তানিয়া মোর্শেদ:
মানুষের জীবন ডিজিটাল নয়। সব প্রশ্নের উত্তর কেবল “হ্যাঁ” বা “না” দিয়ে হয় না। জিরো এবং ওয়ানের মাঝে অসংখ্য নাম্বার আছে। সেরকম কেবল ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ এর মাঝেও অনেক কথা আছে।
আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, খুনের অপরাধ হিসাবে ফাঁসিতে বিশ্বাস করি কিনা? আমার উত্তর হ্যাঁ এবং না দুটোই হবে। কীভাবে বা কেন? খুন চূড়ান্ত অপরাধ হলেও সব খুন বা সব খুনি এক নয়। আজকের লেখার বিষয় যেহেতু খুন নয়, তাই অতি সংক্ষেপে বলি, চূড়ান্ত যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী বা কাদের মোল্লা বা এধরনের কেউ আর ঐশীকে এক পাল্লায় আমি দেখি না। প্রথম দু’জনের ফাঁসির দাবি আমি করেছি। ঐশীর জন্যে নয়।
অনেক বৎসর আগে Dead man walking নামে একটি মুভি দেখেছিলাম। একজন খুনি ও ধর্ষক ফাঁসির অপেক্ষায়। সে একজন নানকে চিঠি লিখে যোগাযোগ করে ফাঁসির আদেশ কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের জন্য চেষ্টা করাতে রাজী করায়। সেই নান অনেক চেষ্টা করেন। শেষপর্যন্ত সফল হোন না। খুনি ফাঁসির আগ দিয়ে ভিক্টিমদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চায়।
মুভিটা দেখার পর অনেক ভেবেছি। বুঝেছি কেন এদেশে একজন অপরাধীর অপরাধ শতভাগ প্রমাণ না হলে শাস্তি হয় না। বলা হয়, ভুল করে (প্রমাণের অভাবে) অপরাধী ছাড়া পাক, কিন্তু ভুল করেও যেন একজন নিরীহ মানুষ শাস্তি না পায়। যদিও বাস্তবে দেখা গেছে, ভুল করে বেশকিছু মানুষ সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এনিয়ে বেশ কিছু খবর, মুভি আছে।
ধর্ষণ খুনের মতোই চূড়ান্ত অপরাধ। যদিও ধর্ষণের সাজা সব দেশে এক নয়। খুনের সাজাও সব দেশে এক নয়। ধর্ষণ প্রমাণ করা এতোটাই কঠিন হয় অনেক সময় যে, অনেক ধর্ষক আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। বলা হয়, একজন ধর্ষণের শিকার নারী আদালতে বারে বারে ধর্ষিত হয়। মানে এমন এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় তাকে বারে বারে সেই চূড়ান্ত অপরাধের যে, সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে সে মানসিকভাবে বারে বারে ধর্ষিত হয়।
আর যে দেশ, সমাজ ধর্ষণের শিকার নারীর দিকে আঙ্গুল তোলে, একঘরে করে, অনেক সময় পরিবারও ত্যাগ করে, ধর্ষণ প্রমাণ নাহলে উলটো শাস্তি জোটে (শরিয়া আইনের কথা বলছি), অনার কিলিং হয় পরিবারেরই সদস্যদের হাতে, সে সমাজে সেই নারীদের অনেক বড় মানসিক জোর লাগে ধর্ষণের রিপোর্ট করতে।
পৃথিবীতে কি কখনোই ধর্ষণের মিথ্যে রিপোর্ট হয় না? হয়। হয় বা হতে পারে বলেই ধর্ষণ প্রমাণ করতে হয়, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অমানবিক পন্থা মনে হবে। কিন্তু কেউ যেন কোনো নিরীহ মানুষকে ধর্ষণের অপরাধে না ফাঁসাতে পারে সেজন্য আইন এতো কঠিন। এক্ষেত্রে মনে হবে আইন যেন ধর্ষকের পক্ষেই বেশি মানবতা দেখায়! ধর্ষণের মিথ্যে রিপোর্ট কোটিতে ক’টা হয়? যেখানে সত্যিকারের ধর্ষণ প্রমাণ করাই অনেক কঠিন অনেক সময়, সেখানে চূড়ান্ত ক্ষমতাবান ছাড়া কতজন মিথ্যে রিপোর্ট করে? বিশেষত যে সমাজ, রাষ্ট্রে ধর্ষণ নিয়ে কথা বলা ট্যাবু, ধর্ষণকে “সম্ভ্রমহানি” বলে থাকেন ৯৯% নাগরিক!
হ্যাঁ একজন পুরুষকে মিথ্যে ফাঁসাতে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে ধর্ষণের অভিযোগ আনা। কিন্তু বাস্তবে তা কতটা সম্ভব, কার পক্ষে সম্ভব, কোন সমাজ বা রাষ্ট্রে কতটা সম্ভব, তাও ভাবতে হবে। ভাবতে হবে সত্যিকারের ধর্ষণের শিকার নারী/পুরুষের জীবন কেমন হয় ধর্ষণের খবর প্রকাশের পর! অপরাধী শাস্তি পাক বা না পাক। এব্যাপারে সবচেয়ে বড় উদাহরণ ১৯৭১-এ ধর্ষণের শিকার ২~৪ লক্ষ নারী। পরিবার, সমাজ তাঁদের আস্তাকুঁড়েতে নিক্ষেপ করেছে। ইতিহাসেও ঠাঁই হয়নি। অশিক্ষিত থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবীরাও “সম্ভ্রম হারানো” বলেন যাঁদের!
আর ধর্ষণের বর্ণনা পড়া বা দেখার মতো মানসিক শক্তি আমার নেই। তাই আজও অনেক ঐতিহাসিক দলিল পড়িনি, পড়িনি “আমি বীরাঙ্গনা বলছি” এধরনের বই। একবার ১৯৭১-এর কিছু ধর্ষিতার কিছু কথা পড়ে আমি অসুস্থ বোধ করছিলাম। তারপর থেকে আর পড়ি না। ভাবি, পড়তেই যদি এমন লাগে, তাহলে সেই সব মানুষদের কী অবস্থা! হাজার কাউন্সেলিংও কি পারে তাঁদের স্বাভাবিক করতে?!
ছোট্ট মেয়ে পূজা থেকে শুরু করে রূপা, তনু, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ নারী-শিশু-কিশোর এবং অনেক পুরুষও ধর্ষণের শিকার পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে। তাঁরা যদি নিজেকে রক্ষার জন্য ধর্ষককে খুনও করেন, করতেন, তাতে আমি বা আমরা কথা বলার কে? নিজেকে বা কাউকে রক্ষা করার জন্য কেউ খুন করলে তা ঠাণ্ডা মাথার খুনির সাথে এক করবে কে?
ধর্ষণ ঠেকাতে কেউ যদি ধর্ষকের সবচেয়ে বড় অস্ত্র লিংগটিই আঘাত করে, কেটে দেয়, তা নিয়ে কথা বলার আমি কে? আত্মরক্ষার জন্য খুন পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে, লিঙ্গহানি হতে পারে না? ধর্ষণের শিকার নারী/পুরুষকে মনে রাখতে হবে, পরবর্তীতে ধর্ষকের জীবন কতোটা কঠিন হবে, এটা? যেকোনো আত্মরক্ষার ক্লাসে শেখানো হয় আক্রমণকারীকে ঠেকানো, যেসব স্থানে আঘাত করলে কাবু করা সহজ, তাও শেখানো হয়। এখন একজন নারী যদি ধর্ষণের সময় নিজেকে রক্ষার জন্য ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে দেন, তাঁকে মানবিকতার জ্ঞান দেবার আমি কে? আমি, সমাজ, রাষ্ট্র কি তাঁর জীবন সম্পূর্ণ বদলে যাবার দায় নেবো? না মানসিক, শারীরিক কষ্টের ভাগ নেবো?
ধর্ষণকে কেবল যৌনতা বলে যারা ভাবেন তাদের জানার, ভাবার আছে অনেক কিছু। এটা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিকতার চরম প্রকাশ, ক্ষমতার চরম প্রকাশ, কাউকে মানুষের মর্যাদা না দেবার চরম প্রকাশ। চেনা কি অচেনা কারো কাছ থেকে একটি চড়ও কি মানুষ হজম করতে পারে? সেখানে কাউকে জোর করে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে, হিংস্রভাবে আক্রমণের কথা ভাবতে পারা যায়?
লিঙ্গ কর্তনের খবর পড়ে যারা সেই পুরুষটির ভবিষ্যৎ কষ্টের কথা ভাবছেন, বলছেন, তাঁদের অনুরোধ করবো ধর্ষণের শিকার কাউকে দেখে আসুন ধর্ষণের ঠিক পরপর, ভবিষ্যতেও তাঁদের সাথে যোগাযোগ রাখুন। কিছু কিছু দেশ কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশনের অনুমতি দেয়। অপরাধী যদি সাজা কমিয়ে নিতে চায়। মানে কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন (হরমোনাল) করে জেলের সময় কমানো। ইউএসএ-র আটটি প্রদেশে আছে এই অপশন। টেক্সাসে কেমিক্যাল বাদেও সার্জারির অপশনও আছে।
ইউরোপের চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, সুইডেন, স্পেনে আছে কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন। তবে কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন কতটা কাজ করে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ইন্টারনেট থেকে আজকেই এসব জানলাম। জানলাম, শরিয়া আইন ক্যাস্ট্রেশন অনুমোদন করে না। চুরির অপরাধে হাত কাটা যায় যে আইনে, সেখানে এটার অনুমোদন নেই!
ভাবছি, কেন? না, আমি একবারও বলিনি ধর্ষণের শাস্তি হোক ক্যাস্ট্রেশন। কেবল বলেছি, আত্মরক্ষার জন্য কেউ যদি ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে দেয়, সেই ভিক্টিমকে মানবতা শেখানোর আমি কে? ধর্ষণ, খুন এবং কোন অপরাধই যেন না ঘটে এমন সমাজের স্বপ্ন দেখি আমি সারা জীবন। হ্যাঁ আমি জানি, আমি ইউটোপিয়ান সমাজের কথা ভাবি। ভাবনার সামান্যও পূরণ হলে মানুষেরই জয়। তবে ভেবে কিছুই হবে না, কাজ যদি না করি কিছু।
রাষ্ট্র কেন ধর্ষকদের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ, আইনের কেন প্রয়োগ নেই, ধর্ষণ কেন একটি সমাজ-রাষ্ট্রে মহামারির আকার নেয়, গোঁড়া সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম কেন ধর্ষণের শিকারের পাশে থাকে না, কেন তাঁদের জীবন আরও দুর্বিষহ করে, নারীর প্রতি বিদ্বেষ কেন সমাজে-ধর্মে-পরিবারে, ধর্ষণের মতো চূড়ান্ত অপরাধ নিয়ে কথা বলা কেন ট্যাবু এখনও, কেন এখনও একজন নারীকে (যে কেউ) সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে ধর্ষণ করা হয়, কেন এতো এতো মানুষ ধর্ষক বা ধর্ষকমনস্ক হচ্ছে, নিজে ও নিজের পরিবারের সবাইকে ধর্ষণকে খুনের মতোই চূড়ান্ত অপরাধ হিসাবে শিক্ষা দেওয়া ইত্যাদি প্রশ্ন করা, ভাবা, পথ খোঁজায় নিয়োজিত করি। নিজের এবং নিজের পরিবার থেকেই শুরু হোক।