সোলায়মান মিয়ার এতেকাফ যাত্রা (পর্ব-১)

ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা:

ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে সুলেখা বিবির ঘুম ভেঙ্গে যায়। স্বামী সোলায়মান ঘরের পাশের মাজারে খালি গলায় আজান দেয়, সোলায়মান মিয়ার কন্ঠ সুমধুর। সোলায়মান মিয়া এক সময় নিয়মিত হারমোনিয়াম বাজিয়ে গলার রেওয়াজ করতো। আহা কত শত অনুষ্ঠানে মঞ্চের গান গাওয়া শিল্পী এই সোলায়মান মিয়া। সুলেখা বিবি লোকমুখে শুনেছেন, জনপ্রিয় গায়িকা শাকিলা জাফরদের সঙ্গে এক মঞ্চে গান করতো সোলায়মান মিয়া। এখন দুনিয়াদারীর মায়া ভুলে বাপজানের মাজারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে সেই স্বামী- ভাবতেই সুলেখাবিবির কেমন সংশয়বোধ হয়। মানুষটা কি সত্যি সত্যি পাল্টে গেল, নাকি এটাও হুজুগের কোন খেলা?

আলসেমি না করে সুলেখা বিবি বিছানা থেকে উঠে বসেন। আজ তার ম্যালা কাজ! তার স্বামী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে এতেকাফে যাবেন। এর আগেও একবার তার স্বামী চিল্লায় গিয়েছিল, কিন্তু তিনি চিল্লায় থাকাকালে তার ননদ-দেবরেরা ক্ষেতের ফসল, পুকুরের মাছ, বাগানের ফল একদম লুটেপুটে খেয়েছিল। বাড়ীর বউ হিসাবে মনে মনে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেলেও জোর গলায় সাহস করে প্রতিবাদ করতে পারেনি সুলেখা। তাই এইবার স্বামী যেন মসজিদে চিল্লায় না গিয়ে নিজ বাড়ীতেই এতেকাফে বসে, এই আব্দার করেন সুলেখা। যদিও চিল্লার মসজিদ তার শ্বশুরের দেয়া জমিতেই তৈরি, আর সেই মসজিদের দূরত্ব বাড়ি থেকে গুনে গুনে দশ হাত।

তাছাড়া, চাচাতো দেবর সুলেখার দিকে যেন কেমন চোখে তাকায়। স্বামী চিল্লায় যাওয়ার পর একরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সুলেখা টের পান অন্ধকারে তার দিকে তাকিয়ে আছে বড় বড় দুটো চোখ। সুলেখা চিৎকার করতেই ঘরের জানালা দিযে পালিয়ে যায় চোর। সারা গ্রাম ধরে খুঁজে পায় না কেউ চোরকে। সুলেখার শাশুড়ি-মা জানিয়ে দিলেন এই সব চোর-টোর কিছু না, এটা জ্বীনের আছর! কিন্তু সুলেখা বিবি নিশ্চিত জানে অন্ধকারে সে তার চাচাতো দেবরের চোখগুলো ঠিকই দেখে নিয়েছিল। আর নিজের ঘরের দুঘর পরে যার বাড়ী তাকে তো সারা গাঁয়ে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যায় না।

সুলেখা বিবির রূপের সুনাম আশেপাশের দশ গ্রামে, সেই কারণেই ডাবল এম.এ পাশ সোলায়মান বিশ বছরের ছোট এইট পাশ সুলেখা বিবির প্রেমে পড়ে। কথা ছিল, বিয়ের পর সুলেখা বিবিকে পড়ালেখা চালিয়ে নিবে সে। কিন্তু সুলেখা বিবির অনাগ্রহ আর মেধা কোনটাই তাকে বেশিদূর এগুতে দেয়নি। সুলেখা বিবি দুবার মেট্রিক ফেল করে তৃতীয়বার পরীক্ষা দিতে যাবার আগে পোয়াতী হন। এরপর একে একে চার সন্তানের জননী সুলেখার পড়ালেখা মাচায় ওঠে। প্রথম সন্তান ছাড়া সব সন্তানই হয়েছে পেট কেটে, সুলেখা এখন আর সন্তান নিতে চায় না। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে তার শ্বশুর আউলিয়া সৈয়দ খাজা মোহাম্মদ সুরুজ মিয়া অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহর পথে আসা স্বামী আর জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে চায় না। সুলেখা বিবি অনেক চেষ্টা করেছেন স্বামী যেন কনডম ব্যবহার করে; কিন্তু তার স্বামী কনডম দিয়ে আদর করে নাকি একদমই তৃপ্তি পায় না। স্বামী তাকে বলেছে,- সুলেখা, সন্তান জন্ম দিয়ে আল্লাহ পথের সৈনিক বাড়াচ্ছো তুমি, একটা সন্তান বেশি মানে দুনিয়ায় একজন মুসলমান বেশি।

এদিকে সুলেখার ডাক্তার বলে দিয়েছেন, এরপর সন্তান নিলে সুলেখা বিশাল বিপদে পড়বে- দুবারের বেশি পেট কেটে বাচ্চা হলেই ডাক্তারেরা হুংকার মারেন; আর তার তো পর পর তিনটা বাচ্চাই মাশাল্লাহ পেট কেটে হয়েছে। লুকায় লুকায় বড়ি খায় সুলেখা বিবি। কত বাহানা করে বাজারে গিয়ে বড়ি কিনে আনেন, আর কত পদ্ধতি লুকিয়ে রাখেন সেই বড়ি, তা জানে শুধু সুলেখা আর তার আল্লাহ। এদিকে বড়ি খেয়ে দিন শরীর ভারী হয় আর বাড়ছে আরো অনেক অসুখ!

সারা বাড়িতে আজ হৈ চৈ! সুলেখার শাশুড়ি আমেনা বিবি বড়ই আনন্দিত। বছর দুয়েক আগে স্বামীর মৃত্যুতে তিনি বড়ই চিন্তিত ছিলেন। তার স্বামী ছিলেন পীর আউলিয়া মানুষ, আমেনা বিবির বাবা-ভাই সবাই ছিলেন পীর আউলিয়া। আমেনা বিবি নিজেও পীর মা, তারও আছে শত শত মুরিদান। যদিও কিছু নাফরমান কয়, ইসলামে নারী নেত্রীত্ব নাকি হারাম? কত্ত বড় নাফরমানি করে মানুষ! তারা তো জানে না, শুধু আমেনা বিবি জানেন, তিনি আসলে মা ফাতেমার পুনর্জন্ম হয়ে এই দুনিয়ায় এসেছেন! পূর্বজন্মে যার স্বামী ছিলেন হযরত আলী, যিনি এ জন্মেও আউলিয়া সৈয়দ খাজা মোহাম্মদ সুরুজ মিয়ার রূপ ধরে তার স্বামী হিসেবেই তার পাশে ছিলেন। বছর দুয়েক আগে তার স্বামী পরলোক গমণ করলেও তার স্বামী সুরুজ মিয়া আবার এ পৃথিবীতে ফিরবেন, শুধু ফিরবেনই না, রসুলের পথে লড়াই করবেন তিনি।

আজ তার ডাবল এম.এ পাশ মেজ পুত্র সোলায়মান মিয়া দুনিয়াদারীর মায়া ছেড়ে এতেকাফে যাচ্ছেন। এর আগে চিল্লায় গিয়েছিলো সোলায়মান। কিন্তু দুনিয়াদারীর যন্ত্রণায় চিল্লায় চল্লিশ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেন নাই সোলায়মান। সোলায়মান দানা-পানি গ্রহণ না করে মসজিদে চিল্লায় বসাতে, আত্মীয়-স্বজন সকলে আমেনা বিবিকেই দোষারোপ করতে লাগলো। তিনি বড় আনন্দ নিয়ে ভাতুষ্পুত্র রাজ্জাক সরকারকে জানিয়েছিলেন,- আমার ছেলে সোলায়মান আজ ছয়দিন ধরে দানাপানি না খেয়ে আল্লাহর ধ্যানে করে চলেছে। আমি খবর নিয়েছি, সেজপুত্র দাউদকে তার কাছে পাঠিয়ে, সে নাকি ক্ষুধা-তৃষ্ঞা বোধ করে না। সোলায়মান নাকি ধ্যানের মধ্যে কোন এক আলোকরশ্মি দেখতে পায়। সে যদি চল্লিশদিন দানাপানি ছাড়া চিল্লায় থাকে, তাহলে আল্লাহপাক তাকে দেখা দিবেনই!

আমেনা বিবি বড়ই গর্বিত, তার পুত্র সোলায়মান মুসা-নবীর মতো ঠ্যাডা। আল্লার দর্শন না পেয়ে সে চিল্লা থেকে ফিরবে না। ভাতুষ্পুত্র রাজ্জাক চিৎকার বলেছিল, ফুপু আপনের পাগলামির কারণে আজ যদি সোলায়মান না খেয়ে মারা যায়, তাহলে তার চার সন্তানের দায়িত্ব কে নেবে? সোলায়মানের কিছু হলে আপনি মা হিসাবে দায়ী থাকবেন! এই কথা শুনে নিজে মসজিদে গিয়ে সপ্তম দিনের দিন ছেলেকে জোর করে খাবার খাওয়ান আমেনা বিবি। আর অন্যদিকে সুলেখার ওপর জ্বীনের আছরও সোলায়মানকে শান্তিমতো চিল্লা শেষ করতে দেয়নি। তাই এইবার, পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা, সোলায়মান এবার এতেকাফে যাবে। তবে, মসজিদে না বরং সুলেখা বিবির পাশের ঘরে। এতে সুলেখা বিবিসহ বাড়ির সব সদস্যদের কার্যকলাপের ওপরও নজর রাখতে পারবেন সোলয়মান।

কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। শরীয়ত মতে, এতেকাফ অর্থ হলো- অবস্থান করা, কোনে স্থানে থেমে যাওয়া। ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায় এতেকাফের অর্থ হলো, জাগতিক সকল কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিবার থেকে পৃথক থেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে একান্তভাবে ইবাদত করার জন্য মসজিদে অবস্থান করা। একজন মুসলিম তার যাবতীয় কার্যক্রম, চিন্তা-চেতনা, কামনা-বাসনা, মেধা ও শ্রমের ব্যবহার এবং নিজ যোগ্যতাকে কিছু দিনের জন্য মহান আল্লাহ-তায়ালার স্মরণে নিয়োজিত করে ঈমান ও আমলকে বৃদ্ধি করবে। এভাবে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হবে বিশুদ্ধ নিয়তে যথাযথ আমলের মাধ্যমে। এতেকাফ গুণাহসমূহ মুছে দেয় এবং নেক আমলের পাল্লা ভারী করে। এইভাবেই সোলায়মান আউলিয়াতে পরিণত হবে, আর মাজারের দায়িত্ব তুলে নেবে কাঁধে।

এইসব তথ্য জানার পর সোলায়মান মিয়া এক সপ্তাহ আগে তার মা আমেনা বিবির সঙ্গে পরামর্শ করেন- কী করা যায়? মা আমেনা বিবিও একজন পয়গম্বর রমনী। তার মতামত অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া, এ মুহুর্তে মা আমেনা বিবিকে খুশি রাখতে পারলে, ভবিষ্যতে স্বয়সম্পত্তিতে একটু বেশি ভাগ বসানোর সুপ্ত আশাও আছে সোলায়মানের। তবে, আমেনা বিবিকে তা বুঝতে দেয়া যাবে না। আমেনা বিবির কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি জানান, মাগরিবের নামাজের পরে তিনি ধ্যানে বসবেন। ধ্যানে আমেনা বিবির পয়গম্বর বাপজান পীর সৈয়দ খাজা বশির চান সরকার তার কাছে আসেন, তিনিই জানাবেন কী করতে হবে।

সেইদিন মাগরিবের নামাজের পর ধ্যান করতে গিয়ে আমেনা বিবি বেহুশ হয়ে যান। আর বেহুশ অবস্থায় বাপজান, বাপজান বলে চিৎকার করতে থাকেন। বাড়ির সবাই মিলে চোখে-মুখে জল ছিটালে আমেনাবিবির জ্ঞান ফিরে। তিনি তার মেজপুত্র সোলায়মানের হাত ধরে কেঁদে ফেলেন। বলেন,- বাবা তোমার নানাজান আসছিলেন আমার স্বপ্নে, সংগে তোমার বাবাও (সুরুজ মিয়া)। তারা বললেন, হায়রে পাগলী, আমরা কি আর শরিয়ত মতে চলার মানুষ? আমরা হলাম মারফতী দুনিয়ার লোক। মারফতী দুনিয়ার প্যাঁচ এই ইহজগতের শরিয়ত মান্যকারীরা বুঝবে না।

সোলায়মানরে বলো, সে যে সংসারী মানুষ, তা আল্লাহ জানেন। তাই আল্লাহপাক-চান সোলায়মান বাড়ির মধ্যে যে ঘরটি কম ব্যবহার করা হয়, সেইখানেই যেন এতেকাফে বসে। আল্লাহ তার ডাক কবুল করবেন!

(চলবে)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.