ওই তিনটি শিশুর জীবন অনিশ্চিত করে দিলেন কেন?

আতিকা রোমা

গত ২৩ আগস্ট বেশ কয়েকটি পত্রিকা একটি নিউজ কভার করেছে স্কুলের টয়লেটে মাদক সেবন- ৩ ছাত্রী বহিষ্কার। সংবাদটি ভাল করে পড়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন একদল মানুষের কাণ্ডজ্ঞানহীনতার প্রমাণ পেলাম। নবম শ্রেণীর তিনজন ছাত্রী স্কুলের টয়লেটে গাঁজা খেতে গিয়ে ধরা পরেছে।

প্রতিবেদনগুলোতে আর একটি বিষয় চোখে পড়লো, কিন্তু বোধগম্য হলো না। সেটা হলো ছাত্রীরা কোল্ড ড্রিংসের সাথে কোনো একটি সিগারেটের তামাক ভিজিয়ে নেশা করেছে। তামাক ভিজিয়ে কী বস্তু সেবন করলো, নাকি অন্য কিছু, শিক্ষকরা তা বুঝলেন কিভাবে? শুধু আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত একটি বিদ্যালয় নেয় কীভাবে জানি না। এর প্রমাণ কী? শিক্ষকরা কি মাদক বিশেষজ্ঞ?

আমি ঐ তিন ছাত্রীর মাদক গ্রহণকে একদম সমর্থন করছি না। কিন্তু সমাজে মাদকাসক্তদের প্রতি যে অবহেলা ও ঘৃণা, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির প্রথম সমস্যা হলো আবেগীয় অসামঞ্জস্যতা। অনিয়ন্ত্রিত আবেগ যা তাকে বার বার ধাবিত করে মাদকাসক্ত হতে। এই মেয়েগুলোর হয়তো সেই সমস্যা এতো তীব্র নয়। এরা হয়তো খেয়ালের বশেই বা নতুন কিছু অনুসন্ধানের কারণেই কৌতূহলি হয়ে মাদক গ্রহণ করেছে। এরচেয়ে বেশি কিছু নয়।

আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে গাঁজার প্রচলন খুব বেশি দেখা যায়। এটি তুলনামূলকভাবে সস্তা ও সহজলভ্য। বিশ্বের অনেক দেশে গাঁজাকে মাদক হিসেবেই মানা হয় না, কারণ এটি অর্গানিক ড্রাগস এবং এর থেকে ক্ষতির পরিমাণটাও অনেক কম। এটি সাময়িক চাঞ্চল্যতা সৃষ্টি করে, একটি নির্দিষ্ট সময় পরে স্বাভাবিকতা চলে আসে এবং ভবিষ্যতে এর ফলে বড় কোন শারীরিক সমস্যা দেখা যায় না। কিন্তু আমার সমস্যা লেগেছে এই তিনটি মেয়ে কোল্ড ড্রিংসের সাথে কী মিশিয়ে খাচ্ছিলো, সেটা কেন স্পষ্ট করা হলো না। কোল্ড ড্রিংসের সাথে ইয়াবার ট্যাবলেট মিশিয়ে খেলে ঘটনাটি অবশ্যই ভয়াবহ এবং এর জন্য সত্যিকার অর্থেই এই তিনটি শিশুর পাশে দাঁড়ানো দরকার।

এখন আসি স্কুলের দায়িত্বহীনতার প্রসঙ্গে। একটি শিশুর জন্য প্রথম বিদ্যাপীঠ হলো তার পরিবার এবং একাডেমিক শিক্ষার জায়গা হলো স্কুল। আমাদের সময় আমাদের স্কুলগুলি ছিল আমাদের পরিবারের মতোই। শিক্ষকরা যেমন আমাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, তেমনি কোনো বাচ্চার সমস্যা হলে বাবা-মার কাছে যেমন সে শিশুটি বলতে পারতো, তেমনি শিক্ষকের কাছেও বলতে পারতো। আমার মনে হয় এখনও এই সংস্কৃতি চলমান আছে। একটি শিশুর কাছে এখনও তার শিক্ষকের কথা ও আচরণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এমনও দেখা যায় যে, হয়তো স্কুলে শিশুটি একটি বিষয় একটু ভুলভাবে শিখেছে, সেখানে বাবা-মা শুধরে দিতে গেলে শিশুটা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। কারণ সেটি তার শিক্ষক বলেছেন।

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কিভাবে পারলেন এই শিশু তিনটির জীবন নষ্ট করে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে? ধরে নিলাম এই তিনজন শিশু সত্যি সত্যি গাঁজায় আসক্ত হয়ে পড়েছিল। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনেক আগের থেকেই কি তারা জানতেন বিষয়টি? যদি তাই হয় তবে তারা কেন এই শিক্ষার্থীদের বাবা-মার সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন না? শিক্ষক হিসেবে তাদের দায়িত্ব ছিল এই তিনজনের সাথে খোলামেলা কথা বলা এবং জানা কেন তারা মাদক গ্রহণ করছে।

এটাও জানা শিক্ষকদের উচিৎ ছিল যে এগুলো কেনার জন্য টাকার সোর্সটা কী এবং কীভাবে ও কার কাছ থেকে তারা সেগুলো পাচ্ছে! এরপর আরও উচিৎ ছিল স্কুলটিতে মাদক বিরোধী প্রচারণা চালানো। শিক্ষার্থীদের এর ভয়াবহ পরিণতির কথা জানান। এভাবে বিনা বিচারে তিনটি শিশুকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গিয়ে সরাসরি গুলি করে দেয়া নয়। এটা বুঝিয়ে দেয়া নয় যে, তোমরা অত্যন্ত খারাপ, তোমাদের সাথে আমাদের ভীষণভাবে আড়ি।

এই তিনজন শিশুকে নিয়ে খুব চিন্তিত বোধ করছি। এদের জন্য এদের পরিবারগুলো ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েছে এবং সামাজিকভাবে প্রচণ্ড রকমের হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে তা না দেখেই বলে দিতে পারি। স্কুলটি মেয়েগুলোর অন্য স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ রেখেছে বলে যে দাবি করেছে, সেটিও একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত। মোরেলগঞ্জের মত ছোট একটি উপজেলায় এই ঘটনা চাপা থাকবে না। কাজেই ধরেই নিচ্ছি এই তিনজন মেয়েকে অন্য কোন স্কুল ভর্তি নেবে না। তারওপর নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী হওয়ায় তারা বোর্ডের অন্তর্ভূক্ত। বছর প্রায় শেষ হতে চললো, এমন সময় কিভাবে এই শিশুগুলি নতুন স্কুলে ভর্তি হবে বুঝতে পারছি না।

আর এমন ভয়ঙ্কর শাস্তি কি এই তিনটি শিশুকে আরও ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে উৎসাহিত করবে না? তারা যে পরিস্থিতিতে পড়েছে এটার ফলাফল দিন দিন না কমে বরং বাড়তে থাকবে এবং বেড়ে যেতেই থাকবে। দীর্ঘ ১২ বছর আমি মাদকাসক্ত ছিলাম। তাই আমি জানি সমাজ ও আত্মীয়স্বজন কিভাবে বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারকে কোণঠাসা করে দেয়। এক্ষেত্রে মেয়ে সন্তান মাদকাসক্ত হলে পরিণতি আরও ভয়াবহ হয়। সমাজ ও আত্মীয়স্বজনের রাঙান চোখ উপেক্ষার চেষ্টা কতোটা অমানবিক পরিবেশ সৃষ্টি করে, তা স্পষ্ট করেই জানি।

মোরেলগঞ্জের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এরকম প্রাণঘাতী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং এই তিনজন শিক্ষার্থীকে ঐ স্কুলে ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানাচ্ছি। এভাবে অমানবিক সিদ্ধান্তের বোঝা নিয়ে তিনটি শিশু বাকি জীবনটা কাটাক তা কোনভাবেই চাচ্ছি না।

আসুন সবাই মিলে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাই এবং তিনটি শিশুকে তাদের জীবন ফিরিয়ে দিই। ওরা আবার হেসে উঠুক, প্রাণ ভরে বেঁচে উঠুক। ওদের পরিবারগুলোও এই পরিস্থিতি শক্তভাবে মোকাবেলা করুক। তাঁরা মেয়েদের দিকে স্নেহের ও নির্ভরতার হাত বাড়িয়ে দিক। বুঝিয়ে বলুক পাশে আছি সোনা, ভয় পেও না। জীবনের এমন কিছু অপচয় হয়নি, কাজেই নতুন করে আবার পথ চলতে শুরু করো।

আসুন প্রতিবাদে ঝলসে উঠি, আর একটা বার।

শেয়ার করুন: