মানবতাবাদী যখন ধর্ষকের লিঙ্গের হেফাজতকারী!

শাশ্বতী বিপ্লব:

এতোদিন নারীর পোশাক, চলন-বলন, ঘরের বাইরে বের হওয়া ইত্যাদির ওপর দিয়ে গেছে। কিন্তু এবার যুৎমতো একখান অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। ধর্ষণের শিকার বা ধর্ষণের উদ্দেশ্যে আক্রান্ত নারীর মানবিকতা বোধ (!) নিয়া প্রশ্ন তুলেছেন কিছু মানবতাবাদী। এতোদিন আর যাই হোক নারীর বেয়াদবি সহ্য করে নিয়েছিলেন উনারা কোনরকমে। কিন্তু এবার কোমল (!) নারীর হাতে অস্ত্র (!) দেখে বিশ্বমানবতা ধুলায় লুন্ঠিত হয়ে গেছে।

ঘটনা সামান্যই। গাজীপুরের কালীগঞ্জে সনাতন ধর্মের এক নারীকে (৪০) ধর্ষণের চেষ্টা করায় তিন সন্তানের জনক অলিউল্লাহ (৪৫) নামের স্থানীয় যুবদল নেতার পুরুষাঙ্গ কেটে দিয়েছে ওই নারী।

তো, এই কাণ্ড দেখে কতিপয় মানবতাবাদীর ত্রাহি মধুসূূদন অবস্থা। মানবতাবাদীদের চোখে এই নারী মহা পাতকি হয়েছেন। এক ডাক্তার সাহেব বলেছেন, ওই বিশেষ অঙ্গখানি না থাকলে পুরুষের মূত্র ত্যাগ করতে বিশেষ অসুবিধা হয়। বড় কষ্ট! তাই এটা করা ঠিক না। অমানবিক কাজ।

আরেক মানবতাবাদী বলেছেন, আমাদের দেশে আইনের শাসন নাই। তাই আমাদের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা বেশি। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না। তার মানে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে নারী নিজেকে ধর্ষণের শিকার হতে দিবে। কোনরকম প্রতিরোধের চেষ্টা করবে না। উনারা সেটাই চান আর কী! পরে আইন তো আছেই বিচার করার জন্য। ধর্ষণের মুখে নারীর এতো উত্তেজিত হওয়া অমানবিক। এইদেশের মানুষ (এইক্ষেত্রে নারীরা আরকি) সব অশিক্ষিত, অসভ্য, আদিম, বর্বর। উনি আরো বলেছেন, ধর্ষণের আগেই লিঙ্গ কেটে ফেললে নাকি আদালতে ওই ভদ্রলোকের ধর্ষণ চেষ্টা প্রমাণ করা যাবে না। ধর্ষক ভদ্রলোক তবে কি ধর্মের কথা বলতে গিয়া লিঙ্গ হারাইলেন?

আরেক মানবতাবাদী বলছেন, তিনি ছিনতাইকারিরে গণপিটুনি দেয়া সমর্থন করেন না, তাই লিঙ্গ কর্তনও সমর্থন করেন না। লিঙ্গ কর্তনকে তিনি চোখের বদলে চোখ নেয়ার সাথে তুলনা করেছেন। বলেছেন, এই আচরণ অমানবিক। তার মানে, উনার চোখ কেউ তুলতে এলে উনি চোখ পেতে বসে থাকবেন, অথবা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবেন, “আমি সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়…।” উনি আরো বলেছেন, ধর্ষকের নাকি সুশিক্ষার অভাব, তাই তাকে আগে সুশিক্ষিত বানাতে হবে।

আমি জানতে চাই, এই সুশিক্ষাটা কী জিনিস? কেমনে দেয়? উনারা সুশিক্ষার কারিকুলাম তৈরি করে দিক আমাদের। তারপর মেয়েদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুক। ধর্ষণের ভয়াবহতার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েরা যেনো ধর্ষককে সুশিক্ষার বাণী শোনাতে পারে। ধর্ষক সেই শিক্ষায় আলোকিত হয়ে উত্থিত কাম নামিয়ে চলে যাবে নিশ্চই। ব্যস, কেল্লা ফতে।

উনাদের অবস্থা দেখে মনে হয়, দলে দলে উনাদের যন্ত্রপাতি কাটা পড়ছে। চারদিকে বুঝি লিঙ্গ কর্তনের মহামারী লেগে গেছে! মাত্র একখান কর্তনেই কাল্পনিক ব্যথায় সবাই মিলে এতো কাতর হলে ক্যামনে কী! এই মানবতাবোধ দেখে আমি আশায় বুক বেঁধেছি, এবার সমাজ বদলাবেই।

যেই দেশে কয়েক মাসের শিশুও ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পায় না, জন্মদাতা পিতা স্বয়ং ধর্ষক হিসেবে আবির্ভুত হয়, ধর্ষণের সুবিধার জন্য পাঁচ বছরের পূজাকে ব্লেড দিয়ে কেটে প্রবেশ পথ বড় করে ধর্ষণ করা হয়, সেই দেশে ধর্ষণের শিকার নারীকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন আর ধর্ষকের প্রতি মানবিক হওয়ার ডাক দেবেন মানবতাবাদীরা, এ আর আশ্চর্য কী?

যদিও উনাদের কাছে অপরাধের সংজ্ঞা কী, ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে লিঙ্গ কর্তন কীভাবে অপরাধ, কেমনে অপরাধ – সেসব তারা বলেননি। অমানবিক বিচার, অমানবিক বিচার বলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও, বিচারের বিধান সম্পর্কে উনাদের ধারণা নাই। বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ১০০ ধারায় বলা আছে, যার সারাংশ হলো, আপনি যদি কাউকে রেইপ করতে যান এবং নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে সেই ভিকটিম আপনাকে মেরে ফেলে বা আপনার শরীরের খুব “গুরুত্বপূর্ণ কোন অংশ” পারমানেন্টলি ড্যামেজ করে দেয়, আত্মরক্ষার অধিকার বলে (Right to Private Defence) সে আইনের পূর্ণ সুরক্ষা পাবে। এই আইন প্রণেতাদেরও ব্যাপক সুশিক্ষার অভাব মনে হয়!

তো, বিচার কী আছে সেইটা বড় কথা না। বিচার তো পরের কথা। বিচার পর্যন্ত বেঁচে বর্তে থাকলে না হয় বিচার হবে (মানে যদি হয় আরকি)। তার আগে নারী কী করবে? বিচারের আশায় নিজেকে ধর্ষণের শিকার হতে দেবে? ধর্ষকের নির্বিঘ্ন মূত্রজীবন নিশ্চিত করতে বিশেষ অঙ্গখানি যেন কোনভাবেই আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, সেই চিন্তা করবে? এমন ঘটনায় বিচারের প্রশ্নই বা আসে কোত্থেকে? আসল কথা হলো, প্রকৃতিগতভাবেই সব রসুনের গোড়া এক কিনা! উনারা গোড়ায় ব্যাথা পাচ্ছেন।

তো ভাইলোগ, এমন হবে না। আপনারা ভয় পাইয়েন না। একজন-দুইজন মহিলা এমন অমানবিক, নিষ্ঠুর হইলেও, বেশিরভাগ নির্যাতিতাই মানবিক। তারা শুধু ধর্ষণেরই শিকার হয় না, সেইটার দায়ও ভোগে। আর ধর্ষক অক্ষত লিঙ্গ নিয়া বুক চিতায়া ঘুরে। অন্যদিকে, ধর্ষণের শিকার মেয়েটার বাকিটা জীবন ধ্বংস করে দেয় আপনাদের মানবিক সমাজ। কেউ কেউ ধর্ষণের কারণে জন্মানো সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে। তবু সেই সন্তানরে অস্বীকার করতে পারে না।

এই অশিক্ষিতের দেশে ধর্ষকের লিঙ্গের হেফাজত নিয়ে কলম ধরেছেন শিক্ষিত মানবতাবাদীরা! আফসোস!!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.