ইশরাত জাহান ঊর্মি:
রূপা প্রামানিক এর ঘটনা আমাদের মোটামুটি মুখস্ত। বঙ্গদেশে হাজারও রূপার লাশের নিচে এই লাশও চাপা পড়ে যাচ্ছে। অচিরেই আমরা ভুলে যাবো। নতুন রূপা আসবে। আমরা কদিনের জন্য আকুল হবো। আবার লাশ চাপা পরবে। আবার নতুন কেউ আসবে। সেসব লেখাবাহুল্য।
একটা কথা শুধু মনে হচ্ছে। ধর্ষণটাকে আমরা কি করে ধীরে ধীরে সামাজিকীকরণ করে ফেলছি? আমাদের ছোটবেলায় ধর্ষণের শিকার হলে “নারীর ইজ্জত যায়”-এরকম একটি বিষয় ছিল। মেয়েটি মুখ ঢেকে বোরকা পরে পুরো পরিবার গোপনে লজ্জিত ভঙ্গিতে আদালতে যেতো। ব্রিটিশদের বানানো আইন অনুযায়ী কোর্টে যাওয়ার পর পান খেতে খেতে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মেয়েটিকে আইনজীবী প্রশ্ন করে, “মা বলেন তো আপনারে কী কী করছে? কই কই হাত দিসে? একটু দেখান তো মা…” নারী লজ্জায় লাল আর নার্ভাস হতে হতে আরও একবার ধর্ষণের অনুভূতি পাইতো। কিন্তু সেইরকম কোনো মেয়ে আমাদের সমাজ এতো বছরে তৈরি করে নাই যে স্ট্রেট কাপড় খুলে আচড়ের চিহ্ন দেখায়ে বলবে, “আই গট রেপড, এই যে আঘাতের চিহ্ন।”
এখন যেইটা হয়েছে সামাজিক গণমাধ্যমের কারণে -আদালত পর্যন্ত যাওয়া লাগে না, তার আগেই বার কয়েক মেয়েটারে ভার্চুয়ালি ধর্ষণ ঘটে। যেকোনো ঘটনা ঘটার পর থেকেই রেপের বিভিন্ন এ্যাংগেল বের হয়ে যায়। মেয়েটার পোশাক কী ছিল? এতো রাতে বাইরে গেল কেন? বাইরে গেলে কার সাথে গেল? যার সাথে গেল তার সাথে কেন গেল? রাতে একা বাসে উঠলো কোন সাহসে? উঠলোই যখন পুরো ফাঁকা হওয়ার আগে নেমে গেল না কেন? এরপর ধর্ষণের বিচার যারা চাইবেন এই প্রশ্নগুলোর মোকাবিলা করে তারপর চাইবেন।
আর বিচার চাইবেনই বা কেন? কাউরে তো সেরকম চাইতে দেখলাম না। রাজু ভাস্কর্যে আমরা প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিলাম। সেই পরিচিত কয়েকটা মুখ আমরা যথাসম্ভব গলার রগ ফুলিয়ে শুক্রবারের ছুটি ছুটি গন্ধের অপরাহ্নে চিৎকার করলাম। সেই চিৎকার এমনকি কয়েক গজের দূরত্বে রোকেয়া হলেও পৌঁছালো না।
কাজল দাশ লিখেছে, যখন আমরা ধর্ষণের বিচার চাইছিলাম, তখন ওই এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়ানো নারী পুরুষের অধিকাংশ হেসে হেসে চলে যাচ্ছিল। ওই হেসে চলে যাওয়াকে মজ্জাগত পুরুষতন্ত্র বলে। তো, তার এই লেখার নিচে দেখলাম একজন কমেন্ট করেছে, যারা বিচার চাইতে এসেছে তারা সবাই বয়ফ্রেন্ডের সাথে ফ্ল্যাটে রাত কাটায়, তাই সবাই হাসতেছিল। এইবার নারীর চরিত্র নিয়ে কথা তোলার সেই পুরনো কৌশল মিলিয়ে নেন।
দ্বিতীয়ত, আমরা বিচার চাওয়াটারেও সিজনাল এবং শর্তাধীন করে ফেলছি। ওই অনুষ্ঠানে আমার বক্তৃতা দেয়ার একটা ছবি ট্যাগ করেছেন আমাদেরই সতীর্থ লীনা পারভীন আপা। তো, ভালো করে খেয়াল করে দেখি ছবির নিচে একটা ব্যানারে লেখা “প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই”। কেমনে কেমনে আমাদের প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানরে আমরা অকার্যকর ভাবতে শুরু করলাম। কেন সমস্ত দায়দায়িত্ব এবং সমস্ত বিচার-আচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখাপেক্ষি হতে হবে বুঝলাম না।
কেন আসে না এইসব আন্দোলনে মানুষ-এখন মনে হয় সেই কারণ খুঁজে বের করা জরুরি। এতোটা একলা আমরা কেন হয়ে যাচ্ছি? রূপা প্রামানিক সাধারণ ঘরের মেয়ে। পরিবারকে একটা সম্মানজনক অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা দিতে মেয়েটি কাজ করতো। রূপা এইভাবে মরেছে। আমাদের শিরদাঁড়া না থাকা শরীর, তাই রূপা দিল্লীর ‘নির্ভয়া’ হয়ে উঠতে পারেনি।
এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা এক হতে পেরেছিলাম, ইয়াসমিন ধর্ষণ এবং হত্যার বিরুদ্ধে এক হতে পেরেছিলাম-এখন কেন পারছি না? বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর আজকাল না কি ফান্ড সংকট, ফলে তারাও সিনে নাই। ফান্ড নাই, সামাজিক দায়বদ্ধতাও নাই। থাকলেও তড়িঘড়ি করে মানববন্ধনেই তা সীমিত।
তবে একটা কথা কী, রূপা হত্যার বিচার যদি আমরা না করতে পারি, ধর্ষক সব স্বীকার করার পরও ডিএনএ টেস্ট বা ইত্যাদি ইত্যাদি কাহিনীর জন্য আমরা যদি অনন্ত অপেক্ষা করি, তাইলে বিশ্বাস করেন, খুব খারাপ একটা উদাহরণ আমাদের সামনে রয়ে যাবে।