নাসরীন মুস্তাফা:
হিমু রূপাকে কখনো চিঠি লেখেনি। একবার হঠাৎ একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে হলো। লিখতে বসে দেখে, কী লিখবে ভেবে পাচ্ছে না। অনেকবার করে একটি লাইন লিখলো- ‘রূপা, তুমি কেমন আছ?’ সমস্ত পাতা জুড়ে একটিমাত্র বাক্য।
সেই চিঠির উত্তরে রূপা খুব রাগ করে লিখলো- তুমি এতো পাগল কেন? এতোদিন পর একটি চিঠি লিখলে- তার মধ্যেও পাগলামি। কেন এমন করো? তুমি কী ভাবো এইসব পাগলামি দেখে আমি তোমাকে আরো বেশি ভালবাসবো? তোমার কাছে আমি হাতজোড় করছি- স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করো। ঐদিন দেখলাম দুপুরের কড়া রোদে কেমন পাগলের মতো হাঁটছো। বিড়বিড় করে আবার কী – সব যেন বলছো। দেখে আমার কান্না পেয়ে গেল। তোমার কী সমস্যা তুমি আমাকে বলো।
হিমুর সমস্যার কথা রূপাকে কি হিমু বলতে পারে? হিমু কি বলতে পারে কেন সে সারাদিন পথে পথে ঘোরে। মহাপুরুষ হবার সাধনায় হিমু যে কেবল পুরুষ খোঁজে। পুরুষ, যে হারকিউলিসের মতো কাপুরুষ অপুরুষদের সাথে যুদ্ধ করে পথ গড়ে দেয় স্বর্গে যাওয়ার। পুরুষ, যে প্রমিথিউসের মতো বিশুদ্ধ আগুনে পবিত্র রাখে নিজেকে। পুরুষ, যে হাজার বছর ধরে বরফগলা নদীতে সাঁতরে তুলে আনে নীল পদ্ম।
হারকিউলিসের বানানো পথ হিমুর চাই। কেননা, ও পথ রূপার জন্য। ও পথে রূপা বাসে চড়বে, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলেও সে বাস দিব্যি রূপাকে (জীবন্ত রূপাকে) নিয়ে পৌঁছে যাবে বগুড়া।
বিশুদ্ধ আগুনে পবিত্র প্রমিথিউসকে হিমু চায়। রূপা যেখানে যেখানে যায়, সেখানেই থাকবে প্রমিথিউস। পথে থাকবে। বাসের ভেতরেও থাকবে, টাঙ্গাইলে থাকবে। বগুড়ায় থাকবে। ক্যান্টনমেন্টের ভেতর— বাইরে—মায়ের কোলে—মায়ের গর্ভের ভেতর, মোট কথা, রূপা যখন যেখানে যেমন যতটুকু থাকে, হিমু চায় প্রমিথিউসের বিশুদ্ধ ভালবাসা ঘিরে থাক্ রূপাকে।
হাজার বছর ধরে বরফগলা নদীতে সাঁতরে তুলে আনা নীল পদ্ম চায় হিমু। রূপার চুলের খোঁপায় পরিয়ে দেবে কোন এক চান্নিপসর রাতে। সেই যখন, রূপা বাস থেকে নেমে বগুড়া শহরে পা রাখে। একবার শুধু থমকে দাঁড়িয়ে। তার চোখে গভীর মায়া ও গাঢ় বিষাদ। এই তরুনীটির ঘাড় মটকানো, মাথা থেঁতলানো, গলা টিপে ধরায় বেরিয়ে আছে জিভ্ বেশ খানিকটা।
তা-ই কি?
অস্থির হিমু তরঙ্গিনী স্টোর থেকে সত্যিকারের রূপাকে টেলিফোন করে। বলবে- রূপা, তুমি কিএÿুণি নীল রঙের একটা শাড়ি পরে তোমাদের ছাদে উঠে কার্নিশ ধরে নিচের দিকে তাকাবে? তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একটুখানি দাঁড়াও। আমি তোমাদের বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাবো।
হিমু জানে, রূপা হিমুর কথা বিশ্বাস করে না, তবুও বোধহয় যত্ন করে শাড়ি পরবে। চুল বাঁধবে। চোখে কাজলের ছোঁয়া লাগিয়ে ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়ায়। রূপা অপেক্ষা করে। হিমু কখনো যায় না।
হিমুকে তো আর-দশটা সাধারণ ছেলের মতো হলে চলবে না। হিমুকে হতে হবে অসাধারণ। মহাপুরুষ হওয়ার সাধনায় হিমু সারাদিন হাঁটে। হিমুর পথ শেষ হয় না। হিমুর পথ কখনোই হারকিউলিসের পথ হয়ে ওঠে না। আর তাই যে পথে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে দুমড়ে মুচড়ে মরে পড়ে আছে রূপা, সে পথে হিমুর পা পড়ে না। রূপা সত্যিই নীল শাড়ি পরে ছাদে উঠতে পেরেছিল কি না, সে খোঁজ নেওয়ার সময় নেই হিমুর। প্রমিথিউস রূপাকে আগুনে পোড়াল না সেদ্ধ করল, সে খবর নেওয়ার সময় নেই হিমুর। গন্তব্যহীন গন্তব্য হিমুর, তাই সে নারীবাদ বোঝে না। রূপাকে কেন বাড়ি থেকে বেরুতে হয়, কেন রাতের বেলা বাসে উঠতে হয়, কেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যুদ্ধ করতে হয়, হিমুর সেসব বুঝে ওঠার আগ্রহ নেই।
রূপা অপেক্ষা করে। হিমু কখনো যায় না। হিমু জানে, হিমুর জন্য রূপা আছে।
হায়, রূপার জন্য হিমু নেই। তাই পথে নেই হলুদ পাঞ্জাবির ছায়া। প্রেম কেবলি কাম হয়ে ওঠে, কেবলি শরীর, কেবলি শরীর—রূপা মরে যাওয়ার আগে প্রশ্নটা রেখে যায়, কেবলি শরীর? কোথাও কি মন বলে কিছু নেই? পুরুষের?
মন কি হিমুরও নেই?
রূপা জানতে চেয়েছিল শেষ নিঃশ্বাসের ঠিক আগে।