মেয়েদের জীবনে ধর্ষণই শেষ কথা নয়

শিল্পী জলি:

কিছুদিন ধরেই নারীবাদী মেয়েদের লেখা নিয়ে বেশ কটাক্ষ করা হচ্ছিল। পড়ছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম তাদের চিন্তাধারার গতিপ্রকৃতি দেখে। অবশেষে বাসে রূপার গণধর্ষণ এবং হত্যার পর দেখলাম কয়েকজন ছেলে লিখেছেন, মেয়ে কর্তৃক ছেলে বা যুবক বেলায় তাদের ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার কথা এবং জানতে চেয়েছেন, এই বিষয়ে নারীবাদীদের মতামত কী?

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের পঁচিশ/ছাব্বিশ বছরের একটি মেয়ে জীবন গড়তে অবিরত ছুটে চলছিল। নারীদের জন্যে একা চলাচল অনিরাপদ জেনেও তার কোনো উপায় ছিল না ঝুঁকি না নিয়ে। পরিবারও তার দিকে তাকিয়ে ছিল কবে প্রতিষ্ঠিত হবে সে? তেমন করে জীবনকেও তার উপভোগ করা হয়নি, বাঁচা হয়নি। হয়তো ভাবছিল, আরতো মাত্র ক’দিন কষ্ট করতে হবে। তারপরই বাঁচার আনন্দ উপভোগ করবে– ঘর বাঁধবে, পরিবার দেখবে, মানুষের সেবা করবে, আরও কতো কী!
অতঃপর ঠিকানাহীন একটি লাশে পরিণত হলো!

সে বুঝে গিয়েছিল, আজ তার নিস্তার নেই। তাই সম্ভ্রম রক্ষা করতে সাথের পাঁচ হাজার টাকাসহ সেলফোনটিও সে দিয়ে দিতে চেয়েছিল। ঐ পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে ধর্ষকরা চাইলেই পতিতালয়ে যেতে পারতো, কিন্তু সেই ধার তারা ধারেনি। পাঁচজন লোকের একজনেরও মনে হয়নি ঐ মেয়েটিও একটি মানুষ। তার জীবনেরও মূল্য আছে এবং তাদের একমাত্র ধর্ম হলো নিরাপদে প্রতিটি যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া।
একটি দেশের পরিবহন ব্যবস্থার যদি কোনো নীতি না থাকে, তাহলে আজ রূপার ধর্ষণ হলো, কাল আরেক রূপার হবে। পরশু হয়তো ছেলেদেরও–কার কী হয়, বলা মুশকিল।
শুধু কি ধর্ষণ?

চাইলে ছিনতাই, ডাকাতি, খুন ছাড়াও আরও কত কী করা সম্ভব, কে জানে!

ক্যান্টনমেন্টের মতো সুরক্ষিত এলাকায় তনু হত্যার বিচারহীনতা জাতিকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে, আমাদের দেশে ধর্ষণে তেমন কিছু হয় না। ফলে আজকাল দলবদ্ধভাবে রামপুরাতেও ঘরে ঢুকে লোক ধর্ষণ ঘটিয়ে আসে। ঐ ঘরে নারী আছে কল্পনাতেই তারা উত্তেজিত হয়ে যান। বুক ও মাথা বা হিজাব-নিকাবও এখন আর দেখার দরকার হয় না। তথাপি ফেবুতে কিছু ছেলে মশকরা করছেন, নারীবাদীরা কী বলতে চায় নারী ধর্ষকের ব্যাপারে?

দেশের অধিকাংশ লোকের ক্ষেত্রেই ধর্ষণ যতক্ষণ নিজের পরিবারে না ঘটে, ততক্ষণ ধর্ষণে অনেকেরই হয়তো কিছু যায় আসে না। হয়তো বিষয়টি উত্তেজনাকর মনে হয়। ধর্ষণ যখন নিজের বাড়িতে ঘটে তাহলেই টনক নড়ে। নারীবাদীরা বলতে চায়, সময় থাকতে জাতিকে সাবধান হতে। আজ একজনের বাসায় হলো এটা বন্ধ করতে সোচ্চার না হলে কাল আপনাদের বাসায় ঘটতে কতক্ষণ!

ইতিমধ্যেই বাড়িতে ঢুকে হামলা তো শুরু হয়ে গিয়েছে ধর্ষণকর্ম।
একটি ভিডিওতে দেখলাম পিনাকী ভট্টাচার্য বলছেন, নারীবাদীদের বিষয়ে তার মূল আপত্তি হলো, তারা শুধু সেক্স বিষয়ে দাবি-দাওয়া চালায়, কথা বলে।
এতে কোনো কোনো নারীবাদী আবার বেশ লজ্জায় লজ্জিত হয়ে বলেছেন, ওমা, শুধু সেক্স কেন, আরও কত কথা লিখি আমরা। সেক্সই আমাদের মূল বিষয়বস্তু নয়।

এখনও তারা সেক্স বিষয় এলেই একেবারে কুঁকড়ে যান, সংকোচ এসে জেঁকে ধরে। অথচ নারীপুরুষের ভিন্নতা এবং দাবি-দাওয়া ঐ এক সেক্সের ভিন্নতার সূত্র ধরেই। পুরুষ নারীর মুখ আজীবন বন্ধ রাখতে চায়, আবার নারীও সংঙ্কুচিত থাকে বিষয়টি নিয়ে। শুধুমাত্র এক সেক্স যন্ত্রের সুরক্ষা করতে নারী তার জীবন যৌবন উৎসর্গ করে দেয়, তবুও হয়তো শেষ রক্ষা হয় না।

আজও দেশে ধর্ষণের সময়ে একটি মেয়ে জীবন বাঁচাবার কথা না ভেবে, ভাবে তার সেক্স অঙ্গটি যেন অক্ষত থাকে। অনিচ্ছায়ও তার ভার্জিনিটি খোয়া গেলে তার জীবন মৃত লাশ হয়ে যায়। দেশীয় ধ্যানধারণা শৈশবেই এই ধারণার বীজটি সার-মাটি দিয়ে ভালো করে প্রতিটি নারীর হৃদয়ে বপণ করে দেয়া হয়। আর সে ভুলে যায় তার মানুষের পরিচয়টি। ভুলে যায়, কোনো মানুষের একটি অঙ্গ কখনও তার পুরো জীবন নির্ধারক নয়, জীবনের মূল্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
রূপা চাইলে হয়তো বাঁচতেও পারতো! ধর্ষণ ঘটে যাবার পরও যদি সেদিন সে কোনমতে শুধু জান বাঁচাবার কথাটি ভাবতো! যদি সাময়িকভাবে আবেগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে একটু ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্হিতিকে হ্যান্ডেল করতো। সেদিন পাঁচজনের সাথে যুদ্ধ করে ধর্ষণকে রোধ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে অনেক ধর্ষকই ধর্ষণ করলেও খুনের দায়িত্ব বহন করতে চায় না। আর ঐ বিষয়টিতেই তার কিছুটা বার্গেন করার অপশন ছিল। কিন্তু সে ঐ সময়টিতে ইমোশন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে জীবন বাঁচাবার কথাটি ভাবতে পারেনি, চিৎকার করেছে যদিও প্রতিটি ধর্ষণেই প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকে তীব্র।

আমেরিকার একটি মেয়ে গাড়ি নষ্ট হয়েছে শুনে এক কলিগকে রাইড দিয়ে উপকার করতে গিয়ে ধর্ষিতা হয়। তাকে রেপের পর লাঠি দিয়ে মেরে হাড়গোড় ভেঙ্গে বুট পরা পায়ে পাড়িয়ে মুখ থেঁতলে দেয়া হয়। অতঃপর মৃত ভেবে ফেলে দেয় নির্জন এক মাঠে। এক মুখেই তার পঁচিশ/ত্রিশটি সার্জারি লেগেছে। চোখের দৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবুও বাঁচার বাসনায় বেঁচে যান তিনি।

টেক্সাসে ব্রিজেট কেলি নামে আরেকজন তরুণী শিক্ষিকাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে তিনবার গুলি করা হয়। সেও বেঁচে যায় বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় এবং মনের জোরে মাথা ঠাণ্ডা রেখে।
আরেকজন মাকে তার তিন বছর এবং দেড় বছরের বাচ্চাকে জিম্মি করে তাদের সামনে রেপ করা হয় তারই গাড়িতে, যেনো মা কোনো প্রতিরোধ গড়ার সুযোগ না পায়। এমনকি ধর্ষণের সময় তাকে বলা হয়, সারা জীবন যতবার তোর ছেলের চোখের দিকে তাকাবি, ততবার তোর এই রেপের কথা মনে পড়বে! সেই মেয়েটিই এখন আইন বদলে দিয়েছেন — ক্রাইসিস সেন্টার খুলেছেন যেনো রেপ ভিকটিমদের সেবা দিতে পারেন, ডাক্তারি পরীক্ষায় সহজতা এনেছেন।

এদের প্রত্যেকেই এখন বিখ্যাত এবং সন্মানিত সমাজে জনসেবামূলক কাজে বিশেষ অবদান রাখার জন্যে। আবার কেউবা লেখিকা।
কষ্টকে তারা শক্তিতে রূপান্তর করেছেন। তাদের সবারই একটি বিষয়ে ভীষণ মিল ছিল–ধর্ষণের সময়ে তারা প্রত্যেকেই ভেবেছেন এভাবে মরতে পারি না, যেভাবেই হোক বাঁচতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে।
মেয়েদের জীবনে ধর্ষণই শেষ কথা নয়!

একটি লেখায় পড়লাম, এক বিখ্যাত পুরুষ লোক লিখেছিলেন, পুরুষ নারীর চেয়ে উত্তম, তাই তাদের যৌনাঙ্গ বহিঃমুর্খী। আর নারী অধম বলে তাদের যৌনাঙ্গ গহ্বরে। কোনো কোনো ধর্মীয় গ্রন্থতেও নারীকে নাকি নিকৃষ্ট বলা হয়।
পরিবার এবং রাষ্ট্রেও ছেলেদের সুবিধাদি বেশী। আবার তারা ধর্ষণ করলেও বদনাম হয় শুধু ধর্ষিতা নারীর। সেই চাপিয়ে দেয়া বদনামের ভয়ে ঐ ধর্ষককেই আবার বিয়ে করতে চায় কোন কোন নারী যেনো বারবার ধর্ষিতা হওয়াও সম্মানজনক ঘটনা! রাষ্ট্রও তেমন আইন করে দেয়। আর এই দর্শনে দীক্ষিত হয় জাতি। অতঃপর সাড়ে সর্বনাশ।

সম্প্রতি ভোলাতে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নবম শ্রেণির সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক মেয়েকে একবার ধর্ষণ করে পরে বিয়ের কথা বলে বাড়িতে গিয়ে পরিবারকে সাক্ষী রেখে বার বার ধর্ষণ করে এসেছে। এভাবে ধর্ষণ করে করেই তার মন ভরে গিয়েছে–এখন আর বিয়ে করবে না সে। ফলে পুরো পরিবারেরই মাথায় বাজ পড়েছে, ধর্ষককে জামাই করতে না পারার দুঃখে।

ছেলেরা স্ব-ইচ্ছেয় বার বার ধর্ষণ করলেও তাদের উক্ত অঙ্গের কোনো ক্ষতি নেই, কোনো বদনাম নেই। অথচ শুধু দুনিয়ার নারীই নয়, বেহেশতের হুরদের ক্ষেত্রেও তার ভার্জিনিটি বড় গুরুত্বের সাথে নির্ধারণ করে দিয়েছেন পুরুষকূল। তাই পরকালেও এক পুরুষের ভাগে সত্তরজন ভার্জিন হুরের আগমন ঘটবে, আর তারা শুধু সেবাদাসীর মতো ভার্জিনিটি হারাবেন।

দেখা যায় ইহকাল-পরকাল সবকালেই ছেলেদের জীবন শুধুই সেক্স নির্ভর। তারা এক নারীকে ভোগ করে ধরবে আরেক নারীকে। কেননা বড় বেশি শক্তিশালী। আর নারী তাদের কাছে একেবারে নস্যি।
আসলেই কী তাই?

একান্তে বসে কোনো পুরুষই কী কখনও নিজেকে ততোটা শক্তিশালী, এবং ক্ষমতাধর মনে করেন?
নাকি বার বার মনে হয়, আমার থেকে পাশের বাড়ির মজিদ বেপারিই বেশি শক্তিশালী!
অথবা রুস্তুম বেটা?

নারীর অঙ্গ যতই গহ্বরে থাক না কেন, তাদের চিন্তা, চেতনা, জীবন-যাপন শুধু যৌনাঙ্গ নির্ভর নয়। মানসিক দিক দিয়েও তারা বড় মজবুত।

পুরুষের জীবনে তার যৌনাঙ্গ, যৌনজীবন, এবং এর কার্যকরণ তার আত্মবিশ্বাসের সূচক, ধারক, এবং বাহক। অথচ বলতে গেলে প্রতিটি পুরুষই কোন না কোন ধরনের সমস্যায় জর্জরিত ঐ বহির্মুখী যৌনাঙ্গের কারণেই। তাইতো সে নারীকে বার বার হাজারও বিধিনিষেধে বেঁধে নানাভাবে কন্ট্রোলে রাখতে পাঁয়তারা করে যেন সে আজীবনই আলোর মুখ না দেখতে পায়। আনাড়ি থাকে, অন্য কাউকে যেনো আর জানার সুযোগ না পায়। কিন্তু মানুষ কতকাল বোকা থাকে?

সারা বিশ্ব জুড়েই ফোরপ্লে বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে। অন্য কথায় রঙ্গরসে নারীকে বশীকরণ। শিক্ষিত সমাজে একজন শক্তিশালী পুরুষ নারীপুরুষের সম্পর্কে ভারসাম্য আনতে আজও বিষয়টির আশ্রয় নেন। আর বর্বর সমাজে নারীকে হাজারও বিধি-নিষেধে বেঁধে কন্ট্রোল করতে তার কোমড় ভেঙে দেবার চেষ্টা চলে আর সে দিন দিন মজবুত হয়। অথচ প্রতিটি নারীই জন্মগতভাবে গিভিং। তাই প্রত্যেকেই আপনা আপনি সম্পর্কে সমঝোতা করে। নারীবাদীরাও এর বাইরে নয়।
তারা লৈঙ্গিক সমতার কথা বললেও সমঝোতার পাশাপাশি সংসারের দায়িত্বও কাঁধে নেয়।

সমাজে নারী-পুরুষের স্বাধীনতা, সমতার ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত না হলে, নারীর সুরক্ষা থাকে না। জীবনে পথ চলা কঠিণ হয়, পদে পদে বাঁধার সন্মুখীন হতে হয় তাকে।
নারীবাদ ওখানেই সক্রিয়।

নারীবাদী মানেই ভোগবাদী নয়, পুরুষকে দমন নয়, বরং মানবতার আহ্বান।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.