ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:
সম্প্রতি আবারো একটি তরুণ প্রাণের আত্মহত্যা খবরের শিরোনাম হলো। লাবিব নামের ছেলেটি সচ্ছল বাবা – মায়ের আদরের সন্তান। দুই বোনের একমাত্র ভাই, লাবিব সবে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল।
পরিবারের কথানুযায়ী, পড়ালেখায় মেধাবী লাবিব বেশ কিছুদিন ধরে অস্থির সময় কাটাচ্ছিলো। অস্থিরতার শুরু হয় একটি মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পর থেকে।
প্রায়শই লাবিব তার মেয়ে বন্ধুকে ” ট্রিট ” দিতে নিয়ে যেতো ওয়েস্টিন, রিজেন্সি, লা মেরিডিয়ান এর মতো নামীদামী সব হোটেল – রেস্টুরেন্ট গুলোতে। ছেলের পরিবারের দাবি, লাবিব মেয়েটিকে ভালোবাসলেও মেয়েটির একাধিক প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং সে এই সম্পর্কটির ক্ষেত্রে বিশ্বাস রাখতে পারেনি। একটি পর্যায়ে এসে মেয়েটি সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত লাবিবের প্রতি তার বাবা – মা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। দুই পরিবারের মধ্যে আলোচনাও হয়। একদিন মেয়েটি লাবিব ও তার মা – বাবাকে স্কাই ভিউ রেস্টুরেন্টে ডেকে আনে। এখানে মেয়েটির সাথে থাকা কয়েকজন ছেলে লাবিবকে মারধোর করে এমনকি লাবিবের মা – বাবার গায়েও হাত তোলে। হোটেল কর্তৃপক্ষ এগিয়ে এসে তাদের নিবৃত্ত করে। বাবা – মায়ের এ অপমান সহ্য হয়নি লাবিবের । সেই রাতে বাড়ি ফিরে সে তার নিজের ঘরে ঢুকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার আগে লাবিব ফেইসবুকের মেসেঞ্জারে মেয়েটিকে আত্মহত্যার করার কথা জানিয়ে যায়।
এসব তথ্য লাবিবের পরিবার থেকে ফেইসবুক এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেয়া হয়েছে।
তাদের সমস্ত অভিযোগের তীর মেহজাবিন নামের মেয়েটির ওপর।
কিন্তু লাবিব ও মেহজাবিনের পরিচিত এবং ঘটনার দিন স্কাইভিউ রেস্টুরেন্টে উপস্থিত একজনের বক্তব্য ছাড়াও ইউটিউবে প্রকাশিত
সিসিটিভি ফুটেজ থেকে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে লাবিবের আত্মহত্যার জন্য একতরফাভাবে মেয়েটিকে দায়ী ভাবা যায় না। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য অনুযায়ী, ওইদিন মেহজাবিন লাবিবের পরিবারকে স্কাইভিউতে ডাকেনি, বরং মেহজাবিন ও তার বন্ধুরা সেখানে খেতে গেলে লাবিবের বাবাই ফোন করে দীর্ঘ সময় আলাপের পর সেখানে যেতে চান। লাবিবকে সেখানে খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছিলো। মেহজাবিনকে দেখেই সে মারমুখী আচরণ শুরু করে। বাবা – মাকে দেখা যায় তাকে চড়- থাপ্পড় দিয়ে শাসন করতে, দুই হাতে আগলে রাখতে।
লাবিবের এক বন্ধুকে মারলেও তার বাবা – মায়ের গায়ে হাত দেয়া হয়নি বলেই প্রত্যক্ষদর্শী ও সিসিটিভি ফুটেজ সূত্রে জানা যায়। পরিবার ও একাধিক সূত্র এও নিশ্চিত করে যে, লাবিবের মধ্যে ডিপ্রেশন ছিলো, আত্মহত্যাপ্রবণতা ছিলো। জানা যায়,
এর আগে লাবিব মেয়েটিকে তার কিছু ছবি নিয়ে ব্ল্যাকমেইল ও হুমকি দিয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েছিলো।
একজন মেয়েকে কোণঠাসা করার জন্য ঢালাওভাবে ” মেয়ের চরিত্র খারাপ ” কথাটি ছড়িয়ে দেয়ার সেই আদ্যিকালের পদ্ধতি এখানেও যথারীতি বেশ কাজে দিয়েছে দেখছি।
লাবিবের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা। বুঝতে পারি, আত্মহত্যার মধ্যে দিয়ে নিভে যায় একটি তরতাজা প্রাণ, সেইসাথে একটি পরিবারের সবটুকুু আলো।
লাবিব ফিরে আসবে না।
সন্তান হারিয়েছেন বলেই মেয়েটিকে একতরফাভাবে দোষারোপ করার আগে তাদের ভাবা উচিৎ, অন্যের সন্তানও সন্তান। ” মেয়েটি ফালতু, দুশ্চরিত্র, তার নখ ডাইনির মতো, সে গলায় ওড়না পরে, তার মৃত মা তাকে কিছুই শিক্ষা দেয়নি, তাদের বাড়িতে বসার চেয়ারটা পর্যন্ত নেই ” – এই কথাগুলো আসলে আমাদের সমাজের হীনমন্যতাই তুলে ধরে।
কাপুরুষেরাই আত্মহত্যা করে – এমন অবিবেচক মন্তব্য করতে আমি রাজী নই। বরং বোঝার চেষ্টা করি, কেন এই আত্মহত্যা? জীবনের প্রতি কতখানি ঘৃণা বা অভিমান থেকে নিজেকে শেষ করার চিন্তা মানুষের মাথায় আসে? আমাদের দেশে আত্মহত্যার যে খবরগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, সেগুলো খেয়াল করলে আত্মহত্যার পেছনে কিছু সাধারণ কারণ হিসেবে দেখা যায় – প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়া, ইভ টিজিং বা ধর্ষণের শিকার হওয়া, মাদকাসক্তি, পারিবারিক নির্যাতন, শিক্ষক বা অভিভাবকের অতিরিক্ত শাসন, কারো কাছ থেকে অপমানিত হওয়া, অভাব-দারিদ্র্য, হতাশা, মাদকাসক্তি , দাম্পত্যকলহ, পরকীয়া এবং সর্বোপরি তীব্র মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে।
এ এক অস্থির সময়ে বসবাস করছি আমরা।
লাবিব ও তার মেয়ে বন্ধুটির সম্পর্ক নিয়ে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তা থেকেও বোঝা যায় যে, ভালোবাসার সম্পর্ক গুলোতে কীভাবে ভাইরাসের মতো ঢুকে পড়েছে সময়ের অস্থিরতা। ফেইসবুক, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ, ভিডিও গেমসের ভার্চুয়াল যুগে সম্পর্ক নিছক গো অন, হ্যাং আউট, সেল্ফি, ব্রেক আপ নামের কতগুলো বোকা বোকা শব্দের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে, ছেলেখেলা হয়ে উঠছে দিনদিন। তরুণ প্রজন্ম এবং অভিভাবকদের জন্য লাবিব – মেহজাবিনের মাঝে ঘটে যাওয়া অঘটন আর লাবিবের আত্মহত্যা অনেক বড় একটা শিক্ষা।
দুইজন মানুষের মধ্যে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠলে কিছু দায়িত্ব এসে যায়। সে দায়িত্ববোধ তৈরি হবার আগেই যখন আমরা বিশেষ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি -তখন তার ঝড়ঝাপটা সামাল দিতে গিয়ে ভারসাম্য রাখতে পারি না, খেই হারিয়ে ফেলি।
যদিও শেষরক্ষা হয়নি, তবু লাবিবের পরিবার ছেলেকে মানসিক সমর্থন দিতে চেষ্টা করেছে।
মেহজাবিনের পরিবারের কী ভূমিকা তা জানতে পারিনি। সেও নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছে। মাত্র নয়মাস আগে মাকে হারানো মেয়েটির উদ্ভ্রান্ত চলাফেরা নিয়ে কেউ তার সাথে কথা বলেছিল কী না জানি না।
ছেলেমেয়ের রুটিন জীবনে যে কোনো অসংগতি সবার আগে পরিবারই টের পায়। তাই
পরিবারের এগিয়ে আসাটা খুব জরুরি।
প্রত্যেকটি সম্পর্কের আলাদা আলাদা নাম, পরিচয়, সৌন্দর্য, মাধুর্য , পরিমিতিবোধ, মাত্রা আছে। সন্তানের অন্তরে এই “বোধ ” তৈরি করার দায়িত্ব পরিবারের ওপর বর্তায়। জীবনে চলার পথে বিবিধ অভিজ্ঞতা কুড়াতে কুড়াতে মানুষকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। এই দীর্ঘ যাত্রায় সে হোঁচট খেতে পারে, আঘাত পেতে পারে – এসবই জীবনের অংশ। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও মনোমালিন্য থাকবে, মতপার্থক্য হতে পারে , এমনকি বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তও হতে পারে। পারিবারিক পরিবেশ পারে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার মতো, মেনে নেবার মতো শক্ত মনোবল সন্তানের মধ্যে গড়ে তুলতে। সেই সাথে যেকোনো সম্পর্ককে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। বন্ধু বা সঙ্গী যদি সম্পর্কে ইতি টানতে চাইলে জোরজবরদস্তি না করে সবদিক বিবেচনা করে, নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া সেরে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসা উচিৎ। বিচ্ছেদ অনিবার্য হলে smartly বলতে শেখা উচিৎ – ” Since there’s no help, come let us kiss and part. “
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকলে আত্মসম্মানবোধ থাকলে কেউ জনসম্মুখে অপমানজনক পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে না।
যে সম্পর্ক মানুষকে সহিংস, প্রতিহিংসাপরায়ণ আর আত্মবিধ্বংসী করে তোলে তা কারো মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনা । ফলাফল লাবিবের মতো করুণ পরিণতি – যা কখনোই কাম্য হতে পারে না।
আমাদের সন্তানদেরকে জীবনের জড়বিষাদ সব ঝেড়ে ফেলে জীবনকে ভালোবাসতে শেখাই। লাবিবের মতো তরুণদের
পৃথিবীর সুন্দরতম অনুভবের নাম ভালোবাসা।