তামান্না ইসলাম:
মা একদম বেঁকে বসলেন। ছেলে, মেয়ে দেখাদেখি না করেই বিয়ে! এটা কি একটা ছেলে খেলা? কিন্তু নিতুর একটাই কথা, ‘এতো দেখে কী হবে? যা ভাগ্যে আছে তাই হবে।’ তাছাড়া সময়ও একদম নেই। অনেক ভেবে জামান সাহেব রাজী হয়ে গেলেন। মেয়ের মতের কোনো ঠিক নেই। তার মেয়েটা খুব খেয়ালি, আহ্লাদী আর তার মতোই জেদি। অনেক দিনের চেষ্টায় এই প্রথম মত দিয়েছে। আর ছেলেটাকে তার নির্ঝঞ্ঝাট মনে হচ্ছে। ছেলের পক্ষ খুব ছোটখাট করে বিয়েটা সেরে ফেলতে চায়। বড় করে অনুষ্ঠান করার মতো অবস্থা তারও এখন নেই। অনেকটা জোর করেই রাজিয়াকে রাজী করালেন তিনি। পুরোটা সময় রাজিয়া মুখ ভার করে আছে। অথচ নিতুকে দেখে মনে হচ্ছে একেবারেই নির্বিকার, যেন কিছুতেই কিছু যায় আসে না তার।
সোহেল মাত্র এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে এসেছে। এইবার বিয়ে করে যাবে, বউ নিতে পারবে না। ঠিক হলো, এবার খালি বিয়ে পড়ানো হবে। সোহেলের মা বেশ বৃদ্ধ, গ্রাম থেকে তিনি আসতে পারছেন না। নিতুদের বাসাতেই আক্দ হবে। সোহেল ওর চাচা আর অল্প কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসবে সন্ধ্যায়।
নিতুর মুখটা ভারী মিষ্টি, চোখগুলো কথা বলে। সাজলে ওকে বরাবরই খুব সুন্দর লাগে। পার্লারের সাজে ওকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। ঢলঢলে লাবণ্যের জায়গায় একরাশ কাঠিন্য এসে ভর করেছে। ওকে দেখাচ্ছে একটা মূর্তির মতো। অতিরিক্ত হাসাহাসি করছে বলে সেটাকেও কেমন যেন বেমানান লাগছে। রাজিয়ার মনে হচ্ছে, মেয়েটা এগুলো সবই করছে লোক দেখানো। যেন বিয়েতে সে কত খুশি!
বাড়িতে ছোট পরিসরে আয়োজন, তাই রান্নাটা তিনি নিজেই করছেন। তার রান্নার সুনাম আছে। জামান সাহেব অকারণে ছুটোছুটি করছেন, কাজী ঠিক করা হয়েছে কিনা সেই নিয়ে তার অস্থিরতার শেষ নেই। নিতুর ছোট ভাই জাহিদ সবচেয়ে অবাক হয়েছে এই বিয়েতে। তার রাগী আপুটা এমন ধুম করে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাবে সে এখনো সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না। আপুর একটু নাটক করার অভ্যাস আছে। দেখা যাবে শেষ মুহূর্তে বর আসলে হাসি মুখে যেয়ে বলবে, ‘একটু মজা করতে ইচ্ছে করছিল, কিছু মনে করবেন না। খেয়ে দেয়ে বিদায় হোন।’ সেই মুহূর্তে বাবার চেহারাটা চিন্তা করেই ওর ভয় লাগছে।
বাস্তবে সে রকম কিছুই হলো না। খুব স্বাভাবিকভাবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেল। এমনকি কবুল বলার সময়ও নিতুর গলা একটুও কাঁপলো না। শুধু সোহেলকে দেখে রাজিয়া এবং জাহিদ দুজনেই বেশ হতাশ হলো। ছেলেটা একটু উদ্ধত। সৌজন্যবোধ কম। কেমন চাঁছাছোলা কথাবার্তা, একটু গেঁয়ো। তার আদুরে, রোমান্টিক মেয়েটা পারবে তো এই ছেলের সাথে মানিয়ে নিতে? আপুর বর নিয়ে জাহিদ যেরকম ভাবতো, একসাথে খেলা দেখবে, খেতে যাবে, সোহেলকে দেখে একদমই সেরকম মনে হচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে এই লোক খুব হিসেবি, টিপে টিপে খরচ করে।
যেহেতু শুধু আক্দ হবে, তাই জামান সাহেব আর রাজিয়া ঠিক করে রেখেছিলেন খাওয়ার পরে ওদের দুজনকে কিছুক্ষণ একা কথা বলার সুযোগ করে দেবেন। তার আগেই সোহেলের চাচা জামান সাহেবকে আলাদা ডেকে বললেন, ‘ছেলে আবার কতদিনে ছুটি পায় কে জানে, এতো রাতে যেয়ে হোটেলে থাকবে, তার চেয়ে আজ রাতে এখানেই থেকে যাক।’ জামান সাহেব কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি নিতান্তই ভদ্রলোক, ‘না’ টা সহজে আসে না তার। রাজিয়া কিছুটা হইচই করেছিল। জামান সাহেব তাকে বুঝিয়ে শান্ত করলেন। বিয়ে করে ছেলেটা যেয়ে হোটেলে থাকবে, সেটা কী ভালো দেখায়?
এই ঘটনার জন্য নিতু একদম প্রস্তুত ছিল না। সোহেল নামের মানুষটিকে আজ দেখারও তার কোনো ইচ্ছে ছিল না। দেখা করতেই হবে, সেটা জানা কথা। ঠিক করে রেখেছিল মেপে মেপে উত্তর দেবে। এর বেশি কিছু নয়। তার কিছু জানারও আগ্রহ নেই। যতদিন না তমালের ক্ষতটা সেরে যাচ্ছে, ততদিন এভাবেই চলুক। তারপরে দেখা যাবে। হাতে তো সময় আছে, তাড়া নেই। ছেলেটা বিদেশে থাকায় অনেক সুবিধা হয়েছে। কিন্তু এখন যে সব প্ল্যান অন্যরকম হয়ে গেল। তার মাথা কাজ করছে না একদম।
রাগী, জেদি মেয়েটা খুব স্বাভাবিকভাবে খাটে বসে আছে। নববধূর লজ্জাবনত দৃষ্টিতে নয়। ভেতরে ভেতরে যদিও কাঁপছে। সম্ভবত আজ রাতে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে, কে জানে হয়তো ভয়ঙ্কর কোন অভিজ্ঞতা।
সোহেল কেন যেন গলা খাঁকারি দিতে দিতে রুমে ঢুকলো। ‘সে কী নার্ভাস?’ বাসর রাতের কোন আয়োজন নেই। ফুল নেই। শুধু ওর খালাতো বোন রিনি একটা ভেলভেটের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে আর বিছানার পাশে কিছু প্লাস্টিকের ফুল।
সোহেলকে দেখে মনে হলো না এগুলো নিয়ে তার আদৌ কোন মাথা ব্যথা আছে। রুমে ঢুকেই সে খুব সাবধানে মানিব্যাগটা বালিশের নিচে রাখলো, যেন চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছে। নিতুর খুব অবাক লাগছিল। মানিব্যাগ রাখার সময় নিতুর সাথে চোখাচোখি হলো। এই প্রথম মানুষটাকে দেখলো নিতু। ওর চেয়ে বয়সে অনেক বড় জানতো, কিন্তু দেখতে অতটা বয়স্ক মনে হচ্ছে না। তবে চেহারাটা একটু রাগী ধরনের।
‘স্যরি, আমার খুব জিনিস হারানোর অভ্যাস আছে, তাই ….’ , যেন নিতুকে কৈফিয়ত দিচ্ছে সে।
সোহেলের কথার ধরনে মজা লাগে নিতুর। ‘অসুবিধে নেই’। তাকে আশ্বস্ত করে।
সোহেল যেয়ে বিছানার পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে। বসে বসে পা দুলাতে থাকে বিশ্রীভাবে। হয়তো নার্ভাস বলেই পা দুলাচ্ছে, নিতু নিজেকে বোঝায়। দুজনেই কথা খুঁজে পায় না কিছুক্ষণের জন্য।
‘তোমার নিশ্চয়ই অনেক গরম লাগছে এই শাড়িটাতে, আমার আসলে শাড়ি কেনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই তো। তবে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে এই শাড়িটাতে।’
সোহেলের প্রশংসায় কী একটু ভালো লাগে নিতুর?
নিতুর শাড়িটা একদম পছন্দ হয়নি, খুব বেশি জমকালো, ডিজাইনটাও পুরানো ধাঁচের। সেকথায় না যেয়ে সে পাল্টা জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার বুঝি গরম লাগছে শেরওয়ানি পরে?’ বলে নিজেই অবাক হয়ে যায়।
‘হ্যাঁ, একটু দম আটকে আসছে, এসব পরার অভ্যাস নেই। আমি বরং এটাকে খুলেই রাখি।’ উত্তরের অপেক্ষা না করে সে আসলেই শেরওয়ানি আর পাঞ্জাবি খুলে ফেললো। নিতুর বিরক্ত লাগছে, সেইসাথে সঙ্কোচ আর কিছুটা ভয়।
‘নিতু, হঠাৎ করে বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাছাড়া তোমার আঙ্গুলের মাপও জানি না, আংটি কেনার ইচ্ছে ছিল, হয়নি, আপাতত তুমি এটা রাখো’, বলেই নিতুর হাতটা তুলে নিয়ে সেখানে কিছু টাকা গুঁজে দেয় সোহেল।
সেই স্পর্শে কি কিছুটা কেঁপে ওঠে নিতু, হঠাৎ করেই তমালের কথা খুব মনে হয়,’ও এখন কী করছে?’
তবে বাসর রাতে টাকা উপহার পেয়ে একটা বড়সড় ধাক্কা খায় নিতু। তার সুক্ষ্ম রুচিবোধ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কপালটা কি কুঁচকে গিয়েছিল নিজের অজান্তে? লোকটাকে একদম বুঝতে পারছে না সে।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন বুঝে নেয় সোহেল। হাতটা বুঁজে দিয়ে বলে, ‘তুমি শুয়ে পরো। অনেক ধকল গেছে। আমারও খুব ক্লান্ত লাগছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।’
নিতুর এবার খারাপ লাগে কেন যেন। হাজার হলেও এই লোকটার তো কোন দোষ নেই, তার তো বাসর রাত। হয়তো তার অনেক স্বপ্ন ছিল। আস্তে করে বলে,’আপনি ওপাশটায় শুয়ে পড়ুন। টেবিল ফ্যানটা ঘুরিয়ে নিলে বাতাস পাবেন জোরে।’
সোহেল বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে শুয়ে পড়ে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। ওর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা হলো না। নিতুর দুচোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই। নিজেকে একদম বুঝতে পারে না সে। সোহেল যে আজ রাতে তাকে সুযোগ পেয়েও স্বামীর অধিকার খাটাতে আসেনি, সেজন্য সে কৃতজ্ঞবোধ করছে। আবার একই সাথে, বুকের ভিতরে এক বিরাট শূন্যতা। কতো স্বপ্ন ছিল এই রাতটাকে নিয়ে।
আচ্ছা, তার জীবনে যদি তমালের কোনো অস্তিত্ব না থাকতো? তাহলে কি আজ রাতটা অন্যরকম হতো? সোহেল যখন টাকা দেওয়ার সময় তাকে স্পর্শ করেছিল, সে যদি ওরকম কাঠ না হয়ে থাকতো, তাহলে কি সে আরেকটু আগাতো? নিতুর মুখটা দুহাতে তুলে নিত? নিজের লিপস্টিকে রাঙ্গানো ঠোঁট দুটোতে আঙ্গুল দিয়ে ওর দুচোখের কোনায় দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। একটা উষ্ণ চুম্বন ছাড়া শেষ হচ্ছে একটা বাসর রাত। শুরু হতে যাচ্ছে ভালোবাসাবিহীন দাম্পত্য।