‘আমি তো এ জীবনেরই দিদি’

শেখ তাসলিমা মুন:

ছোটবেলায় আমি আমার মাকে লুকিয়ে ভর দুপুরে টো টো করে বেড়াতাম। ধরা পড়ে মাঝে মধ্যে বেদম মারও খেতাম। মারের চোটে কদিন বিছানায় পড়ে থাকাও স্বাভাবিক ছিল আমার জন্য। তবে টোটো করে ঘুরতাম এমন জায়গায় সেগুলো ছিল আরও নিষিদ্ধ। একটি জায়গা ছিল ভিখারি বুড়ির কলাপাতার ছাপড়া। আমি ভিতরে গিয়ে বসতাম। বুড়ি বলতো, ‘ও মনি তুমি যে এইখানে আইছ তা কি তুমার মা জানে? তুমার মা জানতি পারলি কিন্তু মারবেনে বুন্ডি’! আমি কুড়ে ঘরটিতে ঘোর লাগা মানুষের মতো বসে থাকতাম। আলো ছায়া খেলে যেতো। নীচের দিকে নেমে একটি জায়গায় মাটি খুঁড়ে চুলো করে বুড়ি রান্না করছে। আমি গিয়ে খুন্তি নাড়ছি।

আর একটি নিষিদ্ধ জায়গা ছিল। মন্দিরে ঘুরা। হা করে মূর্তি দেখা। প্রতিটি ডিটেইল আমি মুখস্ত করে ফেলতাম। প্রতিমা দেখে আমার বিস্ময় কাটতোনা কিছুতেই। মুখগুলো মানুষের মত আবার ঠিক মানুষের মত নয়। সৌন্দর্য এবং ভীতি এক সাথে এসে ভর করতো। কাছের এবং দূরের কোন এক রহস্য ঘিরে থাকতো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার তদেরকে জীবন্ত মনে হতো। কেমন ভয় ভয় করতো তখন।

আমার আর একটি কাজের ভেতর ছিল পুরোহিত কী করে তা নিরীক্ষা করা। কখন ফুল, কখন জল, কখন পাতা, কখন দুধ ঢেলে দিচ্ছে, ঘণ্টা বাজাচ্ছে, মন্ত্র পড়ছে আমার মুখস্ত হয়ে যেতো। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতাম। বুঝতে শেখার পর সমস্ত বিষয়টির ভেতর একটি অর্থহীনতা দেখে হেসেছি। কিন্তু সমস্ত বিষয়ের ভেতরে যে একটি ভক্তি এবং সৌন্দর্য আছে তাকে অস্বীকার করতে পারিনি আমি। আমার জল হাওয়ার সাথে মিশে যেতো। আমি বিড়বিড় করে মন্ত্রগুলো বলতাম। আমি মন্ত্রগুলো মুখস্ত বলতে পারতাম। স্কুলে অনেক শ্লোক বলতাম। স্কুলে কোন অনুষ্ঠানে কুরআন তেলয়াত করার পর গীতা পাঠের পর্ব আসলে অনেক সময় মুখস্ত আছে এমন কাউকে না পাওয়া গেলে আমি গীতা পাঠ করেছি অনেকবার।

একবার মামাবাড়ী বেড়াতে গেলে একটি বিয়ে দেখতে যাই। গিয়ে দেখি খুবই খারাপ অবস্থা। মেয়েটির মা বাবা নেই। কয়েকটা ভাই শুধু। দরিদ্র। বাড়িতে কোন আয়োজন নেই। বিয়ের কনেকে কেউ সাজায়নি। একটি বাদ্যকার গ্রুপ আনা হয়েছে কিন্তু তারা ফাঁকি দিয়ে বসে গপ্প গুজব করছে। উঠোনেও বিয়ের কোন আয়োজন নেই। হিন্দু সনাতন নিম্ন বর্ণের বাবা মা মরা মেয়েটির বিয়েতে পাড়াপড়শিও এগিয়ে আসেনি। কলা গাছ পুঁতে বিবাহ আসর বানায়নি কেউ। সেদিন এক হাতে মেয়েটির বিয়ের সব কাজ আমি করেছিলাম। মেয়েটিকে স্নান করানো। শাড়ি পরানো। চন্দনচর্চিত করা। সকল আচার আচরণ ভুলভাল করে করে বাড়টিকে বিয়েবাড়ির উপযোগী করেছিলাম। মেয়েটির ভাইরা আমাকে বলেছিল, তুমি আমাদের আগের জন্মের দিদি। আমি বলেছিলাম, আমি এ জন্মেরই দিদি।

কলকাতার দুর্গাপুজোতে মুসলিম পুরহিতের গল্প দেখলাম ফেসবুকে খুব ঘুরছে। বিভেদের বেড়া অতিক্রম করতে কিছু পাগলামি দরকার। সে পাগলামিগুলোর আজ খুব অভাব। অনিয়মের নিয়মগুলো প্রবর্তিত হওয়া দরকার। আর নিয়মের বিষগুলো উপড়ে দেওয়া দরকার। খুব দরকার। সেগুলো ক্রমশ বেহাত হয়ে যাচ্ছে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.