময় এসে হাজির হয় আলো, কোনো কথা না বলে মেয়েদের হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়। মরিয়মও ছুটেন পিছু পিছু, আলো মারিস না ওগো, সব আমার দোষ…

আলো মেয়ে দুটোকে একটা ঘরে আটকে দরজায় একটা তালা খুঁজে এনে লাগিয়ে দেয়, ঘোষণা দেয় – আমরা কাল চলে যাবো, তার আগে কেউ যদি এই দরজা খুলে সেটা ভালো হবে না। আমার মেয়েদের ভেজা শরীরে পুরো গ্রামের মানুষ দেখছে তোমার জন্য, ওদের আব্বা শুনলে আমাকে আস্ত রাখবে না, তুমি এসবের কী বুঝবা, নিজের জীবন কাটিয়ে দিছো বেহায়াপনা করে……
এরপরের বাক্যগুলো মরিয়মের আর কানে ঢোকে না…

নাতনিদের জন্য মরিয়ম পিঠা বানানোর আয়োজন করেছিলেন সেদিন বিকেলে, ফাতিমার প্রিয় তালের পিঠা আর জান্নাতের প্রিয় পুলি পিঠা। রান্নাঘর থেকে পিঠার ম ম গন্ধ আসে, বারান্দার অন্ধকারে ঝিম ধরে বসে থাকা মরিয়ম জীবনে প্রথমবারের মতো আফসোস করেন- ‘আলো রে আমি ক্যান শিক্ষিত বানাইতে চাইছিলাম’…………

শেয়ার করুন: