নারী, তোমার শরীরের কোন অংশ নিয়ে তুমি লজ্জিত?

শেখ তাসলিমা মুন:

আমরা যখন দেখি একজন মানুষ নগ্ন, তখন চিৎকার করে বলি ‘ও ন্যাংটা’। একজন মানুষের শরীরকে যখন আপদমস্তক কাপড়ে মুড়ে দেই, সেটিও নগ্নতা কিন্তু আমরা সেটি দেখতে পারি না। সেজন্য কেউ চিৎকার করে বলি না, ‘ওই মানুষটাকে তোমরা প্যাকেট করে তাঁর নগ্নতাকে প্রকট করে তুলেছো।’ ‘তোমরা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছ তাকে ঢেকে রাখার কারণ।’ ‘তাঁর প্রতিটি অঙ্গে পাপ। লজ্জা।’ ‘তাঁর প্রতিটি অঙ্গ তোমার কামনার বস্তু!’ যেহেতু তাঁর শরীর দেখে তুমি কামার্ত তাই তোমাদের ধর্মগুরুদের নির্দেশ তাঁকে ঢেকে রাখতে হবে।

কী লজ্জা! কী সীমাহীন ঔদ্ধত্যপূর্ণ এ নির্দেশ! মানুষ হিসেবে আমাকে কতোটা হীন করে দেখলে আমার শরীর নিয়ে অন্যরা এ নির্দেশনামা জারি করতে পারে? ভাবলে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি! ক্রোধে ফেটে পড়ি। আমি মানুষ! কাপড়ের বস্তা তো নই!

একবার আমার এক কলিগ ট্যাটু করে গভীর অনুতাপে পড়লো। সে এখন ট্যাটু তুলবে। কিন্তু তাঁর জন্য অপারেশন করতে হবে। খরচেরও বিষয়। এটি তাঁর মনো যাতনা হয়ে দাঁড়ালো। তখন সে এটি নিয়ে তাঁর মনোচিকিৎসকের কাছে গেল। তিনি বললেন, ‘চাকু ছুরির থেকে বড় অপারেশন আছে।’ ‘সেটি কী?’ ‘তোমার মন। মনে রেজিস্ট্রি করে নাও যে ওটি আর নেই, দেখবে ওটি আর তোমাকে বদার করছে না। এক সময় ওটি নাই হয়ে যাবে তোমার কাছে। তুমি আর দেখতেই পাচ্ছো না’।

প্রশিক্ষণটি মেয়েটির দারুণ কাজে লেগেছিল। মনে রেজিস্ট্রি করা। তার জন্য একটি শিক্ষিত পরিশীলিত মন দরকার। সে মন গঠনের জন্য আমরা কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শিক্ষালয় গড়ে তুলি না। আমরা মনের পাপের চিকিৎসা করতে জানি না জন্য আমরা পাপীকে নয় মানুষকে ‘পাপবস্তুতে’ পরিণত করি।

কষ্ট হয় মেয়েরা যখন তাঁদের এহেন অসম্মানকে বুঝতে সক্ষম না হয়। তাঁদের যুক্তিগুলো ঘুরপাক খায়, ‘শরীর দেখানোর বিষয় নয়। এতে ‘পুরুষ’ বিপথগামী হয়’ ‘আদিম যুগে নারীর শরীরকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছিল, সমাজে অনাচার বেড়েছিল, নারীর অসম্মান বেড়েছিল। মহানবী এসে সে শরীর ঢেকে নারীর সম্মান রক্ষা করেন’, ‘ইসলাম ছাড়া এ সম্মান আর কোনো ধর্মে দেওয়া হয়নি’। ইত্যাদি, কুত্যাদি।

বিষয়টির গোঁড়া আড়াই হাজার বছর আগের একটি সমাজের উপর ভিত্তি করে। আমাদের মেয়েরা কতো সহজে এ বিষয়টি নিজেদের স্কন্ধে কোন ধরনের অসম্মান বোধ না করে মেনে নিচ্ছে দেখে অবাক না শুধু, হতবিহবল হয়ে যাই। সে সমাজে মহানবী ঠিক উল্টোটাও করতে পারতেন! বা নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্য এটা বাধ্যতামূলক করতে পারতেন। সেটি করেননি। নারীর দেহে ঢাকনা। পুরুষদের স্নেহ তিরস্কার করে রেখেছেন। হে পুরুষ, তোমরা তোমাদের চোখ নতজানু করে রাখো!

আড়াই হাজার বছর পার হয়েছে। সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলেছে। ভৌগলিক প্রেক্ষাপট বদলেছে, রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপট বদলেছে, আইনগত প্রেক্ষাপট বদলেছে, শিক্ষাগত প্রেক্ষাপট বদলেছে, মানুষের মনের উৎকর্ষতা বেড়েছে, মানুষের আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানের কনসেপ্ট বদলেছে। কিন্তু আড়াই হাজার বছর আগের ব্যবস্থাটি আক্ষরিকভাবে মেনে চলার নিয়ম ঠিক আছে। আমাদের মেয়েদের ভেতরই প্রশ্ন নেই, কেন তারা এটি মেনে নিচ্ছে! এবং শিক্ষিত মেয়েদেরই ভেতর নেই। একজন ডাক্তার মেয়েকে হিজাব নিকাব পরে বসে থাকতে দেখলে তাঁর মেডিসিনের পুরো শিক্ষাটাকে আমার প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হয়! মনে হয়, সে যা পড়েছে সেটি কি আসলে বুঝেছে? না মুখস্ত করেছে?

ভেবে দেখা যাক তার শরীরের কারণগুলোকে। নারীর শরীর কী কী নিয়ে গঠিত? একজোড়া হাত, একজোড়া পা, একজোড়া স্তন, মুখমণ্ডল, মস্তক। যৌনাঙ্গ মূলত দৃশ্যমান নয়। ছেলেদের শরীরও গঠিত এক জোড়া হাত, একজোড়া পা, মুখমণ্ডল, মস্তক এবং পুরুষাঙ্গ সম্বলিত। নারীর এখানে বেশি অঙ্গ বলতে তাঁর স্তনদয়। যা পোশাকের ভেতর থেকেও অবস্থান চোখ দ্বারা নির্ণয় করা সম্ভব। ঠিক একইভাবে মেয়েদের যৌনাঙ্গ থেকে পুরুষের যৌনাঙ্গের এখানে একটি পার্থক্য স্পষ্ট। পুরুষের পুরুষাঙ্গ নারীর স্তনের মতো পোশাকের ভেতর থেকে আংশিক দৃশ্যমান। উল্লেখ্য, নারীর স্তনের যৌনকাজে ভূমিকা আছে ঠিকই, কিন্তু তার থেকেও বড় ভূমিকা শিশুর খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম হিসেবে। পুরুষের পুরুষাঙ্গ সেক্ষেত্রে মূত্র পরিত্যাগ হলেও যৌন কাজই মুখ্য।

বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্ট হলো, পুরুষ এবং নারী উভয়ের শরীর সমান অ্যাপিলিং একে অপরের কাছে। কিন্তু আমাদের ২৪ ঘণ্টার দিনটি যৌন কাজেই ব্যয় হয় না। একটি নারীকে তাঁর দিনের বৃহৎ অংশ আপাদমস্তক মুড়ে রাখতে হবে। মূলত এর মাধ্যমে তাঁকে একটি যৌন সামগ্রী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা প্রত্যেকটি নারীর জন্য অত্যন্ত অসম্মানের। আর সেটি তাঁদের অনুভূত না হলে হয়ে ওঠে অত্যন্ত বেদনার।

মানুষ সভ্য হয়েছে জন্য মানুষ তাঁর যৌন জীবন অনেক বেশি পরিশীলিত করেছে। মানুষ প্রেম এবং যৌনতার সম্পর্ক বুঝেছে। যৌনতা কেবল আক্রমণ আর আক্রান্ত হবার বিষয় নয় সেটি বুঝেছে। এগুলো সবই সভ্যতার সাথে সাথে মানুষ বুঝতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু একটি ধর্মে নারীকে সম্মানের নামে কাপড়ের মোড়কে মুড়ে অসম্মান করে চলেছে, সেটি নারীরাই বুঝতে সক্ষম নয় সেটিই বড় ট্রাজেডি।

ধরা যাক, স্তনদ্বয়ের যৌনসম্পর্কের কিছুটা ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সেজন্য নারীকে কোন যুক্তিতে সমস্ত শরীর কাপড়ে মুড়ে ফেলতে হবে? তার চুল কী দোষ করলো? তার বাহু কী দোষ করলো? তার গলা কী দোষ করলো? তার পা কী দোষ করলো? সেগুলো পুরুষের যৌন সামগ্রী! এবং পুরো নারীটি! এবং সেজন্য তাঁকে সমস্ত দেহটি আলখেল্লায় ঢেকে ফেলতে হবে। একবারও কি ভেবে দেখেছেন, কতোটা অসম্মান এর ভেতর প্রকট করে তোলা হয় নারীর জন্য? ন্যুনতম চিন্তা শক্তি কাজ করলে তো এটি না বুঝতে পারার কথা নয়!

সমস্যাটা আসলে কোথায়?

নারী বন্ধুরা! যারা টাইট জামা পরছেন, জিন্স পরছেন, টাইট শাড়ি ব্লাউজ পরছেন, খুবই স্বাভাবিক একটি আচরণ করছেন! কিন্তু তার সাথে মাথায় কেন চাদর জড়াচ্ছেন একবার ভাব্বেন? আমি আপনার পোশাকের স্বাধীনতায় হাত দিচ্ছি না। আমি শুধু এ পোশাকটির কার্যকারিতা বিষয়ে জানতে চাচ্ছি। এটি আসলে কী কাজ করছে? আপনার মাথা ঢেকে ফেলছে। সে মাথায় আপনার কিছু চুল আছে। সে চুল আপনি ঢেকে ফেলছেন। সে চুলে এতো নিষিদ্ধতা কী কারণে? আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই! ধর্ম কী বলেছে সেটি নয়!

আমি জানতে চাইছি, এ চাদরটির ফাংশন বিষয়ে! এ চাদরটি আপনার কী ঢাকছে? এবং কেন? এবং এটি ঢাকার আদেশনামার পেছনের কারণটি কী? আপনার যোনি ঢাকা। আপনার স্তন ঢাকা, আপনার নিতম্ব ঢাকা, আপনার উরু ঢাকা, আপনার স্কন্ধ ঢাকা, আপনার বাহু ঢাকা, আপনার পা ঢাকা। এবং আপনার চুল ঢাকা। প্রত্যেকটি কারণ আলাদা আলাদা করুন! প্রশ্ন করুন! কতোটা যৌন সামগ্রী আপনি? ভাবুন, আপনি কতোটা যৌন বিস্ফোরক! এমনকি আপনার চুল কতটা যৌন বিস্ফোরক, সেটা ভাবুন! এবং সেটাকেই আপনি আধুনিক নারী, আপনার শরীরের মোড়কের সবচাইতে দৃশ্যমান অংশ করে তুলেছেন!

কতোটা হাস্যকর ভেবে দেখেছেন? আপনি আপনার এ করুণ পরিণতিতে লজ্জিত নন! অপমানিত নন। আপনি প্রশ্ন করছেন না! আপনি এক নির্লজ্জ আদেশনামা কী লজ্জাজনকভাবে মেনে নিলেন? আপনার ধর্ম পালনে আমার কোনো সমালোচনা নেই। আপনি কেবল এ বস্ত্রখণ্ডটির ব্যবহারের কারণটি নিয়ে ভাবুন? এটি কি কেবল একটি বস্ত্রখণ্ড? আপনার সীমাহীন অসম্মান নয়? এটি ব্যবহারের কারণটি নিদারুণ অপমানকর নয়? যখনই ওটি মানছেন, তখনই নিজেকে মানুষ নয়, সামগ্রী হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। যৌন সামগ্রী হিসেবে! নয়?

আমি শুরু করেছিলাম একটি কথা দিয়ে। মনের প্রশিক্ষণ না নিলে অনাচার জুলুম ধর্ষণ থেকে এ সমাজ মুক্ত হবে না। তনু-মিতুরা হিজাব পরে থাকতো। তাঁরা রক্ষা পায়নি, কারণ তাঁরা জানে নারীদের সাত লেয়ারের পর্দার নিচেও একটা ভ্যাজাইনা আছে। তাদের সেটি চাই। সেজন্য তারা হিজাবি নিকাবি কাউকেই ছাড়বে না। মাদ্রসার ছাত্রীরা হুজুরদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় সবচাইতে বেশি। মাদ্রাসার ছোট ছোট ছেলেরা সিস্টেমেটিকভাবে বলাৎকারের শিকার। এ প্রথা কমপ্লিটলি একটি ব্যর্থ প্রথা! রিয়ালাইজ করুন!

আমি আবার বলবো, একটি একটি করে আলাদা করে দেখুন তো আপনার শরীর! কোন অংশটি লজ্জার? পাপের? আমার দুটি হাত আমার দুটি পা আমার শরীরের অত্যন্ত জরুরি অংশ, তার জন্য যেমন আমি লজ্জিত নই, আমার অন্য কোন অংশই লজ্জা বা পাপের নয়। প্রত্যেকটি অংশের ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজনীয়তা আছে। সেগুলো নিয়েই আমি পূর্ণাঙ্গ একটি মানব শরীরের অধিকারী মানুষ। দৈনন্দিন পোশাকে যতটা আমি আরামদায়ক অনুভব করবো, তার থেকে বেশি ঢাকার কোন কারণ আমার নেই। মনে রাখতে হবে এটি আমার শরীর। অন্যের বারোয়ারি সম্পত্তি না যে তাঁদের অসুবিধা হবে জন্য তা আমার ঢেকে রাখতে হবে!

স্টকহোম, সুইডেন
৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.