আসুন, সম্প্রীতির গল্প শোনাই-২

দিদারুল আলম:

বন্ধু,

কেমন আছিস তুই?

কাল মনসা পুজো নিশ্চয়ই হাওড়ার বাজার থেকে এক বড় ছাগল কিনে তোর ছেলেকে রশি হাতে দিয়ে পেছন পেছন হাঁটতেছিস। যেমন করে তোর বাবা রামদাস হাট থেকে ছাগল নিয়ে আসতো। মনে আছে তোর, আমরা মুসলিম বলে কেউ পাঁঠার মাংস খেত না, কিন্তু ইন্দিরা দিদির চাপাচাপিতে আমাকে খেতে হতো। তুই ঢং করে বলতিস, স্কুলের সবাইকে বলে দিবি। তোকে আমি চেপে ধরতাম, তোর মুখ দিয়ে রাম লক্ষণের দিব্বি আদায় করে ছেড়ে দিতাম। ইন্দিরাদিকে বলতাম, দিদি তুমি আমাকে এতো ভালবাস কেন? সে তোকে আর আমাকে একজোড়া করে সামনে আয়না ধরতো আর বলতো আমার ছোট ভাই নকুল আর তোর মধ্যে তফাৎ দেখা তো? দিদির প্রশ্নে তোর হিংসে হতো কিনা জানি না, কিন্তু তুই কিছু একটা ভাবতিস।

একদিন খুব ভোরে আমি তোকে ডাকতে ডাকতে একেবারে তোদের ঠাকুর ঘরে উপস্থিত। কাকিমা পুজোয় ব্যস্ত, হাতের ইশারায় আমাকে থামতে বলে পুজো শেষ করে আমার মুখে ধূপ দিয়ে একটু করে প্রসাদ খাইয়ে দিল, তোকে যেমন খাওয়ায়। আমি কাকিকে প্রণাম করলাম, তুই যেভাবে করতিস। আচ্ছা, নকুল, কাকি কি এখনো আছে? নকুল কাল মনসা পুজো, ছাগল কাটার আগে আমি যেখানেই থাকি তুই আমাকে খুঁজে নিয়ে আসতি। কাল কি আমাকে মনে পড়বে তোর? তুই, ইন্দিরাদি, কাকি যেদিন ঢাকা যাওয়ার নাম করে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিচ্ছিস সেদিন আমি বাড়িতে ছিলাম না, দুদিন পর এসে শুনি, তুই নেই, বিশ্বাস কর অনেক কেঁদেছি।

যেদিন তুই ইন্দিরাদিসহ কোকদণ্ডি আশ্রমে গেলাম, ঐদিন একদল মৌলভী আশ্রমের গেইটের উপর থাকা গরুর মূর্তিটা ভেঙে ফেলে। ইন্দিরাদি খুব কাঁদছিল, তুই আর আমি ভয়ে জড়সড়। ঐ মৌলভীদের দলে আমাদের হুজুরও ছিল। তুই আমাকে বলেছিলি, দেখ তোদের হুজুরও আছে। আমি ইন্দিরাদির মুখের দিকে চেয়ে বিব্রত হচ্ছিলাম। ইন্দিরাদি আর তোকে হেচঁকা টানে নিয়ে এসেছিলাম। তোর মনে পড়ে, দিদি যখন হারমোনিয়াম শেখাতো, আমি বার বার এলোমেলো চাপতাম দিদি সাতটি কাগজের টুকরোয় সারেগামা লিখে কাগজগুলি হারমোনিয়াম এর বটমে সেট করে দিত। তুই হাসতি আর দিদি সরে পড়লে কাগজগুলি এলোমেলো করে দিতি আমি বটম চাপলে এলোমেলো সুর উঠতো দিদি দৌড়ে এসে তোকেই কিন্তু বকে দিত।

দিদির সাথে কিন্তু পরশদার একটা সম্পর্ক ছিল। জানিস পরশদা তোরা চলে যাওয়ার পর থেকে সেই যে গেল, আর ফিরে আসে নাই। কাল নিশ্চয় ইন্দিরাদি আসবে ওকে প্রণাম জানাবি। তোর মনে পড়ে দুজন পালেগ্রামে দূর্গা পুজায় গেলাম ধুপের কলকি নিয়ে আমাকে নাচতে বলেছিলি, আমি নাচলাম তোর পায়ের সমস্যা, তাই তুই দাঁড়িয়ে রইলি, তোর পিসির মেয়ে চৈতী বলেছিল, মুসলিমের ছেলে হয়ে ও নাচছে, এটা শুনে তুই চৈতীকে থাপ্পর মারলি। চৈতীর সাথে দেখা হয়, ও সীতাকুণ্ডের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে। নকুল এঁরা দেশে আছে, খুব ভালো আছেন। কাকা চলে গেল কেন আমার মাথায় আসে না।

ওই দেশকে কি তুই তোর দেশ বলিস? আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি এর পরিবর্তে কী সারা জাহা মে আচ্ছা ভারত হামারা এটা বলিস? খুব জানতে ইচ্ছে করে রে নকুল! তোর মনে পড়ে আমাদের বাসায় গেলে মা নামাজ পড়বার সময় আমি উঁচু গলায় কথা বল্লে তুই বলতিস, “আস্তে কথা বল কাকী নামাজে”। তোর হাজার স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। নকুল, ধর্ম, সম্প্রদায়, আমাদের আলাদা করেনি, নষ্ট রাজনীতির স্বৈরাচারী মনোভাব আমাদের আলাদা করেছে। জানিনা এই চিঠি তোর নজরে আসবে কিনা, যদি আসে মনে করবি এই এক বিরহ গাঁথা। ভালো থাকিস ।

ইতি
তোর ফেলে যাওয়া বন্ধু, দিদার, বাঁশখালী চট্টগ্রাম।

(As part of Social Media Campaign-A Humane First Movement initiative to promote secularism in Bangladesh)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.