আসুন, সম্প্রীতির গল্প শোনাই

অনামিকা রুমি:

আমি আপনাদেরকে আজকে আমার শহরের গল্প বলবো।

৩৬০ আউলিয়ার শহর, শ্রীচৈতন্যের শহর, হাছন রাজা, রাধারমন আর শাহ আবদুল করিমের ছোঁয়াপ্রাপ্ত আমার শহর-সিলেট। বাংলাদেশের কোনো অঞ্চল নিয়ে সবচাইতে বেশি ভুল ধারণা যদি কারো থেকে থাকে তাহলে সেটা মনে হয় সিলেট। সিলেটের মানুষ নিয়ে সারা দেশে নানারকম ভুলভ্রান্তি ধারণা দেখা যায়। যার মধ্যে একটা হলো এই সিলেটের মানুষ নাকি খুব সাম্প্রদায়িক।

জন্ম থেকে এই অঞ্চলে বেড়ে উঠার দরুণ আর কিছু না হোক এটা দাবির সাথে বলতে পারি সিলেটের মানুষ ধর্মভীরু হতে পারে, তবে তাদের সবাইকে সাম্প্রদায়িক কোনভাবেই বলাটা ঠিক না। হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান হয় না, তেমনি ভাল মন্দ সব জায়গাতেই আছে। কিন্তু সিলেট এমন একটা জায়গা যেখানে খারাপের চাইতে ভাল বেশি। এখানে মানুষজন তাদের নিজেদের ধর্ম যেমন পালন করে, ঠিক তেমনি অন্য ধর্মের মানুষের প্রতিও তারা সমান সম্মান দেখায়।

শাহজালাল আর শাহপরানের মাজার যেই শহরে আছে সেই শহরে প্রতিবছর সমান উৎসাহ আর উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে দূর্গা পুজা, প্রবারণা পূর্ণিমা, ক্রিসমাস ডে পালিত হয়। বাংলাদেশের মধ্যে সিলেটই একমাত্র যেখানে প্রতিবছর সরস্বতী পূজা উপলক্ষে শোভাযাত্রা বের হয়। সেখানে সব ধর্মের মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রা দেখে। বাঙ্গালির যেকোনো উৎসব সিলেটের মানুষও সমান উৎসাহে পালন করে।

তবে সারা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া যে সিলেটে এসে পৌঁছায়নি তা অস্বীকার করবো না। কিন্তু সিলেট এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে তুলনামূলকভাবে ভাল আছে, তাও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই কারো।

আমার জন্ম বেড়ে উঠা সব সিলেটে। যখন ছোট ছিলাম এখনকার মত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কি তা বুঝতাম না বা তা নিয়ে এখনকার মত এতো কথাও হতো না। আবছাভাবে মনে পড়ে, আমি তখন খুব ছোট, স্কুলেও পড়ি না,বাবরি মসজিদ নিয়ে খুব ঝামেলা চলছিল সারাদেশে। আমরা তো আবার অন্যদেশের জ্বালা নিয়ে নিজেরা জ্বলতে খুব পছন্দ করি, তাই ভারতের বাবরি মসজিদ নিয়ে দাঙ্গা বাংলাদেশে এসে পৌঁছাতে খুব বেশি একটা সময় নেয়নি। সে এক ভয়াবহ অবস্থা, ঘর থেকে বের হতেও ভয়। আমরা আবার থাকতাম মুসলিম আধ্যুষিত এলাকায়। ভয়টা তাই ছিল একটু বেশি।

এখনো মনে আছে সেই সময়টাতে আমাদের এলাকার বয়স্ক কিছু লোক নামাজ শেষে এসে আমাদের খোঁজ খবর নিতেন। বলতেন, ‘তোমরা ভয় পেও না,আমরা থাকতে এই এলাকায় এসে কেউ তোমাদের কিছু করতে পারবে না’। আসলেও কিছু হয়নি। তখনকার মানুষগুলো হয়তো এই সাম্প্রদায়িকতা অসাম্প্রদায়িকতা কী তেমন বুঝতো না, কিন্তু মানবিকতাটা ঠিকই বুঝতো…হয়তো আমাদের থেকেও বেশি।

আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলের পাশেই এক বান্ধবীর বাসা ছিল। একদিন স্কুল ছুটির পরে তার বাসায় গেলে আন্টি জোর করে খাওয়ার টেবিলে বসিয়ে দেন। আমার প্লেটে মাংস দেওয়া মাত্র আমার বান্ধবী বলে উঠে ‘আম্মা ওতো হিন্দু”। আন্টি সাথে সাথে খাবারের প্লেটটা আমার সামনে থেকে নিয়ে আমাকে এক প্লেট মিষ্টি দিয়ে স্যরি বলে বলেন, “ওর সব বান্ধবী তো মুসলিম তাই বুঝি নাই। আজকে তোমার খাওয়া লাগবে না। অন্যদিন দাওয়াত দিয়ে তোমাকে খাওয়াবো”। আমি ছোট ছিলাম, এতো সব বুঝতাম না। চাইলেই হয়তো আমাকে ওইদিন খুব সহজেই খাওয়ানো যেত, কিন্তু আন্টি সেটা করেননি। আজকাল যখন শুনি অন্যধর্মের মানুষকে লুকিয়ে গরুর মাংস খাওয়ানোটা একটা ফান, তখন মনে হয় আমার সেই বান্ধবির মা হয়তো এতো আধুনিক ছিলেন না, কিন্তু মানবিক ছিলেন অনেক। নিজে ধার্মিক ছিলেন, তেমনি অন্যধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা করতেও জানতেন।

স্কুল কলেজ ভার্সিটি কখনো কোথাও কাউকে দেখিনি ধর্মের ভিত্তিতে বন্ধুত্ব করতে। কখনো কেউ চিন্তা করিনি বন্ধুর ধর্ম কী! চিন্তা করাটা উচিৎও না। আমার প্রায় সব বন্ধু মুসলিম। সাথে আছে দুই একজন বৌদ্ধ। আমরা ঈদ, পুজা, প্রবারণা পূর্ণিমা সব একসাথেই পালন করি। রমজান মাস এলে এক একদিন এক এক ফ্রেন্ডের ইফতার পার্টি, দুর্গা পূজায় সবাই একসাথে পূজা দেখা, সরস্বতী পূজায় একসাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রা দেখা, প্রবারণা পূর্নিমাতে বৌদ্ধ মন্দিরে যাওয়া, সবকিছু আমাদের কাছে একেকটা উৎসব। আমরা যদি বন্ধুর সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে পারি, তাহলে তাদের উৎসবের আনন্দ কেন সেলিব্রেট করতে পারবো না একসাথে?

অসাম্প্রদায়িকতার গল্পে মুক্তিযুদ্ধ না আসলে তা অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমার দাদু স্কুল টিচার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা উনাকে ধরে নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্যে। উনাকে মেরে ফেলবে এমন একটা সময় গ্রামের কিছু লোকজন গিয়ে উনাকে বাঁচায়।

আমার মায়ের ফ্যামিলির প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে ভারতে চলে যান। শুধুমাত্র মার দাদু-দিদিমা উনারা ছিলেন দেশে। মায়ের কাছে শুনেছি মা-দের পাশের বাড়ির মুসলিম চাচারা যারা ছিলেন, তারা নাকি প্রতিদিন এসে বাড়ি পাহারা দিতেন যাতে কেউ কিছু করতে না পারে।

এটাই বাংলাদেশের জন্মের গল্প। এরকম লাখো গল্প আছে বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে। এই বাংলাদেশ ভারত আর পাকিস্তানের মতো ধর্মের ভিত্তিতে স্বাধীন হয় নাই। আমাদের স্বাধীনতার মূল ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা। তাই কিছু হলেই ভারত আর পাকিস্তানের সাথে নিজেদের তুলনা করাটা খুবই হাস্যকর। সেই দেশগুলো ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম হওয়ার পরেও যতটূকু অসাম্প্রদায়িকতা দেখায়, তার থেকে শতগুণ বেশি আমরা যারা ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি নিয়ে স্বাধীন হয়েছিলাম, তাদের মধ্যে থাকা উচিৎ ছিল। ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট এই দুইটা দেশের সাথে আর যাইহোক বাংলাদেশের তুলনা হতে পারে না।

ধর্ম মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরির জন্যে নয়। একজন প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি কখনোই অন্যধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন না আর তাই তো আমার হজ্জ করে আসা স্কুল টিচারের কাছে আমি অন্যধর্মের হওয়া সত্ত্বেও উনার মেয়ে হতে পারি। ম্যাম সবার কাছে বলেন “আমার দুই ছেলে আর এক মেয়ে” কই সেখানে তো ধর্মের কারনে কোন বিভেদ তৈরি হয় না। আমার বৌদ্ধ ধর্মের বান্ধবী আমাকে লক্ষ্মী পূজায় ওর জন্যে প্রার্থনা করতে বলতে পারে ,আমার মুসলিম বন্ধুটাকে আমি বলতে পারি “আমার জন্যে নামাজ পড়ে বেশি বেশি দোয়া করিস” ,আমার মুসলিম বান্ধবি সারারাত জেগে থাকে যাতে শেষ রাতে আমার জন্যে তাহজুদ্দের নামাজ পড়ে দোয়া চাইতে পারে তার সৃষ্টিকর্তার কাছে।

ফেইসবুকে অন্যধর্মের এক বড় ভাইয়া যখন বলেন “কেউ যদি তোকে ধর্ম নিয়ে কিছু বলতে আসে তাইলে কষিয়ে একটা লাথি দিবি আর নিজে যদি দিতে না পারিস তাইলে আমাকে বলিস আমি এসে দিয়ে যাব”, আমার কাছে এটাই আমার বাংলাদেশ।

#BeHumaneFirst

(Published as part of social media campaign to promote secularism in Bangladesh)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.