ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:
দুপুরের ভয়ংকর রোদ আর মাথার ওপরে সুন্দর মেঘ নিয়ে একলাই চললাম সিনেমা দেখতে। মেজাজ ফুরফুরে। কেন না একা টিকেট কেটে ছবি দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
বাংলা সিনেমা। বাংলাদেশের সিনেমা। বহুল আলোচিত ও সমালোচিত সিনেমা। সিনেমার নাম “ভয়ংকর সুন্দর”। দেখার কথা ছিল দলেবলে মুক্তির প্রথম দিনেই। একই দিনে মায়ের কাজের প্রদর্শনী শুরু হওয়াতে তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু, গ্যালারিতে আসা বন্ধুদের কাছ থেকে বারবার খোঁজ নিচ্ছিলাম, ভয়ংকর সুন্দর দেখেছে কী না, দেখলে কেমন লেগেছে।
এরপর নানাজনের নানান রকমের রিভিউ পড়লাম, প্রতিক্রিয়া পড়লাম। ভালো- মন্দ – দুইরকম প্রতিক্রিয়াই পাচ্ছিলাম। কিছু কিছু রিভিউ (!) পড়ে মনে হলো অনিমেষ আইচ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি, রীতিমতো ভয়ংকর কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন! এক সিনেমার রিভিউ লিখতে গিয়ে নিজের জ্ঞানভাণ্ডারের সবটুকু ঢেলে দিতেও কার্পণ্য করেননি কেউ কেউ। নিজের শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে আত্ম অহমিকায় বিভোর কোনো একজন বিশিষ্ট সমালোচক তো কথায় কথায় “অশিক্ষিত” শব্দটি ব্যবহার করতে পর্যন্ত দ্বিধা করেননি! সব দেখেশুনে আমার মনে হয়েছে, সমালোচনারও যে একটা সীমারেখা থাকা উচিৎ, সেই পরিমিতিবোধটুকু বুঝি আমাদের নেই!
যাই হোক, রিভিউ লেখার মতো বিজ্ঞ চলচ্চিত্র বিশারদ বা সমালোচক কোনোটাই আমি নই। আমি কেবল আমার ভালোলাগা বা ভালো না লাগাটুকু প্রকাশ করতে পারি।
অবশেষে ভয়ংকর সুন্দর সিনেমাটি আজ আমি দেখেছি। গল্পটা মতি নন্দীর জলের ঘূর্ণি ও বকবক শব্দ অবলম্বনে। মৌলিক গল্প। ভিন্নধাঁচের সিনেমা। অনিমেষের গল্প বলার ধরন বরাবরই আলাদা।
ঢাকা শহরের বস্তিবাসীদের পানির সংকট যে কী প্রকট – তা নিয়ে কোনো নির্মাতা এভাবে ভেবেছেন বলে আমার জানা নেই।
গল্পের নয়নতারা (ভাবনা) যখন মুকুকে বলে যে, সবার কাছে সে পানি চেয়েছিলো , কেউ তাকে একটু পানি দেয়নি – আমার কাছে নয়নতারার সেরা অভিব্যক্তি ছিল এই দৃশ্যতে। নয়নতারার বাড়ি ছেড়ে আসা, সরলতা, চিন্তাধারায় বাস্তবতার অভাব, মুকুর প্রেমে পড়া, বিয়ে করে বস্তিতে থাকতে শুরু করা, কাজের সময় বারবার মুকুকে ফোন দেয়ার মতো অপরিপক্ব আচরণ , বাড়ির লোকেদের সাথে না ফিরে যাওয়া, বস্তিতে কী পোশাক পরা যায় বা যায় না- তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা না থাকা – এর সবটুকুই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে, যেহেতু আমিও একসময় এরকম বয়স বা সময় পার করে এসেছি। সত্যি বলতে কী রিলেট করতে পেরেছি।
ভয়ংকর সুন্দর দেখার পর মুকুর (পরমব্রত) প্রতি মায়া জন্মায়নি – এমন কাউকে বোধহয় পাওয়া মুশকিল। শুরু থেকে শেষতক পোশাকআশাক, চালচলনে ছাপোষা মানুষটির নয়নতারার প্রতি যে সততা আর সহমর্মিতা – তা থেকে অনেক শিক্ষিত এবং উচ্চপদস্থ পুরুষেরা শিক্ষা নিতে পারেন যে, ভালোবাসায় শ্রদ্ধা থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নয়নতারা যখন ভালোবাসা আর বিয়ের কথা বলে, মুকু তখন বটিতে বসে সবজি কুটছিলো। কেঁদে কেঁদে মুকু বলে, আপনার সংগে কী আমার এসব মানায়? – এটা ছিল মুকুর সেরা এক্সপ্রেশন – অবশ্যই আমার কাছে।
এমন পরমব্রতকে আগে দেখিনি।
নির্মাতা অনিমেষ আইচের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, অভিনেতাদের তিনি এমন চরিত্রে নির্বাচন করেন যেমনভাবে তাঁদেরকে আগে কখনো উপস্থাপন করা হয়নি। একটা চমক থাকেই। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দিহানের অসাধারণ অভিনয় মনে থাকবে। এই চরিত্রে আর কাউকে ভাবাই যায় না। অনিমেষ মনে করিয়ে দিলেন, দিহানের মতো অভিনেতার আরো বেশি কাজ করা উচিৎ।
খলচরিত্রে সমাপ্তির পর্দা উপিস্থিতি খুবই কম সময়। অথচ কী দুর্দান্ত, গা ঘিনঘিন করা অভিনয়!
নয়নতারাকে এক গ্লাস পানি দিতে গেলে শিল্পী সরকার অপু স্বামীর প্রতি তেড়ে এসে গ্লাসটা ভেঙে ফেলে এবং মেয়েমানুষ দেখলে মাথার ঠিক থাকে না বলে শাপ শাপান্ত করে প্রমাণ করলেন, অভাবের জীবনে চরিত্রহীন স্বামীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ স্ত্রীর ব্যবহার একটা পর্যায়ে গিয়ে আর মানবিকতার ধার ধারেনা।
রিকশাচালক চরিত্রে খায়রুল আনাম সবুজ, বস্তিবাসী শিল্পী সরকার অপু, বাড়িওয়ালী দিহানের মাতাল স্বামী ফারুক আর ওই যে বোবা ছেলেটি – এ্যালেন শুভ্র – যে যার জায়গায় এক কথায় দারুণ।
গানগুলি ভালো লেগেছিল আগেই। অনিমেষের কাজে রাতের দৃশ্য ধারণে আলাদা মনোযোগ থাকে তা আগে থেকেই জানা। পানি জমিয়ে রাখার পর নয়নতারা আর মুকুর ঘরের অন্দরসাজের জন্য শিল্প নির্দেশকের বিশেষ প্রশংসা প্রাপ্য।
ক্ষণেক্ষণে বস্তির লোকেদের ঝগড়া, গালিগালাজ, গণপিটুনি দেয়া – অসম্ভব প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবসম্মত। দর্শক হিসেবে আমি যখন বস্তির পরিবেশে নয়নতারার পোশাক নিয়ে কেউ কিছু বলছেনা কেন ভাবছি, ঠিক তখনই গায়ের জামা নিয়ে নয়নতারাকে বাড়িওয়ালী দুকথা শুনিয়ে দেয়। বুঝলাম নির্মাতা আগে থেকেই দর্শকের মনের প্রশ্ন এবং তার উত্তর ভেবে রেখেছিলেন।
অনিমেষ আইচ নির্মাতার আগে শিল্পী বলেই হয়তো স্বপ্নদৃশ্য পর্দায় কেবল দেখাতে না, আঁকতে পারেন। অনবদ্য ছিল দৃশ্যটি।
লিখতে গিয়ে দেখছি ভালোলাগার পাল্লা বেড়েই চলেছে। ভালো লাগেনি যেটা, তা হলো, গানের দৃশ্যায়ণ মাঝেমধ্যে মূল কাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন লেগেছে। তা না হলেই বরং ভালো লাগতো। আর প্রথমার্ধে মুকুর প্রতি নয়নতারার দুর্বলতা আরেকটু ধীরে এগুতে দিলে মনে হয় দর্শকও তাদের সম্পর্কের সাথে বেশি মানিয়ে নিতে পারতো।
পাশের বস্তিতে গিয়ে গণপিটুনি খাওয়ার পর নয়নতারার মুখে, ঠোঁটের কাছে অনেকটা আঘাতের চিহ্ন ছিল, যা কিছুদিন পরে সুস্থ হওয়ার পরে একেবারেই মিলিয়ে যায়। আমার মনে হয়েছে এমন আঘাতে বহুদিন পরেও কিছুটা দাগ থেকে যেতে পারতো।
একজন মেধাবী এবং বিচক্ষণ নির্মাতা হিসেবে অনিমেষ আইচ সমালোচনা গ্রহণ করতে জানেন বলে আমি বিশ্বাস করি। অনিমেষ আইচ ভালোবেসে, সততার সাথে তার গল্প বলার চেষ্টা করেছেন, কোনো অপরাধ করেননি। তাই বলবো ভয়ংকর সুন্দর দেখুন, ভালো লাগুক বা না লাগুক, মন খুলে সমালোচনা করুন। শুধু খেয়াল রাখবেন, সমালোচনা করতে গিয়ে আপনার পরশ্রীকাতরতা প্রকাশ না পায়। সমালোচনার নামে আপনারা পুরো কাহিনী আগে থেকেই বলে দিয়ে দর্শকের আগ্রহ নষ্ট করতে পারেন না। দয়া করে সমালোচনা আর ময়নাতদন্তের পার্থক্য বুঝে তারপর সমালোচনা করুন।
অনিমেষ আইচ ও তাঁর ভয়ংকর সুন্দর পরিবারের জন্য আমার ভালোবাসা ও অভিনন্দন।