শাফিনেওয়াজ শিপু:
তুমি তো আমার মেয়ের মতোন বা তুমি তো আমার বোনের লাহান, এগুলো বলে মেয়েদেরকে কৌশলে পটানোর চেষ্টা করা হয় এবং এইদেশে এমন অনেক বাঙালি নারী বা মেয়ে আছে, যারা খুব সহজেই এদের ট্র্যাপে পড়ে যায়।
যাক সেইদিনের ঘটনাটির মাধ্যমে অভিজ্ঞতা হলো, শুধু যে বাংলাদেশে আমরা এইধরনের কথার সম্মুখীন হই, তা নয়, এমনকি বিলেতেও হয়, তাও আবার বাঙালী পুরুষদের দ্বারা। এর আগেও আমার বোন আমাকে বলেছিলো এইখানে বাঙালী নারী বা মেয়েরা বাঙালী পুরুষদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের বাজে কথা বা মন্তব্যের সম্মুখীন হয় রাস্তাঘাটে। কথাটি যখন বলেছিলো আমাকে, তখন খুব একটা বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ মনে হয়েছিল, এটা তো বাংলাদেশ নয়, ইংল্যান্ড। কিন্তু সেইদিন আমার সাথে যখন ঘটনাটি ঘটলো, তখন আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, এইখানেও এইধরনের ঘটনা ঘটে।
খুব অবাক করলো যে ব্যাপারটি, সেটি হলো অন্য কোনো দেশের মানুষের দ্বারা আমরা বাঙালী মেয়েরা সমস্যায় পড়ছি না, বরং নিজের দেশের মানুষের দ্বারাই বাজে মন্তব্য ও নোংরামির শিকার হচ্ছি।
এইখানেই তো বোঝা যাচ্ছে, আমরা বাঙালিরা কখনোই ঠিক হবো না। যতোই উন্নত দেশে থাকি না কেন আমাদের মনমানসিকতা ও চিন্তাভাবনা কখনোই পরিবর্তন হবে না। অনেকের মুখে শুনেছি যখন বাঙালী মেয়েরা ‘রুচিসম্মত পোশাক’ না পরে, তখন নাকি এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়। যদি তাই হয়, তাহলে আমার ক্ষেত্রে কেন হলো?? সেদিন তো মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীরটাই ঢাকা ছিলো আমার সো-কলড ‘রুচিসম্মত পোশাকে’, তারপরও কেন এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে হলো?
এখন হয়তো অনেকেই কথার সুর পরিবর্তন করে বলতে পারে, “আরে মেয়ে মানুষ তো, একটু সাবধানে চলাই ভালো”। কেন সবসময় মেয়েদেরকেই সম্মুখীন হতে হবে এই ধরনের বাজে পরিস্থিতির? কেন আমরা বলি না পুরুষদের দোষ আছে? আসলে আমাদের রক্তের মধ্যেই মিশে আছে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে নারীদের অপমান করা, অবহেলা করা ও নির্যাতন করার অভিপ্রায়। এখনো যখন আমি ঘটনাটির কথা চিন্তা করি, কেমন জানি ভয়ে আমার গা শিউড়ে উঠে। ঘটনাটি শেয়ার করছি এই কারণে যে, কেউ যাতে এদের ট্র্যাপে না পড়ে।
সেইদিন বাসায় ফেরার সময় বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম বাস স্ট্যান্ডে, ঠিক ঐ মুহুর্তে মনে হলো বাংলাদেশে একটা ফোনকল দিয়ে জিজ্ঞেস করি, কেমন কাটলো সবার ঈদ। কথা শেষ হওয়ার পরপরই একজন বয়স্ক লোক আমাকে প্রশ্ন করলো, “বাঙালী নাকি”!
আমি বললাম, “জ্বী”। এরপর আবার বললো, “আসলে তুমি বাংলায় কথা বলছো বলে মনে হলো বাঙালী, তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম।”
তারপর বাসে উঠার পর লোকটি আমার পাশের সিটে বসলো, এবং এরপর শুরু করলো হাজার প্রশ্ন। একটা সময়ে মনে হলো সিটটি পরিবর্তন করে ফেলি। কিন্তু বাসে কোনো খালি সিট ছিলো না বলে আর পরিবর্তন করিনি। যেহেতু ৩০ মিনিটের জার্নি, সুতরাং দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। এরপর কথা বলার মাঝখানে লোকটি আমাকে বলছে, “তোমার ফোন নাম্বারটা দেওয়া যাবে কিনা। তাহলে কোনো বিপদে পড়লে তোমাকে সাহায্য করবো। আসলে তুমি তো আমার মেয়ের মতোন, আর তাছাড়া খুব তো বেশি দিন হয়নি এই দেশে আসছো, সুতরাং কোনো সমস্যায় পড়লে সাহায্য করবো।” ঐ মুহূর্তে লোকটির কথাবার্তা ও বাচনভঙ্গি দেখে খুব একটা পছন্দ হয়নি আমার।
আমি তখন বললাম, “আমি তো আমার পরিবারের সাথেই থাকি, সুতরাং বিপদে পড়লে পরিবার আমাকে সাহায্য করবে।” তখন সে আবার বললো, “আমি তোমাকে পাসপোর্টের ব্যাপারে সাহায্য করবো।”
এরপর আমি বললাম, “আমার পাসপোর্টের দরকার নেই, এবং আমার কোনো পারমানেন্ট ফোন নাম্বারও নেই,”।
তারপরও দেখি লোকটি বার বার ফোন নাম্বার চাচ্ছে, পুরোই নাছোরবান্দা! কিন্তু যখন দেখলাম সে তার গন্তব্যস্থলে না নেমে বরং বসে আছে, তখনি আমার আরো সন্দেহ হলো এই ভেবে যে, লোকটি মনে হয় আমাকে অনুসরণ করছে, আমি যেখানে নামবো, সে ঐখানেই নামবে। প্রথমে কিছু বলিনি, যেহেতু বাপের বয়সী বলেছে, এরপর আর সহ্য করতে না পেরে বলে ফেললাম, “আমাকে বাধ্য করবেন না পুলিশকে কল করতে এবং আপনি কিন্তু প্রথম থেকেই আমাকে অনেক বিরক্ত করছেন”!
এই কথা বলার সাথে সাথে লোকটির ফোন নাম্বার চাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেলো এবং সে সিট পরিবর্তন করে অন্য সিটে গিয়ে বসলো, আর পরের বাস স্টপ এ লোকটি নেমে গেলো। কী আজব দুনিয়া, কোথাও শান্তি নেই। যদি আজকে অন্যদেশের কোনো নারীর সাথে এমন করতো, তাহলে সাথে সাথেই পুলিশ কল করতো। আমি শুধু ভাবলাম বাবার বয়সী লোকটা, থাক, পুলিশ কল করবো না। কিন্তু আবার এই ধরনের কেনো সমস্যায় পড়ি, তাহলে আর দেরি করবো না পুলিশ ডাকতে। এই ধরনের জানোয়াররুপি মানুষগুলো নামেমাত্র এরা উন্নত দেশে থাকে। আর কবে যে এই ধরনের মানুষদের মনমানসিকতা ও চিন্তাচেতনার পরিবর্তন হবে!