সালমা লুনা:
রূপা রে! কেন গেলি রে বোন বগুড়া? কেন একা একা বাসে চড়লি? কেন খালি বাসে বসে থাকলি বোন আমার? রাত হয়ে গেলেও একটা খালি বাসে চড়ে বসে থাকলি কেন?
তুই কি কখনো পত্রিকা পড়িসনি?
টিভিতে খবর!
তোর ফেসবুক আইডি নেই?
তনু মাহিমা রিশা পূজা নার্গিস সীমা ……কত নাম লিখবো রে! ভুলেও তো গেছি সকলের নাম।
নামের এই মিছিল যে ছাপ্পান্ন হাজারের এই ভূমি ছাড়িয়ে যেতে চায়। চোখের নোনা পানিতে যে আমাদের উপসাগর আরো ভারি হয়ে গেলো!
তবুও বোনটা আমার, তুই শুনিসনি কিছু?
জানিস না, দেশটা আস্তে আস্তে ভরে উঠছে ধর্ষকে?
নিজ পিতা থেকে শুরু করে বাসের হেলপার – কে নেই এই তালিকায়?
তুই সত্যি করে বল, জানতি না? জানতি না এইদেশ ধর্ষকের? ধর্ষকামীদের? লম্পটদের?
একজন ধর্ষকের হাতে পড়তে পারিস, এই চিন্তা কেন করিসনি হতচ্ছাড়ি মেয়ে?
করলেও নিজেকে বাঁচানোর কি ব্যবস্থা নিয়ে ওই রাতের বাসে উঠেছিলি?
পোড়ারমুখী তুই তো সব জানতি! জানতি এইদেশে টহল পুলিশও পথে একলা মেয়ে পেলে ধর্ষণ করে ।
এমনকি থানায় মওকামতো পেলেও ধর্ষণ করে।
এইদেশে শিক্ষক পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেবার কথা বলে অথবা কোচিংএর ফাঁকে ধর্ষণ করে।
অফিসের বস, রেডিও টিভি সিনেমার পরিচালক প্রযোজক, এমনকি মিউজিক ভিডিও নির্মাতাও কাজ পাইয়ে দেবার কথা বলে ধর্ষণ করে।
চাচা মামা ফুপা দুলাভাই কাজিন সুযোগ খোঁজে ধর্ষণের।
বাড়ির কর্তা কাজের মেয়েকে এমনকি কখনো নিজ স্ত্রীকেও ধর্ষণ করে।
এসব তুই জানতি না ?
তোর তো জানার কথা এই দেশে মুখে মুখেও ধর্ষণ করে ফেলে পুরুষ।
এই দেশের পুরুষরা ইনবক্সের টেক্সটে এসে ধর্ষণ করে যায়।
কোন নারীর ফেসবুকের পোস্ট পুরুষের স্বার্থে ঘা দিলে তাকে গণধর্ষণ করে।
ফেসবুক ব্যবহার করে থাকলে এসব তো তোর জানার কথা !
এতকিছু জেনেও বোন রে একলা বাসে চাপলি? কোন ব্যবস্থা না নিয়েই ?
জানি এভাবে মরতে তোর খুব কষ্ট হয়েছে বোন আমার। তবুও তিনজনের একটাকেও যে তুই কিছু করে যেতে পারলি না- এই দুঃখ আমার যাচ্ছেই না। অন্তত একজনের চোখটা গেলে দিতি তোর নখের খামচিতে! মরেই তো যাচ্ছিলি পশুর মতো তড়পাতে তড়পাতে, শেষে একটা মরণকামড় অন্তত দিতি একটা পশুকে!
আমি তোর জন্য সারাদিন শোক করেছি। এখনও শোক করবো। এ শোক আমার নিজের জন্যও। আমার বোনদের জন্য। কন্যা এবং কন্যাসম সকল আত্মীয়ার জন্য। কেন এই দেশে জন্মালাম, সেইজন্য যে দোষঘাট হলো -তার জন্য
শোকের মাতম করবো। আহাজারি করবো।
করতে করতে আমি অভিশাপ দেবো।
বুকের ভেতর থেকে, হৃদপিণ্ডের অলিন্দ নিলয় থেকে, জরায়ুর অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে, চোখ বেয়ে নেমে আসা লোহিত নোনা ধারার অনুপরমাণু থেকে সেই ভয়ঙ্কর অভিশাপ বাণী উঠে আসবে। অভিশাপ দেব- এমন সন্তান কোন নারী যেন জন্ম না দেয় যে ধর্ষক হয়ে উঠে। একজন নারী নির্যাতক হয়ে উঠে।
এমন সন্তান কোন নারী যেন জন্ম না দেয় যে ধর্ষককে বাহবা দেয়।
এমন সন্তান যেন কোন নারী জন্ম না দেয় যে ধর্ষণের প্রতিবাদ না করে গল্প কবিতার জন্ম দেয়,গান গায়, ছবি আঁকে ক্রিকেট খেলে।
এমন সন্তান যেন কোনো নারী জন্ম না দেয় যে ক্ষমতায় থেকেও ধর্ষককে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার নির্দেশ দেয় না, দিতে পারে না।
আমি অবশ্যই অভিশাপ দেবো। দিতেই থাকবো।
আমি জানি ধীরে ধীরে ধর্ষক হয়ে উঠছে এই দেশ। এই দেশের সকল মানুষ ধর্ষকামী হয়ে উঠছে।
রাস্তায় সরাসরি ধর্ষণ করতে না পারলে চোখ দিয়ে হাত দিয়ে মুখ দিয়ে যেসকল কর্মকাণ্ড ঘটায় পুরুষ সেও তো ধর্ষণের সমানই ! যে পুরুষের পৌরুষ এসব চোখের সামনে ঘটতে দেখেও বাধা দেয়না বরং মজা দেখে তারাও ধর্ষকের সহযোগী বা ধর্ষকামী।
মায়ের সমবয়সী নারীদের লেখা পছন্দ না হলে তাকে নিয়ে যে ভাষায় সমালোচনা হয় তাতো ধর্ষকেরই ভাষা!
নাক টিপলে মায়ের বুকের দুধ দু’এক ফোঁটা বেরিয়ে আসবে সেইসব একরত্তি ছেলেদের ফেসবুক ওয়ালে নারীবাদীদের নিয়ে যে ভাষায় ট্রল দেখা যায়, এরপর নিজের প্রায় বয়স ঊনিশের ছেলেটির দিকে তাকালে চোখ ভিজে আসে। একজন নারী নির্যাতকের মা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।
– আল্লাহ, তেমন হলে বাঁচিয়ে রেখো না” মনে মনে বলি।
তবু শেষবারের মতো ভাবি, আমাদের কি এখনও কিছু করা উচিত না? সকল নারীরা সম্মিলিতভাবে, একজোট হয়ে ভেদাভেদ ভুলে একটাবার কেবলমাত্র একটাবার আমরা ধর্ষণ বন্ধ বিষয়ে একমত হয়ে সরকারকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে, একটা কঠোর আইন করতে চাপ দিতে পারি না?
একটাবারের জন্য কেবল ভুলে যাই আওয়ামী বিএনপি, ভুলে যাই হিন্দু মুসলিম, ভুলি নারীবাদ, বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে তর্কবিতর্ক। সব ভুলে শুধু ধর্ষকের ফাঁসির আইন বিষয়ে সরব হই সোচ্চার হই।
শুধু নারীরাই কেন!
ধর্ষিতা এই শিশু, কিশোরী, তরুনী নারীদের বাবা আছে কারো ভাই বন্ধু স্বামী পুত্র সম্পর্কিত নামে আছে পুরুষ স্ব-জন। তাদের কি এখনও পৌরুষ জেগে উঠেনি? যে পৌরুষ রক্ষাকর্তা। যে পৌরুষ প্রতিশোধ নিতে জানে। যে পৌরুষ যুদ্ধে যায়- নিঃশঙ্কচিত্ত ভয়হীন বীর। যে পৌরুষ নারীর স্তন্যে লালিত হয়ে নারীকে সম্মান করে নিজ শিক্ষায়। সেই পৌরুষদীপ্ত পুরুষ কি বাংলায় নাই?
কেমন পুরুষ সব?
ফেসবুকে নারী পরকীয়া নিয়ে কী লিখলো না লিখলো তাই নিয়ে নতুন নতুন ট্রল সৃষ্টিকারী পুরুষ, হাজার লাখ বন্ধু ফলোয়ার সমৃদ্ধ সেলিব্রেটি পুরুষ সব! তাদের কতো কী আইডিয়া! তাদের মাথায় এই ধর্ষণ বন্ধ করার বিষয়ে কি নতুন নতুন কোনো আইডিয়া আছে?
পুরুষদের বলছি এজন্য যে ধর্ষক তো সব পুরুষই। একজন পুরুষই আরেকজন পুরুষকে সহজে বুঝতে পারবে। একজন ধর্ষক পুরুষের মানসিকতা বুঝে সেই অনুযায়ী কাজ করার জন্য আপনারাও প্রস্তুত হোন। এই ধর্ষকদের রুখে দেবার, আটকে দেবার কিংবা সুস্থ করার মানসিকতা নিয়ে কিছু কাজ করুন।
আমরা তো নিজেদের স্বার্থেই আপনাদের সাথে থাকবো। থাকতেই হবে।
উপায় নেই আমাদের।