নারীবাদের বিস্তৃতি যে কারণে প্রয়োজন

কাকলী তালুকদার:

এক নামী-দামী বিত্তশালী লোকের মাথায় ব্যথা। দিনকে দিন সেই ব্যথা চরমে উঠলো। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বললেন, নিউরো স্পেশালিস্টের কাছে যেতে। শেষ পর্যন্ত নিউরো স্পেশালিস্ট পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন সেই বিত্তশালী লোকের ব্রেইন টিউমার। মেডিসিন বিশেষজ্ঞর কিছুই করার নেই। অপারেশন ছাড়া উপায় নেই তবে সেই অপারেশনের পর রুগীর কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে।

আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত নারী/মেয়ে শিশুর উপর ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, হত্যাকে যারা মানবতার কাতারে ফেলে বিচার করতে চান তাদেরকে আমি খুব একটা দোষ দেই না।তারা খুবই উদার মনের মানুষ বা তারা মানবিক শব্দটিকে ডাল ভাতের মতো খুব সাধারণ বলেই মানেন। অনেকটা আমাদের দেশের গণতন্ত্র চর্চার মতো। মুখে বলবো একটি গণতান্ত্রিক দেশ, কিন্তু বাস্তবে স্বৈরশাসনের দেশ। যে দেশে সুন্দর শাসন ব্যবস্থার জন্য তিন থেকে চারটি দলের অন্ততঃ একটি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান থাকা উচিৎ। একক শাসন ব্যবস্থা সবসময় স্বৈর শাসনের জন্ম দেয়। বর্তমানে আমরা তা গভীরভাবে অনুভব করছি।

বেসিক্যালি মানুষ খুব স্বার্থপর জাতি। এটা আমাদের মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সাধারণ এবং অসাধারণ শব্দ গুলোর জন্ম এমনেই হয়নি। আপনি/আপনারা যখন শিক্ষা,জীবনবোধ, চর্চার মাধ্যমে স্বার্থপরতাকে নূন্যতম মাপকাঠিতে নিয়ে আসতে পারবেন তখনই আপনি/আপনারা হয়ে যাবেন সাধারণ সমাজের অসাধারণ কেউ।
একসময় রাজনৈতিক দল গুলোর আদর্শ ছিলো, সাধারণ মানুষের একটি সুস্থ জীবনমান নিশ্চিত করা। রাজনীতিতে এখন আর সুস্থ প্রতিযোগিতা করার মতো বাংলাদেশে কোনও দ্বিতীয় দলই নেই।
তাই গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্র এখন একাকার।

বর্তমানে নারীদের একটি অংশ যখন নারীদের উপর প্রতিনয়ত ঘটে যাওয়া নির্যাতন/হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলতে চাচ্ছে তখনই কিছু মানুষ তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াচ্ছে। আবার কিছু মানুষ বলছে নারীবাদকে বিস্তৃত করার কী দরকার? এর চেয়ে ভালো মানবিকতার কাতারে ফেলে এই সকল নির্যাতনের সমাধান করুন।

প্রথমে সেই যে বিত্তশালী লোকের ব্রেইন টিউমারটির গল্প বললাম সেই লোকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে টিউমারটি ধরা পড়েছে। ওখানে আপনি আপনার ‘মানবতার’ মতো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ দিয়ে সাধারণ মাথাব্যথার মতো সেই টিউমারের চিকিৎসা করাতে পারবেন না। এর জন্য আপনাকে অবশ্যই বিশেষজ্ঞর শরণাপন্ন হতে হবে।

বাস্তবিক অর্থে ‘মানবিক’ শব্দটি এতো সুন্দর এবং এতটাই শক্তিশালী যে একটি রাষ্ট্র মানবিকতায় প্রতিষ্ঠিত হলে সেই সমাজে মানুষের অপরাধ গুলো হবে খুবই নূন্যতম। যেখানে নারী-পুরুষের অবস্থান হবে পাশাপাশি, সৌন্দর্যতায় ভরপুর।

একটি মানবিক রাষ্ট্রে একটি শিশু কখনই ধর্ষণ হবে না। একটি মানবিক রাষ্ট্রে তনু, কল্পনা চাকমা, রুপা প্রামানিকরা ধর্ষণ আর হত্যার শিকার হয়না। যে মেয়েটি এই ভয়ানক পুরুষতন্ত্রের সমাজে নিজেকে কাবাডি খেলার মতো বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে শিক্ষা জীবনের একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে প্রায় সম্পন্ন হচ্ছিল ঠিক তখনই অশিক্ষিত বর্বর কয়েকটি হায়েনা সকল স্বপ্ন শেষ করে দিলো! রুপা,তনুরা যখন এমন করে একটি তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাস্ট্রে ধর্ষণ শেষে নিহত হয় তখন আপনার ভাবনার ডালভাত ‘মানবিক’ শব্দটির পঁচন ধরে যায়।

যে সমাজে মেয়েরা নিশ্চিন্তে পথে হাঁটতে পারেনা, যে রাষ্ট্রে নারী-পুরুষ ভাবনায় নাগরিক অধিকার ভাগ হয়ে যায়। ঘরে,অফিসে,পথে মেয়েরা ধর্ষণ হয়, হত্যা হয় সেই সমাজ মানবিক? যে রাষ্ট্রে শ্রমিকের মুজুরি শ্রমিককে বুঝিয়ে দেয়না, যে রাস্ট্রের সংবিধান একটি ধর্মের উপর ভর করে পরিচালিত হয়! যে রাষ্ট্রের ধর্ম গ্রন্থগুলোতে নারীদের সম্পত্তির বন্টন সুষম থাকে না, এমনকি নারীদের সম্পত্তিতে অধিকারের কথা উল্লেখ করাও নাই সেই মানবিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি আপনি? যেখানে মানুষ নিজে জেনে মুনাফার লোভে খাবারে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে সেই মানবিক রাষ্ট্রের মানবিক মানুষটি আপনি? স্বপ্ন নিয়ে যে হালিমা পুলিশের চাকরি নিয়েছিল, মধ্যপথে আত্মহত্যা করার আগে জানিয়ে গেলো তার পুরুষ কলিগের হাতে ধর্ষণের কথা সেই মানবিক আইনের দেশের মানুষ আপনি?

কয়টা উদাহরণ দিবো? ক্লান্ত লাগে এখন, আপনাদের তথাকথিত ‘মানবিকতার’ কথা শুনলে! একটু বড় হওয়ার পর থেকে, ঘরে বাহিরে একটা যুদ্ধ খেলে খেলে নিজেকে বাঁচিয়ে এখনও বেঁচে আছি। স্কুলে যাওয়ার সময় পাশ থেকে কানের কাছে এসে একজন বলেছিল, আমার সাথে প্রেম না করলে এসিডে ঝলসে দিবো। আমিও দৃঢ় ভাবে বলেছিলাম,ঝলসে দাও। ঘরে এসে কাউকে বলিনি,বড় ভাই বলবে স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। প্রতিদিন এই সকল যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। কী যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে রূপারা শিক্ষা জীবন শেষ করে তার ভিতরের খবর কেউ জানে না। তাই তনু,রূপারা যখন ধর্ষণ হয়, হত্যার শিকার হয় নিজে স্থবির হয়ে আসি। ঘরের কাজে মনোযোগ দিতে পারি না। তাদের মায়ের মুখ,অচেনা সকল স্বজনের মুখ, তার নিজের অজানা স্বপ্ন গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। জানিনা, একজন পুরুষের কি ভাবনা হয় তখন।

আপনার মগজে টিউমার রেখে একটি পুরো শরীরের সুস্থতা যেমন আশা করতে পারেন না তেমনি মেয়েশিশু,নারী ধর্ষণ/ হত্যা করে মানবিকতার কথা বলতে আসবেন না দয়া করে। যাদেরকে আপনি নারীবাদ বলে পুরুষতন্ত্রের চশমায় বিচার করছেন তারা শুধু আপনার ভাবনার তথাকথিত মানবিক সমাজের ক্ষতটা তোলে ধরছে। তারা আপনাদের শত্রু নয়। সত্যিকারের মানবিক দৃষ্টি থাকলে একমাত্র সেই কথা গুলো অনুভব করা সম্ভব।

নারীর গর্ভে জন্ম নেয়া পুরুষগুলোই একদিন কী ভয়ানক হয়ে উঠে। প্রতিটি ধর্ষণের,হত্যার খবর শুনে আমার ছেলের মুখ ভেসে উঠে। ছেলেটিকে পারবো তো একজন মানবিক মানুষ করে গড়ে তুলতে? পারবো তো সম্মানবোধটুকু তার মগজে ঢুকিয়ে দিতে?

একটি মানবিক রাষ্ট্রের মানুষ কখনও অন্যকে অসম্মান করে না, সে ছেলে হউক আর মেয়ে হউক। ‘নারীবাদ’ একটি দর্শন, যেখানে নারীর উপর ঘটে যাওয়া অবিচার, নারীর অধিকার নিশ্চিত করতেই আজ বিস্তৃত হচ্ছে। আপনি সত্যিকার অর্থে মানবিক হলে ‘নারীবাদ’ কে অবশ্যই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবেন। কারণ ‘নারীবাদ’ মানবিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনার সমাজে যেদিন সত্যিকারের ‘মানবিকতা’ প্রতিষ্ঠিত হবে নারীবাদ আপনা আপনিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
শরীরের প্রতিটি অঙ্গের সুস্থ্যতা নিয়েই আপনার একক সুস্থতা।

তাই ‘নারীবাদ’কে এড়িয়ে আপনি ‘মানবিকতা’ প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন না। ভয়ানক পুরুষতন্ত্রের রাষ্ট্রে নারীর উপর প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ধর্ষণ,হত্যা মগজে টিউমারের প্রতীক। সেই টিউমার অপসারণ না করে জাতির পচনশীল
মানবিকতাকে রক্ষা করা কখনই সম্ভব নয়। আর সেই পচন ঠেকানোর একমাত্র উপায় আপনাকে/আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে মানবিক হয়ে উঠতে হবে। তথাকথিত দৃষ্টিভংগীর একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে।

নিজস্ব অবস্থান থেকে প্রতিটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। সবাই একসাথে হয়ে রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে যে কোন অপরাধে রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে।
নয়তো মিছামিছি মানবিকতার গল্প বলে ‘মানবিকতা’ কে ক্যান্সারের অবস্থান থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তেমনি ‘নারীবাদ’কে প্রতিষ্ঠিত না করে ‘মানবিকতাকে’ সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়।

কাকলী তালুকদার
নিউইয়র্ক
৩১ শে আগস্ট ২০১৭

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.