বিয়ে মানে কি মেয়েদের নিজস্বতা বিসর্জন?

তাবাস্‌সুম নীহাল:

মেয়ে কাজ করে বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাজ মানে মেয়ে মডেল বা নায়িকা না। একটা বিজ্ঞাপন সাধারণ চোখে যা দেখা যায়, সেই পর্যন্ত আসতে তার পিছনে অনেকগুলো মানুষকে কাজ করতে হয়। মেয়ে সেই কাজ করাদের একজন।

মেয়ের জন্য যেই বিয়ের প্রস্তাবই আসে, সবাই মেয়ের চাকরির কথা শুনে হায় হায় করে পিছিয়ে যায়- “মেয়ে মিডিয়াতে কাজ করে? না না, এই মেয়ে তো নেওয়া যাবে না! মেয়ে তো খুব বেয়াড়া হবে তাহলে! কন্ট্রোল করা যাবে না! নিশ্চয়ই মেয়ে অনেক বেশি ফাস্ট!”

এক প্রস্তাব আসলো, তারা মেয়ে দেখতে চাইলো। মেয়ে নিজের পরিবারের সঙ্গে গেল ছেলের পরিবারের সাথে দেখা করতে। গিয়ে প্রাথমিক সালাম আদাব পর্ব শেষ করে বসতেই ছেলের মায়ের প্রশ্ন মেয়েকে- “তোমার এই চাকরির ভবিষ্যৎ কী?” প্রশ্ন শুনে মেয়ে থতমত!

চেহারাতে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছিলো, তাই ছেলের মা আবার বললেন- “না, মানে রিটায়ারমেন্টের পর তুমি এই চাকরিতে কী কী পাবে? কী কী সুবিধা আছে?” মেয়ে তো এমন প্রশ্ন শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। তাই কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলতে পারলো অবশেষে- “আসলে প্রাইভেট চাকরি তো, এখানে বাধ্যবাধকতামূলক রিটায়ারমেন্ট বলে তেমন কিছু নাই। যতদিন এ্যাক্টিভ থাকবো, ততদিনই কাজ করতে পারবো।” তারপর খাওয়া-দাওয়া করে যে যে যার যার বাসায়। আর কোনো অগ্রগতি নাই এই প্রস্তাবে।

তারপর আরো নানা ধরনের, নানাপদের প্রস্তাব আসে মেয়ের জন্য। সব প্রস্তাবই শেষমেশ ঘুরেফিরে এই বাণীতে গিয়ে শেষ হয়- মিডিয়াতে কাজ করা মেয়েকে তারা ছেলের বউ করতে পারবেন না! মেয়ে কী করবে? মেয়ে যে কাজটা ভালোবেসে করে! কপালগুণে এবং নিজের যোগ্যতায় সে সেই কাজেই যুক্ত হতে পেরেছে, যেই কাজ সে ছাত্রজীবন থেকেই করতে চেয়েছে। দিন যায়, মাস গড়ায়, বছরও পার হয়। সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত মেয়ের বিয়ের বয়সও প্রায় ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম হয়।

এরপর এক প্রপোজাল আসে মেয়ের জন্য। মেয়ের বাড়ি থেকে সরাসরি কথা হতে থাকে ছেলেপক্ষের সাথে। ছেলেপক্ষ বলে- “বাইরে কোথাও দেখা করতে যাওয়ার চেয়ে আমরা আপনাদের বাসায় আসি। মেয়েকে বলেন- একটু ভালো জামাকাপড় পরে রেডি হয়ে থাকতে। যেন ও বাইরে যাচ্ছে, এর মধ্যে বাসায় হঠাৎ গেস্ট চলে এসেছে। তাই আমাদের সাথে একটু দেখা করে, অল্প বসে, টুকটাক কথা বলেই ও চলে যায়।” মেয়ে এই পদ্ধতির তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলে দেয়- “দেখা হলে বাইরেই হবে, বাসায় না।” এই কথার পিঠে মেয়ের সাথে মেয়ের বাড়ির লোকজনের অনেক কথা কাটাকাটি হলো- বাসায় আসলে কী এমন ক্ষতি? অসুবিধা কোথায়? তোমার এতো মাথাব্যথা কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

নানান যুক্তিতর্কের পর মেয়েপক্ষ থেকে বলা হলো ছেলেপক্ষকে- “আসলে প্রথম দেখা তো, সেটা বাইরেই হোক। আর মেয়ের ঘরবাড়ি দেখার জন্য যদি হয়, সেটা তো ছেলেমেয়ে কথা বলে, দেখা করে যদি ওরা দুইজন এগোতে চায়, আপনারা তখনো এসে দেখে যেতে পারবেন।” তখন ছেলেপক্ষ বলে- “না না, ঘরবাড়ি দেখার জন্য না। আমরা জানি মেয়ের বাবা সরকারি চাকুরে ছিলেন এবং বেশ বড়সড় পদে থেকে রিটায়ার করেছেন। কাজেই ওরকম ৩/৪ টা বাড়ি আপনাদের আছেই ঢাকাতে। মেয়ে তো পাবেই। তাই ঘরবাড়ি দেখা লাগবে না আমাদের।”

এরপর ছেলেপক্ষকে আর কিছু না বলে মেয়েপক্ষ ঘটককে জানায়- “আসলে আমাদের মেয়েই পছন্দ করছে না। কাজেই আপনি এই প্রস্তাব বাদ দিয়ে অন্য আরেকটা দেখেন।” ছেলের মা ঐরকম লোভী লোভী একটা কথা বলার পরেও কেন তাকে মুখের উপর কিছু বলা হলো না? বা ঘটককে সত্যিটা জানানো হলো না? মেয়েবাড়ির লোকদের কাছ থেকে শুনলো- “আমরা মেয়েপক্ষ তো। মেয়েপক্ষকে এরকম অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়। আর ঘটককে বললে যদি মাইন্ড করে, তাহলে তো অন্য প্রপোজাল দিবে না। থাক, বলার দরকার নাই।” এই প্রস্তাবও গেলো।

এর মধ্যে মেয়ে চাকরি ছেড়ে নিজে আলাদা করে কাজ শুরু করে। মানে নিজের অফিস, নিজের বিজ্ঞাপনী সংস্থা। স্বপ্ন- বড় কিছু, ভালো কিছু করার। কয়েক মাস পর আসে আরেক প্রস্তাব। যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ, বায়োডাটা দেখার পর মেয়ে ফেসবুকে ছেলের নাম লিখে খোঁজে এবং পেয়েও যায়। প্রোফাইল ঘুরে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে- কেমন মানুষ হতে পারে সে? পাবলিক যেসব পোস্ট, সেগুলোই শুধু দেখা যায়। একটা পোস্টে গিয়ে পড়ে, এক বন্ধু বা পরিচিতজন জিজ্ঞেস করেছে- সে এখনো বিয়ে করছে না কেন? তার সিঙ্গেল ছবি তো অনেক দেখা হলো, এবার সবাই তার বউসহ ছবি দেখতে চায়। সেখানে সেই সম্ভাব্য পাত্র উত্তরে লিখেছে- “দিতে পারো কেউ, একজন দারুণ পার্সোনালিটিসম্পন্ন, ওয়ার্কিং, সেলফ ডিপেন্ডেন্ট মেয়ে? তাহলে বিয়ে করতে পারি।” এছাড়া আরো অন্যান্য অনেক পোস্ট দেখলো মেয়ে, যেখানে সেই ছেলে মেয়েদের সাথে নানাসময়ে হওয়া বিভিন্নরকম অত্যাচার, নির্যাতনের বিপক্ষে জোরালো মন্তব্য করেছে। দেখে মেয়ের মনে হলো- ভালোই। হয়তো এই ভদ্রলোকের সাথে কথায় মিলতে পারে।

এর বেশ কিছুদিন পর আবার অন্য আরেক প্রস্তাবের আবির্ভাব এবং যথারীতি মেয়েকে দেখানো। মেয়ে জানতে চাইলো- আগে যেটা এসেছিলো, সেটা কী হলো? ঐপক্ষ কিছু জানায়নি? মেয়ে জানলো- তারা নাকি একটা ঘরোয়া মেয়ে চায়, যার বাইরে অতোটা যাওয়ার দরকার নাই। কাজেই মেয়েপক্ষ থেকেই মানা করে দেওয়া হয়েছে, কারণ মেয়ে তো তার কাজ ছাড়বে না। মেয়ের কাছে অবাক লাগলো! বায়োডাটাতে মেয়ে দেখেছিলো- ছেলের মা এখনো কাজ করছেন, বেশ বড় একটা প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত আছেন। মায়ের ওয়ার্কিং স্ট্যাটাস, ছেলের ফেসবুক পোস্ট আর কমেন্ট, এইসব দেখে মেয়ে মনে করেছিলো- এই ফ্যামিলি হয়তো ওর কাজটাকে বুঝবে! কিন্তু আসলে যা খালি চোখে দেখা যায়, সবসময় যে তা-ই সত্যি না, আরো একবার প্রমাণ পাওয়া গেলো!

যাই হোক, পরের প্রস্তাব নিয়ে কথাবার্তা চলে বাসায়। প্রথমে ছেলেপক্ষ বলে- “আমরা আগেই দেখা না করি। ছেলে আর মেয়ে ফোনে কথা বলুক, ফোনে কথা বলে যদি ওরা দুইজন আগানোর মতো মনে করে, তারপর নাহয় দেখা হবে। আসলে একটা মেয়ের জন্য তো এটা একধরনের মানসিক চাপ। আমরা সেটা বুঝি।” মেয়েকে বলা হয়, ছেলের সাথে ফোনে কথা বলার জন্য। মেয়ে গাইগুই করে, দেখা নাই, চেনা নাই, জানা নাই, একটা লোকের সাথে ফোনে কথা বলতে হবে, বিয়ের উদ্দেশ্যে, অস্বস্তি হয় মেয়ের। তারপরও যুক্তিতে টিকতে না পেরে রাজি হয়। কারণ মেয়েকে বোঝানো হয়- ছেলেপক্ষ কতোখানি সহমর্মী যে, তারা মেয়ের মনের দিকে খেয়াল রেখে আগেই দেখা করার কথা না বলে ফোনে কথা বলার অপশন দিচ্ছে। মেয়ে যখন রাজি হয়, তখন ছেলেপক্ষ থেকে বলা হয়- থাক্‌, দেখাই হোক। দেখা হলেই তো কথা হবে। আলাদা করে একবার কথা বলা, একবার দেখা করার দরকার নাই।

মেয়ে আর কী বলবে! একবার ‘সহমর্মিতা’ দেখিয়ে দেখা না করে আগে কথা বলতে বলে! আবার এখন কথা বলা বাদ দিয়ে আগে দেখা করতে বলে! মেয়ে বুঝে না- ছেলেপক্ষ আসলে কী চায়! তারপর দুইপক্ষেরই সুবিধা মতো সময়ে একদিন দেখা করতে যায় ছেলে আর মেয়ে, সাথে যার যার পরিবার। টুকটাক কথাবার্তা, জিজ্ঞাসার পর ছেলে আর মেয়েকে আলাদা বসানো হয় নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য। নিজের নিজের পড়ালেখা, পরিবার, কাজ, আরো অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলার পর ছেলে জানতে চায় মেয়ের কাছে- তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? মেয়ে জানায়- যেহেতু নিজের অফিস শুরু করেছে, কাজেই এটাকে সে দাঁড় করাতে চায়। নতুন কিছু করা এখানে খুব কঠিন, কেউ কাজ দিতে চায় না, নতুন দেখে শুরুতেই ভরসা করতে পারে না, কাজেই স্ট্রাগল করতে হবে। আর প্রতিযোগিতার বাজার, তাই নিজের একটা শক্ত অবস্থান তৈরির জন্য এর পিছনে সময়, মনোযোগ, পরিশ্রম সবই বেশি দেওয়া জরুরি এখন। ছেলে শুনে সাধুবাদ জানায়। আরো বলে- যে যেই কাজ করতে চায়, তাকে সেটাই করতে দেওয়া উচিৎ, তাহলেই বেস্ট কাজটা আসা সম্ভব।

মেয়ের কাছে ভালোই মনে হয়ে ছেলের কথা শুনে। এরপর মেয়ে সরাসরি জানতে চায় ছেলের কাছে- হবু স্ত্রী’র কাছে তার প্রত্যাশা কেমন? ছেলে বলে- তার বাসায় সে এবং তার মা। মায়ের একটু বয়স। এবং বেশ রাগী হওয়ার কারণে কোনো কাজের লোকও বাসায় টিকতে পারে না। কাজেই যে মেয়ে বউ হয়ে আসবে, তাকে একদম সমস্তকিছুর দায়িত্ব নিতে হবে, তা সে ব্যবসা করুক, বা চাকরি করুক, বা বাইরে কোনো কাজই না করুক, সেটা বউয়ের ব্যাপার। কিন্তু যেমন করেই হোক, সব তাকেই ম্যানেজ করতে পারতে হবে। ছেলের সেখানে কিছু করার নাই। এবার মেয়ে একটু দমে যায়! তারপরও কিছু বলে না আগেই। অন্যান্য কথার মধ্যেই দুইজনের পরিবার থেকেই তাগাদা দেওয়া হয়- এবার ওঠা যাক, রাত হয়ে যাচ্ছে। লাগলে নাহয় পরে মোবাইলে কথা বলে নেওয়া যাবে। এরপর দুইপক্ষ বিদায় নিয়ে বের হয়।

দুই তিনদিন পার হয়, এরপর ছেলের দিক থেকে জানতে চাওয়া হয়- “মেয়ের অফিস তো আমাদের এলাকা থেকে অনেক দূরে। যেহেতু মেয়ের নিজের অফিস বলছে, তাহলে কি অফিসটা শিফট করে আমাদের বাসার আশেপাশে নিয়ে আসা যায়?” মেয়ে এই আবদার শুনে আকাশ থেকে পড়ে! মেয়ের মনে পড়ে, সেদিন কথায় কথায় ও সুন্দরমতো জানিয়েছে- তার অফিস যে এলাকায়, কেন সেই এলাকাটা বেছে নেওয়া হয়েছে।

আর অফিস কি একটা বিস্কুটের বয়াম যে, বললেই এক তাক থেকে বের করে নিয়ে খুশিমতো আরেক তাকে রেখে দেওয়া যায়? এর আগে পিছের কাজ, প্রস্তুতি, কাগজপাতি, আসবাবপত্র, লোকজন- চাইলেই সব একবারে তুলে নিয়ে যে কোনো সময় আরেক জায়গায় সরিয়ে ফেলা যায়? আর যারা বিয়ে তো পরের কথা, বিয়ের কথাবার্তা শুরুর আগেই এমন ধরনের আবদার রাখতে পারে, তারা পরে তাহলে আরো কী কী বলতে পারে, সেটা কি কিছুও আঁচ করা যায় না? ওদের সাথে কথা বলে এসে মেয়ে বুঝেছিলো- এই পরিবারে এখন এমন একজন মেয়ে দরকার, যে পরিপূর্ণভাবে ঘরেই সময় দিতে পারবে। সোজা বাংলায়, একজন ‘গৃহিণী’ মেয়ে লাগবে। এমন অনেক মেয়েই আছে, যারা স্বেচ্ছায় মনোযোগ দিয়ে শুধু সংসার করতে আগ্রহী। তারা অবশ্যই কোনোদিক থেকে ছোট না। সবার চিন্তাভাবনা তো আর এক হবে না।

কাজেই যারা গৃহিণীই হতে চায়, এটা সম্পূর্ণ তাদের নিজেদের ইচ্ছা। তাহলে প্রয়োজন অনুযায়ী, পরিষ্কার করে বলে কয়ে তেমন একটা মেয়েই কি খুঁজে নেওয়া ভালো না? নিজের পছন্দে, আগ্রহে, ভালোবাসায়, যোগ্যতায় বাইরে কাজ করা একটা মেয়েকে তার চেহারা দেখে, পরিবার দেখে, কথা বলে পছন্দ করে তাকে তার কাজের ক্ষেত্রে নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করা কেন? নাকি সমাজে এই নাম কেনাটা খুব জরুরি- “আমাদের বাড়ির বউ বাইরে কাজ করে, আমাদের কারণে ওকে ওর কাজ ছাড়তে হয়নি।” আর এই নাম কেনা হয়ে গেলে মেয়ের নিজের যোগ্যতায় করা কাজ থেকে সরিয়ে তাকে নামকা ওয়াস্তে এবং শ্বশুরবাড়ির সুবিধামতো ও অনুমতিসাপেক্ষে অন্য একটা যে কোনো কাজে ঢুকে যেতে বলা কতোখানি যুক্তিযুক্ত?

মেয়ে বুঝে- বিয়ে মানে শুধু ফটোশুট, রোমান্টিসিজম আর প্রেমের ফ্যান্টাসি না। বিয়ে মানে সংসার, সংসার মানে মেয়েকে হতে হবে দশভুজা দুর্গা। কিন্তু তা হতে গিয়ে মেয়েকে নিজের নিজস্বতা বিসর্জন দিতে হবে? মেয়ের মেধার অপচয় হওয়াটা কি এখানে কোনো ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না? নাকি শুধু মেয়ে বলেই যতোই উচ্চশিক্ষিত, যোগ্যতাসম্পন্ন বা মেধাবী হোক না কেন, প্রায়োরিটি লিস্টে জায়গা পাবে না ‘ক্যারিয়ার’? ঘরকন্নাই হতে হবে একমাত্র ধ্যানজ্ঞান?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.