সাকি চৌধুরী:
সিলেট শহর থেকে ১৭ মাইল দূরে আমাদের গ্রামের বাড়িতেই কেটেছে আমার জীবনের প্রথম সাতটি বছর।
সময়টা ৫০ দশকের শেষ থেকে ৬০ এর দশকের প্রথম দিকে।
গ্রামের দক্ষিণ দিকে দেবোত্তর সম্পত্তির উপর তৈরি আখড়ায় সন্ধ্যা-কীর্তন আর উত্তর প্রান্তে মসজিদের মাগরিবের আজান শুনেই আমাদের গ্রামে সন্ধ্যা নামতো।
আখড়ার মন্দির, সম্পত্তি আর পূজা-অর্চনার দায়িত্বে ছিলেন পুতুল কাকা। পুতুল কাকা আর আমার বাবা-চাচারা ছিলেন প্রায় সমবয়সী। স্কুলজীবনে সবাই ছিলেন করিমগঞ্জ সরকারী স্কুলের আবাসিক ছাত্র, তাই তাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের একটু উপরে, একে অন্যের বয়সের তারতম্যে দেখাশোনা আর অভিভাকত্বেরও কিছুটা। যেমন পুতুল কাকা চাচার সমবয়সী হলেও বাবার বড় হওয়ার কারণে বাবা একটু শ্রদ্ধা রেখেই পুতুল কাকার সাথে কথা বলতেন।
লেখাপড়ার শেষে আমার বাবা-চাচা দুইজনই সরকারি চাকরি নিয়ে করিমগঞ্জ আর তৎকালীন বৃহত্তর আসামের রাজধানী শিলং চলে যান। পুতুল কাকা গ্রামে উনার বাপ-দাদার জমিদারি দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়ে গ্রামেই থেকে যান।
এর মধ্যে ৪৭ এর দেশভাগ।
বাবা করিমগঞ্জ ছেড়ে সিলেট, চাচা শিলং সচিবালয় ছেড়ে ঢাকা সচিবালয়ে।
আমাদের গ্রামের সামান্য কয়েকজন হিন্দু গ্রামে থেকে যাওয়া ছাড়া পুতুল কাকাদের নিকট আত্মীয়, উনাদের প্রজাসহ আমাদের প্রজাদের মধ্যে যারা হিন্দু ছিল, তাদের প্রায় সবাই গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে গেলো।
এই চলে যাওয়ার পেছনে না ছিল কোনো সাম্প্রদায়িক উস্কানি, না ছিল কোন বিদ্বেষ।
আমার দাদীর সকালের উঠোনে বসে নিয়মিত আড্ডায় যখন পুতুল কাকা আসতেন, তখন এই চলে যাওয়াদের নিয়ে উনাদের হাহাকার আর অতীতের সম্পর্ক নিয়ে উনাদের কথা বলা থেকেই বুঝতাম, কী হৃদয়বিদারক ছিল সেই ঘটনা!
পুতুল কাকারা যাননি, কখনো যাওয়ার চিন্তাও করেননি। কাকা ছিলেন আজীবন পূর্বপাকিস্তান কমুনিস্ট পার্টির সদস্য। জমিদারীর মামলা-মোকদ্দমার কারণে পুতুল কাকা ঢাকা গেলে উঠতেন আমার চাচার আজিমপুরের সরকারি কলোনির বাসায়। অন্যদিকে চাচা সপরিবারে ছুটিতে প্রতিবছর যখন দাদীর সাথে গ্রামের বাড়িতে সময় কাটাতে আসতেন, তখন একদিন সবাই মিলে পুতুল কাকাদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতাম আমরা উৎসব করে।
কাকীর সে কী আদর আপ্যায়ন!
পুতুল কাকারা এলে মাংস ছাড়া মাছ-নিরামিষের বিরাট আয়োজন হতো আমাদের বাড়িতে।
আমার চাচা আর পুতুল কাকার আড্ডা ছিল পুরো একদিনের ব্যাপার।
লেখাপড়ার প্রয়োজনে আমি চলে আসি সিলেট শহরে আমাদের বাসায় ৬৩ সালে, দাদী প্রয়াত হোন ৬৬ সালে, আর চাচা ৭০ সালের শেষের দিকে।
গ্রামের আমাদের বাড়িতে কেবল দেখাশুনার জন্য এক লোক ছাড়া আর কেউ না থাকায় প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গ্রামের সাথে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক।
কেবল কাকী পাঠাতেন প্রতি বছর কাঁচামিঠা আমের আমসত্ত্ব আমাদের শহরের বাসায়। কারণ পুরা গ্রামের মধ্যে কাকাদের বাড়িতে আর আমাদের বাড়িতেই ছিল কাঁচামিঠা আমের দুইটি গাছ কেবল। কাকী জানতেন কাঁচামিঠা আম আমার পছন্দের।
১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম দিকে আমরা সিলেট থেকে আর আমাদের চাচার পরিবার ঢাকা থেকে চলে আসি গ্রামের বাড়িতে চাচার মৃত্যু পরবর্তী একটি আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনে।
২৫ মার্চের কালো রাত্রির পর আমরা গ্রামেই আটকা পড়ে যাই।
চারিদিকে হায়নাদের প্রতিরোধ আর পাক হানাদারদের নিপীড়ন, হত্যার মহাযজ্ঞ যখন আমাদের গ্রামের দিকে তেড়ে আসছিলো, তখন পুতুল কাকারা গ্রামবাসীর অনুনয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেবল ছেলেমেয়েদের ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেন।
নিজেরা গোঁ ধরে বসলেন, বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটা-মাটি ছেড়ে উনারা কোথাও যাবেন না। ৪৭ এ তো যাননি।
এখন যাবেন কেন?
পাকিস্তানিরা পাঁচ মাইলের দূরত্বে এসে গেছে, আর আসার পথে অনেক লোককে হত্যা করেছে, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মালম্বীদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, এমন খবর পাওয়ার পর গ্রামের লোকজন টেনে হিঁচড়ে কাকা আর কাকীকে বাড়ি থেকে বের করে ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।
সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য এখনো আমার মানসপটে জ্বলন্ত।
পাকিস্তানিরা উনাদের সুন্দর কাঠের দোতলা বাড়িটিসহ সকল ঘরই পুড়িয়ে দেয়।
স্বাধীনতার পর ভারত থেকে কাকারা যখন আবার গ্রামে ফিরে আসেন, তখন আমাদের পুরো গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে আর নিজেদের সহায়-সম্বল দিয়ে পুতুল কাকাদের বাড়িঘর তৈরি করে দেয়।
১৯৭৫ সালে আমার বাবা মারা যাওয়ার আগে কিছুদিন সিলেট হাসপাতালে ছিলেন, তখন বাবার পাশের বেডের এক রুগী দেখতে আসে পুতুল কাকার ছেলে রানা। বাড়িতে গিয়ে কাকীকে বলেছিল, আমি হাসপাতালে আমাদের গ্রামের একজনকে দেখে এসেছি উনি এই নামের। কাকী বাবার নাম শুনে রানাকে বলে দিয়েছিলেন, উনি তোমার কাকা, আর তুমি প্রতিদিন উনাকে দেখতে যেও। রানা প্রতিদিনই একবার এসে বাবার পাশে বসে থাকতো।
আমি দেশ ছেড়েছি ১৯৭৯ সালে।
বাবা, চাচা, পুতুল কাকা সবাই প্রয়াত, এমনকি বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা রানাও অকাল প্রয়াত।
কাকী বেঁচে ছিলেন অনেকদিন।
পুরো গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখে, অসুখ-বিসুখে, বন্যা-খরায় আর দুর্দিনে কাকী ছিলেন আমাদের গ্রামের সাক্ষাৎ এক মাদার তেরেসা।
একবার দেশে গিয়ে বন্ধু রাজনীতিবিদ লোকমানের মুখে শুনলাম, কাকী প্রয়াত হয়েছেন।
ও গিয়েছিলো শেষকৃত্যে।
গ্রামের কয়েকশত মুসলমান টুপি পরে এসেছিলো হিন্দু কাকীর শেষকৃত্যে আর কাকীকে বিদায় দিতে।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা উঠলেই আমাদের লোকমান আজও উচ্ছসিত হয়ে সেই অসাধারণ শেষকৃত্যের দৃশ্যের কথা বলে।
(Published as part of social media campaign #BeHumaneFirst to promote secularism in Bangladesh)