ঝর্ণা মনি:
(১)
রমযান মাসের এক সন্ধ্যা। ধানমন্ডি-৩ নম্বরে আওয়ামী লীগের যৌথসভার এ্যাসাইনমেন্ট কভার করে অফিসে ফিরছিলাম। বাংলামটর মোড়ে আরটিভির গাড়ি থেকে নেমে মৌচাকের রিকশা খুঁজছি। এমন সময় আযান পড়লো। হঠাৎ এক হুজুরের চিৎকার, ‘এ্যাই মাইয়া, মাথায় কাপড় দে।’
চিৎকারওয়ালাকে একনজর দেখার জন্য ফিরতেই আরেক হুঙ্কার, ‘নাউজবিল্লাহ! ওড়না নাই! আবার হাতাকাটা জামা! এই জন্যই তো দ্যাশটা দোযখের আগুনে পুইড়্যা মরতাছে। আল্লাহ গো, তুমি হেফাজত করো, মালিক।’
আল্লাহ হেফাজত করেছেন কীনা জানি না, তবে আমি রিক্সা পেয়ে যাওয়ায় হুজুর যে হেফাজত পেয়েছেন, এটা বুঝতে পারছিলাম তার মুখভঙ্গি দেখে।
আমার কেন বব কাট চুল, আমি কেন জিন্স-টিশার্ট পরি, আমি কেন ওড়না পরি না- এসব নিয়ে আমার চারপাশের কিছু মানুষ ক্রনিক মাইগ্রেনে ভুগেন। আর রাস্তার কিছু প্রাণীর(!) বিদ্রুপ মন্তব্য আর তীর্যক চাহনি তো নিত্যদিনের বাড়তি পাওনা। অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। হাতে সময় থাকলে দু’চার কথা শুনিয়ে দিতে ভুল করি না। এমনকি গায়ে হাত তুলতেও খুব একটা সমস্যা হয় না।
(২)
আজ পত্রিকার পাতা খুলতেই একটা নিউজে আটকে গেল চোখ। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। একি আমার বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা ’৫২ সালে নাজিমউদ্দিন সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন করেছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য? একাত্তরে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শত্রু মোকাবেলায়? আজ প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে হলের ভেতরে মেয়েরা কী পোশাক পরবেন, তা নির্ধারণ করবে হল কর্তৃপক্ষ? গেঞ্জি পরবে, টিশার্ট পরবে, স্কার্ট পরবে নাকি শাড়ি পরবে, এটি তো যে পরবে তার বিষয়। এখানে কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব ফলানোর কী হলো?
আর ঘটনাটি ঘটেছে এমন এক হলে, যে হলের নামকরণ করা হয়েছে নারী আন্দোলনের অগ্রপথিক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সুযোগ্য শিষ্য মহিয়সী কবি সুফিয়া কামালের নামে। শত বছর আগে রোকেয়া-সুফিয়া আজীবন ব্যয় করেছেন নারীর উন্নয়নের জন্য, আজ তাদের উত্তরসুরীরা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার ঘেরাটোপে বন্দী।
(৩)
রমযান মাসের সন্ধ্যায় মাথায় ঘোমটা দেয়ার নসিহতকারী হুজুরের বিদ্যার দৌড় কত আমি জানি না। জানার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর, প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে তো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সবগুলো স্তরই সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করতে হয়েছে। তাদের বিদ্যা নিয়ে তো প্রশ্ন তোলাও অনুচিত বলে আমি মনে করি। কিন্তু হায়! মগজের আবর্জনা তো দেখছি রাস্তার ওই হুজুরের মতোই!