শরীর আমার, সিদ্ধান্তটাও একান্তভাবেই আমার

সুমু হক:

মেয়েদের পোশাক, তার শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে এত এত কথা হয়ে গেছে যে নতুন করে কিছু বলার অর্থ হয় না আর। কিন্তু সমস্যা হলো, সাধারণ কাণ্ড জ্ঞান, ভদ্রতাবোধ, রুচিবোধ এবং সর্বোপরি নারীদের ব্যক্তি অধিকারের প্রশ্ন এলেই একশ্রেণীর নারী এবং পুরুষ কানে তুলো গুঁজে, মগজে তালা দিয়ে বসে থাকেন। তাই একই কথা ক্লান্তিকর হলেও বলে যেতে হয় ক্রমাগত, যদি কোনরকমে কথাগুলো তাদের বুদ্ধির গোড়ায় একটু হলেও জল দেয়।

পোশাক নিতান্তই একজন মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ, রুচি এবং সর্বোপরি স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়, আর এমনটাই হওয়া উচিত বলে যেকোনো সভ্য মানুষমাত্রই ভাববেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখনই সমস্ত পৃথিবী জুড়েই কিছু পুরুষতান্ত্রিক মানুষ রয়ে গেছেন যারা নারীর আর সব অধিকারের মতোই তার পোশাক নির্বাচনের বিষয়টিকেও সমাজ এবং ধর্মের অনুশাসনেই অন্তর্গত হওয়া উচিত বলে মনে করেন। তেমনটা হতেই পারতো, হলে কোনোই সমস্যা হতো না, যদি এই সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর সৃষ্টিতে নারীর কোনো ভূমিকা থাকতো!

গ্লোরিয়া স্টাইনেম তাঁর অনেক লেখাতেই খুব চমৎকার একটি উদাহরণ দিয়ে থাকেন। গর্ভপাত নিয়ে আন্দোলন চলছে যখন, তখন একবার সেই বিষয়ে নিউ ইয়র্ক স্টেটের আইন-সভায় একটি ব্যতিক্রমী শুনানির আয়োজন করা হলো। খুব ভালো কথা, কিন্তু গর্ভপাতের অধিকারের প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত সেই শুনানিতে সাক্ষ্য দিতে আমন্ত্রণ জানানো হলো ১৪ জন পুরুষকে, তাদের সাথে আমন্ত্রিত হলেন একজন নারী, যিনি কিনা একজন নান বা ধর্মযাজিকা, কৌমার্যের দীক্ষা নেয়ার ফলে যার কিনা যৌনতা এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অনেক বিষয়েই ব্যক্তিগত কোন অভিজ্ঞতাই থাকবার কথা নয়।

উদাহরণটি অত্যন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ের এবং হাস্যকর হলেও, হাজার হাজার বছর ধরে কী করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ধর্ম এবং রাষ্ট্রগুলো নারীর কোন মতামতের তোয়াক্কা না করেই অভিভাবকত্বের নামে তার ওপর নিজেদের ইচ্ছে এবং সুবিধে অনুযায়ী অনুশাসন চাপিয়ে গেছে, এটি তারই খুব ছোট্ট একটি উদাহরণ।

দেহটি আমার। তাকে আমি কখন কীভাবে ঢাকবো, কীভাবে খুলবো, কীভাবে কখন তাকে সাজাবো, সে সিদ্ধান্তটিও একান্তভাবেই আমারই হওয়া উচিত। আর কারও নয়।

ধরুন, আমি শাড়ি পরতে ভীষণ ভালোবাসি, কিন্তু আমার পেশা, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এবং যে দেশে, যে আবহাওয়ায় আমার বসবাস, সেখানে বছরের নয় মাস সময়েই শাড়ি খুব অসুবিধেজনক পোশাক। এমনকি দেশে গেলেও যদি কখনো রিক্সা কী ট্রামে-বাসে চলাচল করতে হয়, অনভ্যাসের কারণে শাড়ি সেখানে আমাকে ক্রমাগতই স্লথগতি করে দেয়। সেক্ষেত্রে আমি যদি অন্য কোন পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, তাহলে সেটা পরবো না কেন? আবার নিজের একান্ত নিজস্ব বসবাসের যে জায়গা, সেখানে আমার আরাম এবং কাজের সুবিধেই হওয়া উচিত একমাত্র বিবেচ্য বিষয়, সেখানে আমি কী পরবো, কী পরবো না, সেটা ঠিক করে দেবার সমাজ কে? একই কথা খাটে একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের ছাত্রাবাস বা হল কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রেও। যেখানে ছাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতাই হওয়া উচিত একমাত্র বিবেচ্য।

আমরা কেন ভুলে যাই, যে যুগে যুগে যখন, যে দেশ কিংবা যেকালেই এমনটা ঘটেছে, নারীর পোশাকের ওপর চাপিয়ে দেয়া পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের বেড়াজাল মেনে নেয়া মানেই কিন্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে, নারী যে কেবল পুরুষের ভোগের বস্তু বৈ কিছু নয়, সেটাকে মেনে নেয়া। যে মুহূর্তে আমি মেনে নিচ্ছি যে পুরুষের লালসা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আমাকেই আমার শরীর ঢেকে রাখতে হবে, এবং এক্ষেত্রে পুরুষের আত্মসংবরণ কিংবা নিয়ন্ত্রণের কোনোই দায় নেই, আমি কিন্তু প্রকারান্তরে বাঘের পেটে যাবার জন্যে হরিণের দেহটিকে দায়ী করে বাঘের শিকারের অবিসংবাদিত অধিকারটিকেই মেনে নিচ্ছি। বাঘের পেটে যাবার সম্ভাবনা থাকলে, সেটা থেকে বাঁচতে হরিণটিকেই লুকিয়ে থাকতে হবে। বাঘের তাতে বিন্দুমাত্র দায় নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে এবং দেশের বাইরের বাংলাদেশী কম্যুনিটিতে পোশাক সংস্কৃতির ব্যাপক এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে হিজাব এবং বোরখার দিকে। আমার কাছের অনেক বন্ধু এবং বোনেরাও এই দিকেই ঝুঁকেছেন। ব্যক্তি হিসেবে তাদের সেই স্বাধীনতা নিশ্চয়ই আছে এবং আমি তাদের সেই সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধাও করি। এই প্রবণতার নানারকম সামাজিক কারণও আছে। সমস্ত সমাজ ধর্মীয় মৌলবাদের দিকে ঝুঁকছে বলে এটাই হয়তো আজ অনেকের চোখে স্বাভাবিক ঠেকছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সমাজের আর যে পাঁচজন নারী এই পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল প্রবণতাকে মেনে নিতে পারবেন না, তাদেরও এই নিয়ম মানতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এবং পৃথিবীর অনেক প্রান্তেই শালীনতার নামে নারীর ওপর এই শেকল চাপিয়েই দেয়া হচ্ছে। আমার আপত্তি সেখানটাতেই।

কেন আমরা নারীদেরকে নিজের শরীর ঢেকে রাখতে না বলে পুরুষদেরকে বলছি না তাদের কামবোধকে সংযত করতে? আমি কখনোই মানতে রাজি নই যে যথেষ্ট শিক্ষা এবং সংস্কৃতিবোধের মধ্যে দিয়ে পরিশীলিত হয়ে বেড়ে উঠলে কোন একটি সমাজের পুরুষেরা নারীর ন্যূনতম ব্যক্তি স্বাধীনতাকে এভাবে সম্মান জানাতে পারবেন না। আর নারীর ওপর যৌনসন্ত্রাসের কারণ হিসেবে যারা পোশাককেই দায়ী করে থাকেন, তাদের ছেদো যুক্তি ভাঙতে একটি উদাহরণই যথেষ্ট।

এইসব রক্ষণশীল সমাজের আড়ালে ঘটে যাওয়া হাজার হাজার শিশুর (এমনকি ৮ মাস বয়সী কন্যা এবং পুত্র সন্তানও এ সমাজে যৌন সন্ত্রাস থেকে রেহাই পায় না।) যৌন সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার দায়ও কি আপনারা তাদের পোশাকে শালীনতার অভাবের ওপর চাপিয়ে দেবেন? নাকি দায়ী করবেন সেইসব পশুকে, যারা নিছক জৈবিক তাড়নার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি এবং মানুষ নামেরও যোগ্য নয়?

আবারও বলছি, শরীরটা আমার, তাকে আমি ঢাকবো, না খুলবো, তাতে ট্যাটু করবো, না তাকে অন্য কোনোভাবে সাজাবো, সেই সিদ্ধান্তও হওয়া উচিত একান্তভাবেই আমার! আপনার যদি তাতে সমস্যা থাকে, চোখে ঠুলি বেঁধে জঙ্গলে কিংবা কোন গুহায় ঢুকে বসে থাকুন। সভ্য সমাজে আপনার কোন স্থান নেই!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.