শিশুর মনোদৈহিক বিকাশে উপেক্ষিত থেকে যাওয়া কথা

রাবিয়া আনজুম:

সকল বাবা-মাই চান তাদের সন্তান থাকুক দুধে ভাতে, বেড়ে উঠুক সবার সেরা হয়ে। আর তাই সুঠাম সবল দেহ আর বুদ্ধিতে সেরাদের সেরা করে সন্তানকে গড়ে তোলার জন্য বাবা-মা’র আকাঙ্খার জায়গাটাকে পুঁজি করে বাজার আজ চটজলদি গুলিয়ে খাওয়ার সহায়ক খাবারে সয়লাব।

ব্যস্ত জীবনে আমরাও নিশ্চিত বোধ করি দামি সেসব খাবার গুলিয়ে খাইয়ে দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে। আসলে কতটুকু উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে আমাদের, অথবা আমরা সঠিক ভাবে আসলেই সন্তান লালন পালন করতে পারছি কিনা, তা পর্যালোচনা করে দেখার তাগিদ থেকেই ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের বাবা-মা’দের উদ্দেশ্যে লেখাটি লিখতে বসলাম। পাশাপাশি শিশুর সুস্থ সবল ভারসাম্যপূর্ণ মনোদৈহিক বিকাশে শুধু ভালো খাবার যথেষ্ট কিনা সে বিষয়টিও তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

১। ব্রেইন ডেভেলপমেন্টের পাশাপাশি লজিক ডেভেলপমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

শিশু জন্মের প্রথম ৫/৬ বছর সময়কাল তার সারা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ সময়ে নেয়া যত্নের উপরেই নির্ধারিত হয়ে যাবে তার ভবিষ্যৎ জীবনের মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা। মানব মস্তিস্ক লক্ষ কোটি নিউরণের সমন্বয়ে গঠিত। মস্তিস্কের নিউরণ সংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য মাতৃদুগ্ধে থাকে বিশেষ উপাদান যার কোনই বিকল্প নেই। মায়ের দুধের উপর আস্তে আস্তে নির্ভরশীলতা কমে আসার সাথে সাথে দিতে হবে স্বাভাবিক পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু বুদ্ধির বিকাশে নিউরণের সংখ্যাই কি একমাত্র বিবেচ্য। এখানেই একটি ফাঁক রয়ে গেছে যা প্রায়শঃই উপেক্ষিত থেকে যায়। আর তা হলো লজিক ডেভেলপমেন্ট। লজিক ডেভেলপমেন্ট হলেই কেবল সম্ভব মাথা খাটিয়ে বা নিউরণগুলিকে কাজে লাগিয়ে কোন সমস্যার সমাধান করা। আর লজিকের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয় নিউরণসমূহের মধ্যকার আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে যা synapses নামে পরিচিত। এই নিউরণের সংখ্যার পাশাপাশি এই আন্তঃসংযোগসমূহ যার যত সমৃদ্ধ সে তত তার ব্রেইনকে ইউটিলাইজ করতে পারবে অর্থাৎ তত ভালো পারফর্মার হ’তে পারবে। কিন্তু সারপ্রাইজিং ফ্যাক্ট হচ্ছে এই যে, এসব আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধিতে বা নতুন নতুন আন্তঃসংযোগ সৃষ্টিতে খাবার দাবারের ভূমিকা অত্যন্ত সীমিত। বরং আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন বৈচিত্রময় এ্যাক্টিভিটিই প্রধান ভূমিকা রাখে সমৃদ্ধ নেটওয়ার্ক synapses সৃষ্টিতে।

তবে শিশুদের প্রাত্যহিক জীবনের এ্যাক্টিভিটিগুলো তবে কি যা তার মস্তিস্ক উদ্দীপিত করবে যা synapses বা আন্তঃসংযোগ নেটওয়ার্ককে আরো সমৃদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আহামরি কিছু নয় সেসব অ্যাক্টিভিটি, যা শিশু মস্তিস্ককে করবে সমৃদ্ধ, বরং সেসব স্বাভাবিক এ্যাক্টিভিটির কথাই আমি বলছি, যা থেকে আমাদের শিশুদেরকে প্রতিদিন বঞ্চিত করছি আমরা শহুরে বাবা মায়েরা। যেমন পরিবারের সদস্যদের সাথে প্রচুর গল্প করা, খোলা মাঠে সমবয়সীদের সাথে দৌড় ঝাপ করা (দৃঢ় পেশী ও হাড়ের বৃদ্ধিতে সহায়ক, সেই সাথে সোশিয়ালাইজেশন আর লিডারশীপের বিষয়টা আয়ত্বে আসবে), অসমতল সারফেসে হাঁটা চলার কায়দা রপ্ত করা (আমাদের কাছে অত্যন্ত সহজ মনে হলেও চার দেয়ালে বন্দী অনেক শহুরে বাচ্চারই এই ব্যালেন্স থাকে না), বাইসাইকেল চালনা (এতে কোন কিছুতে কিভাবে ভারসাম্য আনা যায় সেটার প্রসেসিং ক্ষমতা মস্তিস্ক পাবে)।

শিশুকে রং বেরংয়ের আর নানা আকারের নিরাপদ উপাদানে তৈরি খেলনা দিন, কোনটা কি রং সেসবের ধারণা দিন, বিভিন্ন আকার সম্পর্কে ধারণা দিন (পরবর্তীতে এগুলো জ্ঞানই তার এ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে দারুণ সহায়ক হবে, বিশ্বাস করুন)। আঁকি বুকি করতে দিন, হোক সে দেয়ালে (এতে করে সে সঠিক ভাবে এবং পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের সাথে কলম পেন্সিল ধরার কায়দা রপ্ত করে ফেলবে)। একটু বড় হলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত সাপেক্ষে সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা করুন যদি সুযোগ থাকে।

আসলে জানেন কি, বিদেশের প্রি-স্কুল কাম ডে-কেয়ারগুলোতে কিন্তু এসব এ্যাক্টিভিটিই বেশি থাকে, যা তাদের দীর্ঘদিনের গবেষণার ফল। এভাবেই তারা তাদের প্রজন্মকে ভবিষ্যৎ দিনগুলোর জন্য প্রস্তুত করে। এখন যদি বলেন, ঢাকা শহরে বাবা-মা সারাদিন চাকরি করে এতো সময় কীভাবে দিবেন বাচ্চাকে! পাঁচ দিন না হয় ঘরে ফিরে ইনডোর এ্যক্টিভিটিতেই শিশুকে সময় দিন, আর বাকি দুদিন নিজেরা আরাম না করে বাচ্চাকে নিয়ে পার্কে যান, আশেপাশে কোথাও যান। আপনি চাইলেই খুঁজে বের করতে পারবেন সেসব জায়গা।

আর প্লিজ, দয়া করে বাচ্চার হাতে মোবাইলে গেম ছেড়ে দিয়ে আর টিভিতে কার্টুন ছেড়ে দিয়ে নিজেরা আরাম করবেন না, অন্তত যখন আপনারা বাসায় থাকবেন। মাত্রারিক্ত স্ক্রীন টাইম শিশুর মস্তিস্কের স্বাভাবিক বিকাশে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে নতুন আর্টিকেল হয়ে যাবে, তাই আপাতত একলাইনেই বিষয়টা শেষ করলাম।

২। দ্বিগুণ পুষ্টির খাবারেই দ্বিগুণ বৃদ্ধি নয়

টিভির বিজ্ঞাপনে শুধুই দেখি দ্বিগুণ ক্যালসিয়াম, তিনগুণ অমুক জিনিস এসবের গুলিয়ে খাবার জিনিস। বাচ্চা নাকি ধাই ধাই করে বড় হয়ে যাবে। শিশু দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য পুষ্টিকর এবং ব্যালেন্সড ডায়েটের পাশাপাশি তার হাড়ের বৃদ্ধির বিষয়েও খেয়ার রাখা বিশেষ জরুরি, কারণ হাড়ই মানব দেহের অভ্যন্তরীণ মূল কাঠামো। কাঠামোর বৃদ্ধি ছাড়া শুধু শুধু ওজন বৃদ্ধি হলে তা হিতে বিপরীত হবে। আর হাড় বৃদ্ধির মূল ভূমিকা ক্যালসিয়ামের। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ভিটামিন ডি। ভিটামিন ডি ছাড়া যতই দ্বিগুণ তিনগুণ ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার দিন না কেন, তা কাজে আসবে না। কারণ ভিটামিন ডি এর কাজ ক্যালসিয়ামকে হাড়ে শোষিত হওয়ার প্রক্রিয়ার মূল ভূমিকা পালন করা।

কোথায় পাওয়া যাবে এই ক্যালসিয়াম ডি? বাচ্চার গায়ে রোদের আলো লাগতে দিন কিছুটা সময় অন্তত, রোদের আলো থেকেই পেয়ে যাবে ক্যালসিয়াম ডি। আজকালকার বাচ্চারা সারাদিন ঘরবন্দী থাকে, ঘর থেকে গাড়িতে চড়ে হয়তো ডে-কেয়ার, ফ্ল্যাট বাড়ির মাঠহীন স্কুল বা কোন শপিং মলের ইনডোর প্লে গ্রাউন্ডে। কোথায় পাবে রোদের আলো, তাই আলাদা করে বিষয়টা লিখলাম। আবার ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন ডি সবই দিলেন, কিন্তু সেই সাথে প্রচুর প্রসেসড জাঙ্ক ফুড আর কোমল পানীয়ও দিলেন, তাহলেও কিন্তু সকলই বৃথা যাবে। কারণ অধিকাংশ প্রসেসড আর প্যাকেটজাত খাবার যেমন চিপস টাইপের খাবারে প্রচুর লবণ থাকে, যা হাড়ের ক্যালসিয়ামকে ক্ষয় করে হাড়কে দুর্বল আর ভঙ্গুর করে দেয়। যার ফলে দেখবেন, একই বয়সের দুইটি বাচ্চা খেলতে যেয়ে পড়ে গিয়ে একজনের হড়ে ভেঙ্গে যায়, আরেকজন থাকে অক্ষত। আর প্রচণ্ড গরমের পর ঠাণ্ডা কোমল পানীয় ছোট-বড় কারোরই খাওয়া উচিৎ নয়, কোমল পানীয় (কার্বোনেটেড ড্রিঙ্ক) সাময়িক তৃপ্তি দিলেও সেটা বস্তুত শরীরে পানি শূন্যতা সৃষ্টি করে, আর হাড়কেও করে ভঙ্গুর।

৩। শিশুকে ‍নিয়ে বেড়াতে যান

আজকের লেখার শেষ পয়েন্ট এটি। শিশুর প্রথম ৫/৬ বছর সময়কার হচ্ছে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের সময়। শিশুরা জন্ম নেয় একটি শূণ্য মস্তিস্কে বা একটি ব্ল্যাংক হার্ড ডিস্ক নিয়ে। ধীরে ধীরে নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে শেষে সে পায় জীবন চলার পথের নানা শিক্ষায় সমৃদ্ধ সকল প্রোগামে লোড করা একটি চমৎকার হার্ড ডিস্ক। তার জীবনের এই প্রাথমিক পর্যায়ে বইয়ের ভারে তার চিন্তা শক্তির বিকাশকে নির্মমভাবে রুখে না দিয়ে, তাকে সাবলীলভাবে বাড়তে দিন, আত্মবিশ্বাসী হয়ে সাহসী মানুষরূপে গড়ে তুলুন। তাকে পারিবারিক সময় দিন। সুযোগ ও সাধ্য মতো ফ্ল্যাট বাড়ির চার দেয়ালের গণ্ডি থেকে মাঝেমধ্যে তাকে বেড়াতে নিয়ে যান একটু দূরে কোথাও প্রকৃতির কাছাকাছি। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না প্রতিটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আপনার শিশুকে কিভাবে সমৃদ্ধ করে তুলবে! বিশ্বাস করুন!

আমি নিজে একজন মা। নিজের বাচ্চা লালন পালন করতে যেয়ে ওয়েবসাইট আর পত্র পত্রিকায় পড়ে এসব জেনেছি, আর নিজেও পরখ করে দেখেছি এসবের সত্যিকারের কার্যকারিতা। আমার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান যদি নতুন কোন বাবা-মা আর তাদের সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশে কাজে লাগে, তবেই আমি তৃপ্তি পাবো এই ভেবে যে দেশের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী দেশের প্রজন্ম গঠনে ক্ষুদ্র ভূমিকা পালন করালাম।

ধন্যবাদ সবাইকে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.