সানজিতা শারমিন:
কিছুদিন আগে একটা লেখা লিখেছিলাম গরু কর্তৃক কিছু এক্সিডেন্ট সংক্রান্ত। তো, সেখানে মূলত আমার সাথে এবং আমার রিলেটিভের সাথে তিনটা ঘটনা উল্লেখ করেছিলাম। এবং একটা পয়েন্টে ছিল একজন মায়ের প্রেগন্যান্ট অবস্থায় তার সাথে খারাপ কিছু ঘটতে যাওয়া একটা বাজে সিচুয়্যেশন নিয়ে। ঘটনা সেটা না, ঘটনা হলো-
সকালে আমার মোটামুটি পরিচিত একজন আমাকে ফেইসবুজ মেসেঞ্জারে কল দিয়ে কুশল সংবাদ জিজ্ঞ্যেস করে আমাকে বললেন, আপনার সেদিনের লেখাটা লিখে পাবলিকলি প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। আমি তো অবাক, কী বলে সে! তখন বললাম ঠিক কোন কথাটা এক্সাক্টলি বলতে চাচ্ছেন? তিনি বললেন, আপনি একজন মায়ের প্রেগন্যান্সি নিয়ে পাবলিকের সামনে বলা ঠিক হয়নি। আমাদের সমাজে তো এসব কথা সামনাসামনি বলাটা ভালো দেখায় না।
আমি বললাম, এখানে তো একটা ঘটতে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা বলা হয়েছে! খারাপ কী আছে বুঝলাম না।
আপনি আমি তো এই অবস্থাটার ফসল। এটা তো গর্বের বিষয়, লজ্জার নয়।
কথাগুলো শেষ করতে পারলাম না নেটওয়ার্ক খারাপ থাকায় অথবা নিজেই লাইন কেটে দিলেন।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবলাম, আমরা কী শিখছি একাডেমী থেকে শ’য়ে শ’য়ে সার্টিফিকেট অর্জন করে আমাদের চারপাশের সভ্য জগত থেকে??
একটা মেয়ের মা হওয়া নারী পুরুষ তথা সমগ্র জাতির জন্য একটা আশীর্বাদস্বরূপ। এই মা হওয়ার প্রসেসিং আছে বলেই আপনি আমি এই সুন্দর নির্মল পৃথিবীতে হাঁটতে পারছি, শ্বাস নিতে পারছি, সম্পর্কের ডালাপালা ছড়াতে পারছি। সর্বোপরি মানবজাতি বলতে যা বোঝায়, তার জন্ম দিতে পারছি।
আর এখানে নাকি প্রেগন্যান্সি খারাপ শব্দ, লজ্জার শব্দ, যা কাউকে বলা যায় না! অথচ এই মা না হওয়ার অক্ষমতার জন্য এই আপনারাই একটা মেয়েকে লাথি দিয়ে সংসার থেকে বের করে দেন। এই আপনার বোনকেই তার স্বামী প্রতিদিন বন্ধ্যা বলে তাকে উঠতে বসতে লাঞ্ছনা করে। আর আমরা মেয়েরা প্রেগন্যান্ট না হলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কী করে তৈরি হবে?
প্রেগন্যান্ট শব্দটাকে কেন লজ্জার বানানো হবে, পিরিয়ড শব্দটাকে কেন নোংরা আর লজ্জার বানানো হবে, কেন? নাকি এই শব্দগুলো মেয়েদের সাথে সম্পৃক্ত বলেই এই শব্দগুলো লজ্জার আর নিচুমানের? কোনটা বলতে চান?
এই শব্দগুলো আছে বলেই আমি কারো মেয়ে, কারো বোন কারো ভবিষ্যৎ মা।
আপনার শুনতে খারাপ লাগলে, আপনার লজ্জা লাগলে, আপনি আপনার কান বন্ধ করে রাখুন, আপনি আমার মতো যারা এই বিষয় নিয়ে বিশদভাবে লিখেছেন তাদেরকে আনফ্রেন্ড, আনফলো, ব্লক করুন। ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ আপনার জন্য এসব অপশন খুলে রেখেছে।
এই সময়টা কতটা যত্নের হওয়া উচিৎ, কতটা সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ, কী কী দুর্ঘটনা ঘটতে পারে নাজুক সময়টাতে, তা জানা উচিৎ, নিজের স্বাস্থ্য পাশাপাশি অনাগত সন্তানের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিৎ। আপনার প্রেগন্যান্ট হওয়ার খবর সবার মাঝে ছড়িয়ে নিজের আনন্দ পাশাপাশি পরিবারের আনন্দ বাড়ানো উচিৎ। এসবই একটা সুস্থ মা আর সুস্থ সন্তানের জন্য সর্বোপরি একটা সুস্থ জাতির জন্য করা উচিৎ। প্রেগন্যান্সির জন্য লজ্জা নয় গর্ব করা উচিৎ।
সমাজে এই মানুষগুলো আছে বলেই তীর্যক কথা কুরুচিপূর্ণ কথা থেকে রেহাই পেতে গ্রামাঞ্চলের মা’রা তাদের নিজেকে গর্ভবতী বলতে লজ্জা পায়।
এসব ব্যবস্থাই একটা মেয়েকে দমিয়ে রাখার পন্থা।
এই ট্যাবুগুলো ভাঙবে তখনই যখন আমরা সত্যিকারের শিক্ষিত হবো। যখন আমাদের জ্ঞানের দীনতা থাকবে না তখনই আমরা অযৌক্তিক লজ্জা থেকে নিজেদের বের করে মঙ্গল হয় নিজের এবং সমাজের এমন কাজ করব এমন ভাবনা ভাববো।
(বিঃদ্রঃ যাদের যা যে ছেলেদের লজ্জা হয় তাদের উচিৎ নিজে আত্মাহুতি দিয়ে জন্মের প্রায়শ্চিত্ত করা।)
সানজিতা শারমিন
একজন মায়ের মেয়ে এবং একজন ভবিষ্যৎ মা।
১০.০৮.২০১৭