বৃদ্ধ মা গাছটাকে একটু যত্ন করুন

রামিছা পারভীন প্রধান:

একজন মা সন্তান গর্ভে আসার পর থেকে স্বপ্ন দেখে সন্তানকে কীভাবে লালন-পালন করবে, কীভাবে একজন ভাল মানুষ করে গড়ে তুলবে। সমস্ত চিন্তা, ধ্যান ধারণাই থাকে যেন তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে। সন্তান জন্ম হয়ার পর থেকে তার নতুন পরিচয় সে একজনের মা। সেদিন থেকে সে ভুলে যায় নিজের আমিকে। আমার সন্তান আগে, তারপর আমি। আমি কী পেলাম না পেলাম সেটা কোনো বিষয় নয়, বরং আমার সন্তান কিছু পেলো কিনা সেটা আমার মুখ্য বিষয়।

কত মা আছে সন্তানকে খাইয়ে নিজে যখন খেতে যায়, তখন ভাতের হাঁড়ি থাকে শূন্য। তারপরও বলে আমার ছেলেমেয়েদের খাওয়া মানে আমার খাওয়া। সন্তানের প্রতি মায়ের যে ভালবাসা, সেই ভালবাসায় কোনো স্বার্থপরতা নেই, দু’একটা ব্যতিক্রম বাদে।

বছরের পর বছর কত ঈদ গেছে, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচের কথা চিন্তা করে একটা শাড়িও কেনা হয়নি। এক কাপড়ে সারা জীবন পার করেছে, ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে গিয়ে স্বামীর সাথে জমিতে গিয়ে কাজ করেছে। নিজের চেহারার দিকে কখনও তাকায়নি, কত রাত জেগেছে সন্তান অসুস্থ হলে, ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে ভালমন্দ খেতে পারেনি, আর আজকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছয় সন্তানের সেই মাকে ভিক্ষা করতে হচ্ছে। ভাগ্যের কী করুণ পরিণতি!

এই মা এর ছয় সন্তানের মধ্যে তিন ছেলে পুলিশ কর্মকর্তা ও এক মেয়ে প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা। তারপরও তাদের বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মাকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে হয়। বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকতে হয় এই ৭০ বছরের মাকে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আমার মনে পড়ে সরকার কিছুদিন আগে একটা আইন করে যে বৃদ্ধ পিতামাতার ভরণ পোষণের খরচ সন্তানকে দিতে হবে। সেই ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধ মহিলার তিন সন্তানকে আইনের আওতায় এনে চাকরিচ্যুত করা উচিত। তারা তাদের মায়ের ক্ষেত্রে ন্যুনতম দায়িত্বটুকুও পালন করেনি। এরা সমাজের কুলাঙ্গার সন্তান। তারপরও হয়তো মায়েরা বলবে, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।

কয়েকদিন আগেও ফেসবুকে দেখেছিলাম প্রায় আশি বছরের এক বৃদ্ধ মহিলাকে তার ছেলে চোখের কাছে গুরুতর আহত করে। পরে স্হানীয় প্রশাসনের সহায়তায় তার চিকিসা করা হয়। আবার সেদিন দেখলাম এক বৃদ্ধ মহিলাকে কে বা কারা এক ফাঁকা জায়গায় ফেলে রেখে চলে গেছে। যেই মা তার সন্তানকে বড় করার জন্য ছোট থেকে সবসময় ছায়ার মতো ছিল, নিজের জীবনকে তাদের জন্য উৎসর্গ করেছিল, আজ তারা যখন এই মায়েদের সাথে এই রকম আচরণ করে, তখন মনে হয় বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। চারদিকের এই অবস্হা দেখলে মনে হয়, যদি বেঁচে থাকি, তাহলে শেষ বয়সে আমার ছেলেমেয়েরা আমার খেয়াল রাখবে তো!

আমরা এখনকার মায়েরা ১/২ জন সন্তানকে বড় করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাই। অবশ্য এটা যুগের চাহিদা। এই ডিজিটাল যুগে সেই ভোর থেকে শুরু হয় মায়েদের পরিশ্রম। ছেলেমেয়েদের খাওয়া দাওয়া, পড়ালেখা স্কুল, কোচিং এসব নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছে এই মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য।

মনে প্রশ্ন জাগে, সন্তানেরা কি মায়ের এই পরিশ্রমের দাম কখনও দিতে পারবে? একজন মা-ও নিশ্চয়ই কখনো তার সন্তানের কাছ থেকে তার দাম চাইবে না। শুধু চাইবে যে গাছটা এতোদিন ছায়া দিয়েছিল, সেই বৃদ্ধ গাছটাকে যেন একটু যত্ন করে। এই চাওয়াটা পূরণ করা কি এতোই কঠিন? এতোই?

শেয়ার করুন: