আসমা খুশবু:
ধর্ষণের অভয়ারণ্য বাংলাদেশ। আট মাস বয়সী শিশুকন্যা থেকে আশি বছরের বৃদ্ধ নারী কেউ নিরাপদে নেই। একটির পর একটি ধর্ষণের ঘটনা দেশে ঘটে যাচ্ছে, কয়েকদিন সেসব নিয়ে লেখালেখি, প্রতিবাদ, আবার সব আগের মতো, নতুন ধর্ষণের অপেক্ষা। আর নতুন ধর্ষণ আরও নৃশংসভাবে চমকে দেয় মানুষকে। তনু, আফসানা, পূজা, রুপা……এমন নামের শেষ নেই। চলছে বিরামহীনভাবে এই মহোৎসব।
মানবতাবাদীরা প্রশ্ন তুলেছেন ধর্ষিত আত্নরক্ষার্থে যদি ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন করে তবে নাকি মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে! একজন ডাক্তার তার ডাক্তারি জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছেন তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে। তিনি বলেছেন, ‘তাঁর ডাক্তারী জীবনে একটি কেইস পেয়েছিলেন যেখানে একজন ধর্ষক ধর্ষণ করতে গিয়ে তাঁর যৌনাঙ্গটি ক্ষতবিক্ষত করে নিয়ে এসেছিলেন। ভিক্টিম নারীটি ধর্ষকের পুরুষ যৌনাঙ্গটি সম্পূর্ণ কর্তন করতে পারেননি। কিন্তু হাসপাতালে দেরী করে আসার কারণে অধ্যাপক তাঁর অর্ধকর্তিত যৌনাঙ্গটি মেরামত করতে পারেননি। কেটে ফেলতে হয়েছিলো তাঁর পুরুষাঙ্গটির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ।
যারা ডাক্তার নন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার চাইতে একজন মানুষের মৃত্যু হওয়াও ভালো। কেননা, এটা শুধুমাত্র পুরুষের যৌনতা হারানো নয়, এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কাজ মুত্র ত্যাগ এর সাথে জড়িত। স্বাভাবিক মুত্র ত্যাগের ব্যাঘাত ঘটলে একজন মানুষ মারাও যেতে পারেন। তাঁর চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে এই ধরনের রিপেয়ার বা মেরামতের পরে রোগীকে প্রায় প্রতিমাসেই হাসপাতালে হাজিরা দিতে হয় তাঁর মুত্রনালীকে সচল রাখার জন্য এবং এই কাজটি তাকে প্রায় সারাজীবন করতে হয়’। তিনি আরও বলেছেন,’এর পেছনে টাকা খরচ আছে, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট আছে। এটা অমানবিক। এটা ভীষণ অমানবিক’।যা হোক ডাক্তার সাহেব তাঁর ডাক্তারি জীবনে আধা কর্তিত লিঙ্গের ধর্ষক দেখেছেন কিন্তু ছিন্নভিন্ন যৌনাঙ্গের ধর্ষিত দেখেননি এটা কিভাবে সম্ভব! ধরে যদি নেইও তিনি দেখেননি কিন্তু একজন ধর্ষকের কাটা যৌনাঙ্গের জন্য তাঁর যে অনুভূতি তা কিভাবে ক্ষতবিক্ষত যৌনাঙ্গের অধিকারী ধর্ষিতের কষ্টের অনুভুতির চেয়ে বেশি হয় সেটা ভাববার। তাহলে কি মানবতা বোধে পরিপূর্ণ, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা ভেতরে ভেতরে একজন পুরুষ! যারা কিনা ধর্ষককে নিজেদের গোত্রেরই মনে করে সমবেদনা অনুভব করেন!
আরেকজন মানবতাকর্মীর স্ট্যাটাসে দেখলাম, ধর্ষণের আগেই যদি ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে ফেলা হয়, তাহলে আদালতে কিভাবে প্রমান করবে আদৌ ধর্ষণ হয়েছিল কিনা, অথবা তার ধর্ষণের উদ্দেশ্য ছিল কিনা? এর উত্তর অনেকই দিয়েছেন। তবুও বলতে হচ্ছে, একজন মেয়ে কি তবে ধর্ষিত হবার জন্য অপেক্ষা করবে, অথবা ধর্ষক চাইলেই ধর্ষিত হয়ে তবেই আদালতে যাবে? একজন ধর্ষক পুরুষের লিঙ্গ ধর্ষণের উদ্দেশ্য ছাড়া আর কোনভাবে মেয়েটি কাটার জন্য তার নাগালে পেতে পারে? আক্রমণ না করলে সে কেনই বা লিঙ্গ কাটার মতো একটা ভয়াবহ কাজ করতে যাবে, আর আক্রমন করলে তার চিহ্ন তো মেয়েটির শরীরে থাকবেই, সেটি আদালতে প্রমান করা নিশ্চয়ই কঠিন হবে না। আর আইন তো আছেই, ভিকটিম আত্নরক্ষার্থে কাউকে খুন করলেও আইন তার পক্ষে থাকবে। সেক্ষেত্রে মানবাধিকারকর্মীদের ধর্ষকের লিঙ্গ রক্ষার এই আন্দোলন, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’, অনেকটা এমন নয় কি?
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু আছে তাতে কোনো মেয়েই নিরাপদ না। সেক্ষেত্রে প্রতিটা মেয়েরই উচিত সাথে ব্লেড রাখা। কয়েকজন ধর্ষকের লিঙ্গ কাটা পরলে ধর্ষক সমাজ একটু হলেও নড়েচড়ে বসবে। ভিকটিম মেয়েটির যৌনাঙ্গের মূল্য যে ধর্ষকের লিঙ্গের চেয়ে বেশি, এই বোধ এই সমাজে তৈরি হবে তখন। আর কয়েকটি লিঙ্গ কাটা পড়লেই এটা আইন হয়ে উঠবে এই ভাবনা বড় ভুল ভাবনা। কোনো নারী এমন আইন চেয়ে রাস্তায়ও নামেনি।
বরং ধর্ষকদের বিচার চেয়ে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের আবেদন জানিয়ে কয়েকজন নারীবাদী রাস্তায় নেমেছিল, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই আন্দোলনে হাতেগোনা কয়েকজন পুরুষ ছাড়া আর কোনো পুরুষই অংশ নেয়নি। বিষয়টা মনেহয় শুধু মেয়েদের সমস্যা। পুরুষদের ঘরের মেয়ে, বোন, বউ, মা এরা আক্রান্ত হয়না এই সমস্যায়, তাইতো তারা ধর্ষণের বিচারে নারীদের পাশে থাকার চেয়ে ধর্ষকের লিঙ্গ রক্ষার আন্দোলন করাটা উপযুক্ত মনে করেছে।
এখন বলুন তো সমাধান কী তবে? যতদিন না মানুষ সুশিক্ষিত ও মানবিক হয়ে মানবাধিকার রক্ষাকারী আইনের সুশাসন সম্পন্ন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারবে, ততোদিন নারীরা ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচার জন্য কী উপায় অবলম্বন করবে? তাদের ধর্ষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে আত্মরক্ষামূলক ব্যাবস্থা কেমন হতে পারে? উপায় কী? নাকি ততোদিন পর্যন্ত নারীদের ধর্ষিত হয়ে যেতে হবে?