ফারহানা আনন্দময়ী:
এতোদিন খুব রাগ হতো। এখন হতাশ লাগে। এতোদিন খুব লজ্জা হতো আপনাদের জন্য। এখন ক্লান্ত লাগে। আর কত? এবার আপনারা একটু লজ্জা পেতে শিখুন।
শরীরের অনেকগুলো জানালা থাকে, জানেন তো? কোন্ জানালা কখন খুলতে হয়, আদৌ খুলতে হয় কিনা যখন তখন… সেটা নারীরা নিয়ন্ত্রণ করতে জানে বলেই নারীরা প্রেমিকা হয়ে ওঠে।
পুরুষেরা সেটা নিয়ন্ত্রণ করার ভব্য শিক্ষা পায়নি বলেই পুরুষেরা ধর্ষক হয়ে ওঠে। পুরুষের সমার্থক শব্দ যখন ধর্ষক হয়, তখন একটু-আধটু লজ্জা তো আপনারা পেতেই পারেন।
আমি সেই পুরুষদেরকে বলছি, যাদেরকে আমরা সমাজে শিক্ষিত, সচেতন, সভ্য পুরুষ ভাবি। এবার আপনাদের পালা। এবার আপনারা পথে নামুন। ধর্ষিতার পাশে থাকুন, ধর্ষকের শাস্তি চান।
আর সেইসব অশিক্ষিত ধর্ষকদেরকে বলি, আপনারা রূপাকে ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে গেলেই তো পারতেন। রূপা বেঁচে থেকে অন্তত আপনাদের বিরুদ্ধে বিচারের লড়াইটা জারি রাখতে পারতো।
ওকে মেরে কেন ফেললেন আপনারা? কেন? কেন?
রূপাকে ধর্ষণের পরে ঘাড় মটকে, মাথা থেতলে মেরে কেন ফেললেন আপনারা?
একজন শিক্ষিত, স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীর এই অসহায় পরিনতি একদল অশিক্ষিত, অসভ্য, বর্বর পুরুষের হাতে… একেই বোধহয় বলে লিঙ্গের আস্ফালন!
২০১২’এর শেষের সকালটা শুরু হয়েছিল নির্ভয়া নামের এক বীর মেয়ের পরাজয়ের উপাখ্যান দিয়ে। পুরুষ নামক কিছু বিকৃত মানসিকতার প্রাণীর সাথে দিল্লির রাস্তায় চলন্ত বাসে ধর্ষণের লড়াইয়ে নিজেকে রক্ষার সংগ্রামে পরাজিত মেয়েটি হেরে গেল জীবন রক্ষার লড়াইয়েও। প্রায় দুইটা সপ্তাহ মৃত্যুর সাথে লড়াইয়ের পর জীবনদান করার বিনিময়ে তাঁকে ‘প্রকৃত বীর’ খেতাব অর্জন করতে হলো। সমগ্র ভারত তাঁকে ডেকেছে ‘India’s Daughter’। কিন্তু দেশমাতা তো পারেনি সেই মেয়ের সম্মান রক্ষা করতে, মূল্যবান জীবনটা রক্ষা করতে। এবং পারেনি, তারও পরে আরো অনেক ধর্ষণ বন্ধ করতে, আবারও নারী ধর্ষিত হয়েছে চলন্ত গাড়িতে, পথে, রেঁস্তরায়। তবে নির্ভয়ার সৌভাগ্য, তাঁর পাশে সেদিন পুরো ভারত যেভাবে প্রতিবাদের, প্রতিরোধের দেয়াল তুলে দাঁড়িয়েছিল, একই ঘটনার শিকার হাজারো হতভাগ্য লাঞ্চিত নারীর সেই সৌভাগ্য হয় না আমাদের দেশে।
রূপা তো ‘নির্ভয়া’র ভাগ্য নিয়ে মরেনি।
ওকে তো আমাদের রাষ্ট্র ‘Brave heart’ উপাধি দেবে না। ওকে তো রাষ্ট্র ‘Bangladesh’s daughter’ বলে ডাকবে না। তার জন্য এভাবে ফুঁসে উঠবে না পুরো দেশ, তার জন্য গণবিক্ষোভে ফেটে পড়বে না আমাদের সচেতন সমাজ। তার জন্য জলে ভরে উঠবে না আমাদের কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের দু’চোখ! একটা দুটো মানববন্ধনে রূপার ধর্ষক খুনীদের বিচার তো আমরা পাবো না। যেমন পাইনি তনুরটা। এই ধর্ষণ, এই হত্যার বিচারের দাবিতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করুন পদক্ষেপ নিতে। পুরুষেরা চিৎকার করুন, নারীদের সাথে, নারীদের জন্য। রাষ্ট্র উদ্যোগী না হলে এর বিচার আমরা পাবো না।
আমাদের জানার বাইরে প্রতিদিন, প্রতিরাতে এরকম অসংখ্য নারীকে হতে হচ্ছে পুরুষ নামক হায়েনার লোলুপ কামনার শিকার, কর্মক্ষেত্রে, ঘরে, রাস্তায়, পাহাড়ে, চলন্ত গাড়িতে… কোথায় নয়? সে খবর পৌঁছায় না আমাদের কাছে, প্রচার মাধ্যমের কাছে, এমন কি থানা পুলিশের কাছে… কিছুটা সমাজের ভয়ে, কিছুটা আইনী জটিলতার ভয়ে। আমাদের পুরুষশাসিত এবং পুরুষশোষিত সমাজে, ধর্ষণকারী পুরুষটির চেয়ে ধর্ষণের শিকার নারীটিরই যেন গ্লানি অধিকতর। সমাজ ব্যবস্থার প্রভাবে সাধারণ মানুষের ভেতরে মানসিক ভাবনার দৈন্যটা এমন গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে যে, আক্রান্ত নারীটিকেই ভাবতে বাধ্য করে ধর্ষিত হয়ে যেন অপরাধটা সেই করেছে। বহমান এমন অজস্র ঘটনার মাঝে দিল্লীর সেই ঘটনাটাই ব্যতিক্রম। বর্বরতার অন্ধকারের শিকার মেয়েটিকে আলোকিত জায়গা দেয়া হয়েছিল… সে আজ নির্যাতিত নারীর প্রতীক।
মনে পড়ে গেল ভুলে যাওয়া আমাদের সেই সীমা চৌধুরীর মুখটা। প্রায় একইরকম ঘটনাই তো ঘটেছিল সেদিন। কিন্তু তাঁর এই সৌভাগ্য হয়নি, আমরা তাঁকে ডাকিনি ‘Bangladesh’s Daughter’ বা তৎকালীন আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান সেদিন সীমা চৌধুরীকে আখ্যায়িত করেননি ‘She is a True Hero’ বলে। হতভাগ্য সীমা খেতাব পেয়েছিল পতিতার। আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে ঠিক সন্ধ্যার মুখে গার্মেন্টস কর্মী সীমা চৌধুরী ফিরছিল তাঁরই সহকর্মী বা ছেলে বন্ধুর সাথে। পথ আগলে দাঁড়ালো পুলিশ, সন্ধ্যার পর দুজন নারী-পুরুষকে একত্রে দেখে তাঁদের ভেতরে একটি অনৈতিক সম্পর্কের পরিচয় জোর করে আরোপ করা হলো এবং চালান করা হলো চট্টগ্রামের রাউজান থানায়। পরদিন পর্যন্ত ছেলেটিকে আটকে রাখা হলো এবং সীমা চৌধুরী সেলের ভেতরে ধর্ষিত হলো চারজন পুলিশ সদস্য দ্বারা। বর্বর পুলিশের শারীরিক ও মানসিক অতাচার সহ্য করতে না পেরে ঘটনার দুই মাস পরে মারা গিয়েছিল সীমা চৌধুরী।
কী করে ভুলি ১৪ বছরের কিশোরী ইয়াসমিনের কথা। ৯৫ সালের ঘটনা…সন্ধ্যা নামার একটু আগে সেও ফিরছিল ঘরে, মায়ের কাছে। পথে একটি পুলিশ ভ্যান তাঁকে তুলে নিলো নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার আশ্বাসে। পরদিন সকালে রাস্তার ওপর পাওয়া গেল ধর্ষিত ইয়াসমিনের আধমরা দেহ। সেদিন ইয়াসমিনকে আমরা ডাকতে পারিনি ‘Brave Heart’। আর তনুর ঘটনা তো এখনো দগদগে ক্ষত হয়ে লেগে আছে আমাদের জাতির শরীরে। আমাদের দেশে এভাবেই হারিয়ে যায় ভাগ্যহীনা সীমা বা ইয়াসমিন আর তনুরা, কালের গর্ভে জায়গা পায় না তাঁদের নির্যাতনের গ্লানিময় ইতিহাস।
সমাজের সভ্য, সচেতন পুরুষদেরকে আবারো বলছি, আপনারা প্রতিবাদী হোন। ধর্ষণের বিরুদ্ধে, ধর্ষকের বিরুদ্ধে, ধর্ষিতার পক্ষে রাস্তায় নামুন। আজ ক্রিকেটের জয়ে যেমন হাজার হাজার ‘আপনারা’ রাস্তায় বের হয়ে আনন্দমিছিল করবেন, ঠিক সেই সহস্র ‘আপনারা’ই যদি আজ রূপার জন্য, তাকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে, তা্কে হত্যার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন, তবে রাষ্ট্র বাধ্য হবে রূপার ধর্ষকদেরকে কঠিনতম শাস্তি নিশ্চিত করতে।