সেবিকা দেবনাথ:
মনে মনে ঠিকই করে নিয়েছিলাম রূপাকে নিয়ে কোন কিছু লিখবো তো না-ই, কিছু বলবোও না। কেন লিখবো বা বলবো? ধর্ষকদের অভয়ারণ্যের এই দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কী লাভ? কেউ তো শোনে না। আমরা আহা-উহু করে সমবেদনার মোড়কে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির দিকে প্রতিনিয়ত ছুঁড়ে দেই তাচ্ছিল্য।
এখানেই তো ক্ষান্ত হই না। ঘটনার জন্য ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকেই দায়ী করি। কেন সে রাতের বেলায় একা একা চলাফেরা করে? কেন বন্ধুদের নিমন্ত্রণে জন্মদিনের পার্টিতে যায়? কেন তার বুকের ওড়না বুকে না থেকে গলায় জড়ায়? কেন সে বোরকা না পরে আধুনিক পোশাক পরে? কেন? কেন? কেন? এতো কেন-এর ভিড়ে মেয়েটা বা তার পরিবারের নিদারুণ কষ্টটা চাপা পড়ে যায়।
আশেপাশের মানুষ জনের কিছু মন্তব্য শুনে সত্যিই আর আশাবাদী হতে পারি না। আমার কেবলই মনে হয় আমরা প্রতিনিয়ত অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। আমাদের মন মানসিকতার উৎকর্ষতার বদলে অধো:গতিই হয়েছে বেশি। এর প্রমাণ হিসেবে কিছু তথ্য তুলে ধরছি।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সারাদেশে ধর্ষণ মামলা হয়েছে এক হাজার ৯৪৪টি। এর মধ্যে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৫২টি। এছাড়া ২০১৬ সালে প্রতি মাসে গড়ে সারাদেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩১০টি। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত মামলা হয়েছে এক হাজার ৯৪৪টি। এ হিসাবে ধর্ষণের মামলার সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। চলতি বছরে জানুয়ারিতে শিশু ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৪১টি, ফেব্রুয়ারিতে ৫০টি, মার্চে ৫৩টি, এপ্রিলে ৫৬টি, মে মাসে ৭৭টি, জুনে ৪৩টি, জুলাই মাসে ৩২টি এবং আগস্ট মাসে ৩০টি। অথচ ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত ৩৪৬টি মামলা হয় এবং ওই বছর মোট মামলা হয় ৬০১টি। ২০১৫ সালে মামলা হয়েছিলো ৫২১টি।
ভারতের দিল্লিতে চলন্ত বাসে ‘নির্ভয়ার’ ধর্ষণের ঘটনার পর শুনতে পেতাম দিল্লি হচ্ছে ধর্ষণের নগরী। তাহলে বাংলাদেশ কী? পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ কোন তালিকায় আছে? নির্ভয়ার মৃত্যুর পর প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে আইন পরিবর্তন হয়েছে ভারতে। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করা হয় মৃত্যুদণ্ড। আর শুধু তা-ই নয় ২০১২ সালে ধর্ষণ-সক্রান্ত একটি মামলার রায়ের সময় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ বিচারকের ভাষ্য ছিল: ‘ধর্ষণ মামলায় ধর্ষণের শিকার নারীর সাক্ষ্যই প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকও যদি ধর্ষণের কোনো আলামত না পান বাদীর একান্ত সাক্ষ্য অবিশ্বাস করার কিছু নেই।’
আর আমাদের দেশে! এমনই আইন যে, ধর্ষণের শিকার মেয়ে বা নারীটিকেই আদালতে প্রমাণ করতে হয়, তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এরপর এই টেস্ট ওই টেস্ট, চরিত্র বিশ্লেষণসহ নানান প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে মেয়েটিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু যন্ত্রণা দেয়। রূপা অবশ্য মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। এতো কেন-এর মুখোমুখি ওকে হতে হবে না আর।
অনলাইনে ধর্ষণের বিরুদ্ধে লেখাগুলো পড়ি। তাতে কমেন্ট দাতাদের কেউ কেউ ধর্ষণের অকাট্য যুক্তি তুলে ধরছেন। তারা যে সবাই অশিক্ষিত তেমনটি কিন্তু নয়। ওইসব শিক্ষিত মানুষগুলো ধর্ষণের জন্য নারীদের এবং তার পোশাককে দায়ী করছেন। তাদের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। যেখানে শিশুকে ধর্ষণ করা হয়, ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করা হয়, ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়, ট্রাকে তুলে ধর্ষণ করা হয় সেখানে শালীনতার প্রশ্ন তোলা কতটা যৌক্তিক?
দেশে যে এত ধর্ষণ হচ্ছে; ধর্ষকদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, কই একজন ধর্ষকেরও তো শাস্তি হয়নি। যে দেশে ধর্ষকরা বুক ফুলিয়ে গর্বের সঙ্গে চলে সেই দেশে বিচার চাওয়াটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই হতে না। নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ধর্ষণের প্রতিবাদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করে, উদ্বেগ প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয়।
কিন্তু ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে জোরালো কোনো আন্দোলন বা কর্মসূচি কি আমরা করতে পেরেছি? পারিনি বলেই ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে ধর্ষক পার্টি করে। ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে মুখ লুকাবার জায়গা খুঁজতে হয়। অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আর ধর্ষকরা বিজয়ীর বেশে ঘুরে বেড়ায়। এদের নিয়েই তো আমরা আছি। আমাদের মধ্যেই তো ধর্ষক লুকিয়ে আছে। সুযোগ পেলেই হামলে পড়ে নিজের পুরুষত্বের প্রমাণ দেবে।