জান্নাতুল মাওয়া আইনান:
মেয়েটির সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো কার্জন হলের লাল দালান গুলোর সামনের সবুজ ঘাসে মোড়া রাস্তাটায়। আমি কখনোই ভাবিনি এটাই ওর সাথে শেষ দেখা। মেয়েটাও ভাবেনি। ওর মুখে ছিল প্রাণখোলা হাসি। ততদিনে আমরা সবাই জানি, মেয়েটাও জানে, যে ওর ক্যান্সার হয়েছে। কিন্তু তাতে ওর মুখের হাসি একটুও কমেনি!
ওর ব্রেস্ট ক্যান্সার, মাত্র সেকেন্ড স্টেইজে। আমরা সবাই জানতাম ক্যান্সার ওকে পরাজিত করতে পারবে না। যে মেয়ে কেমোথেরাপি চলার সময়েও পরীক্ষায় অংশ নেয়, ক্যান্সারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পরীক্ষায় পাশ করে এবং সমাবর্তনে অংশ নেয়; ভি চিহ্ন দেখিয়ে ছবি তোলে, সেই মেয়েটাকে ক্যান্সার কিছুই করতে পারবেনা। পারেও নি। যেই মেয়েটা ক্যান্সারের মত ভয়াবহ রোগের জটিল চিকিৎসার পুরোটা সময় অসম্ভব মানসিক সাহসের সাথে পাড়ি দিলো; ঠিক সেই মেয়েটাই ক্যান্সার থেকে সেরে উঠে একদিন আত্মহত্যা করলো।
কী অবাক কাণ্ড তাই না?
না, অবাক কাণ্ড না।
ক্যান্সারের ভয়াবহতার কথা আমরা এক বাক্যে স্বীকার করি, সবাই জানি। ক্যান্সারের প্রতিকারে, প্রতিরোধে কত শত আয়োজন করি। কিন্তু আমরা জানি না যে, এই ক্যান্সারের চেয়েও ভয়াবহ একটা রোগকে আমরা খুব আনন্দের সাথে ঘাড়ে বয়ে বেড়াই। আবার সেই রোগ নিয়ে মাঝে মাঝে খুব বড়াইও করি!
এই রোগটা হচ্ছে ‘সমাজ কী বলবে?’ রোগ। সমাজের তৈরি শিকলে নিজের হাত-পা বেঁধে ফেলা এবং হাতের কাছের সবার হাত-পা বেঁধে ফেলার জন্যে নানানভাবে চাপ দেয়ার রোগ!
ক্যান্সার থেকে বেঁচে ওঠা, বিশেষত ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে বেঁচে ওঠা একজন অবিবাহিত মেয়ে এই সমাজের বিশিষ্ট চিন্তাবিদদের কাছে একটি জ্বলজ্যান্ত সমস্যা!
বিয়ে ছাড়া এই সমাজ মানব জীবনের, বিশেষ করে একটা মেয়ের জীবনের আর কোন উপলক্ষই খুঁজে পায় না। একে কে বিয়ে করবে, এই ভেবে তারা নাকের পানি চোখের পানি এক করে মেয়েটার সামনেই দিনরাত হা হুতাশ করেন। তাদের মেকি দীর্ঘশ্বাসের চাপে পড়ে অসম্ভব সাহসী একটা মেয়ে ভয়ে গুটিয়ে যেতে থাকে। তারও ধারণা হতে থাকে যে, বিয়ে ছাড়া তার আর কোনো গতিই নেই। এই গতিহীন জীবন বয়ে বেড়াতে তাঁর আর ইচ্ছা হয় না। কারণ সে দেখে যার ভরসাময় হাত ধরে সে একদিন এই পৃথিবীর আলো হাওয়া চিনেছে, সেই মায়ের হাতটাও সমাজের চাপে দুর্বল হয়ে কাঁপছে।
সমাজের মানুষের আনন্দের কথা চিন্তা করে তিনি নিজের মেয়ের কষ্টের কথা বেমালুম ভুলে যান। ঘরে প্রায় প্রতিদিন আসতে থাকে নানান প্রকারের নানান আকারের ‘উদ্ধারকর্তা’। কিন্তু কেউই আর শেষ পর্যন্ত ‘উদ্ধারকাজে’ এগিয়ে আসে না। এই সমাজের নিয়ম অনুযায়ী তো মানুষ বিয়ে করে শুধু বাচ্চা পয়দা করার জন্যেই। এই মেয়েকে দিয়ে কি সেই মহান কর্ম সম্পাদিত হবে? এই ২১ কোটির দেশে আরো দুই তিনটা মানুষের জন্ম না দিলে কি আর মানব জন্ম সার্থক হবে! সমাজ কী বলবে! আহা সমাজ!
এবার দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পড়ে বের হওয়া মেয়েটিও মনে করতে থাকে, তাকে দিয়ে যেহেতু সমাজের দুটো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজই হবে না, তবে আর তাকে দিয়ে কী হবে! মায়ের ভেঙ্গে পড়া দেখে আরো ভয়ানক কষ্টে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায় মেয়েটির মন।
ঠিক কতোটা কষ্টে হৃদয় মন ভারাক্রান্ত হলে একটা ক্যান্সার থেকে বেঁচে ওঠা রোগী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় এটা ভাবার চেষ্টা করি। আমাদের এই সমাজ কতো ভয়ানক চাপ দিতে পারে একজন মানুষকে, সেটা ভাবি, ভাবতে ভাবতে আমার ঘেন্নায় মুখ চোখ কুঁচকে যায়!
আমি এতো সমাজ-টমাজ মানি না! সেদিন একজন আমাকে সবক দিচ্ছিলো সমাজ নিয়ে। বলছিলো, সমাজে থাকতে হলে কিছু নিয়ম মানতে হয়, ভালো না লাগলেও মানতে হয়! আমি তাকে বলেছি, আমি এসব মানি না। তখন সে অধৈর্য হয়ে বলেছিলো, তাহলে সমাজ থেকে বের হয়ে যাও। আমি বলেছি, আমি তো সমাজের বাইরেই আছি। সমাজ তো কোন দেয়াল তোলা বাড়ি না, যে এর দরজা দিয়ে আয়োজন করে বের হতে হয়! এটা একটা বিমূর্ত ধারণা, এ আছে মনে করলে আছে, নাই মনে করলে নাই।
দয়া করে সমাজের বেঁধে দেয়া নিয়মে নিজেকে বাঁধতে না পারলে অস্থির হবেন না। আর আমাদের মায়েদেরকে বলি, প্লিজ, আপনি নিজে সমাজের কথায় উঠবস করেছিলেন বলে ভাববেন না, আপনি বিশাল মহৎ কাজ করে ফেলেছেন। দয়া করে সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও নিজের সন্তানের কষ্ট পীড়িত হাতটি ধরুন। আপনার একটু সাহস ওই ক্ষীণ ভীরু বুকে কতটা আশার আলো জাগায় আপনি হয়তো সেটা জানেনও না।
সমাজের কিছু মানুষ যে কী ভয়াবহ রকমের নিষ্ঠুর এটা দেখেছিলাম আমার মায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসা চলার সময়ে। আমার মা একজন ব্রেস্ট ক্যান্সার সারভাইভার। কেমোথেরাপি শেষে রেডিও থেরাপি দিতে তিনি একা একাই হাসপাতালে যেতেন। বলতেন, আমার জন্যে তোদের কাজ কতদিন বন্ধ রাখবি? এই অসম সাহসী নারীটি নিজেই বিল পে করে, রেডিওথেরাপির রুমে গিয়ে উপস্থিত হতেন। প্রায়ই ডাক্তাররা জিজ্ঞেস করতেন রোগী কোথায়? তখন তিনি হেসে বলতেন, আমিই রোগী।
আম্মু জানেন তাকে সব একাই করতে হবে। তাঁর জীবন সঙ্গী অনেক আগেই গত হয়েছেন। তাই রেডিওথেরাপির সাথে হিসাব মিলিয়ে তিনি ঘরের বাজার আগে ভাগেই করে রাখতেন। তোলা কাজ সেরে রাখতেন, তারপর যেতেন ডাক্তারের কাছে। তো, আমাদের সমাজের চোখে একজন ক্যান্সারের রোগীর যে দৃশ্য চোখে ভাসে সেটি হলো, বিছানায় পড়ে থাকা একটি অর্ধমৃত মানুষ।
কিন্তু সমাজের কিছু লোক যখন দেখলো, আরে এই সম্পূর্ণ টেকোমাথার (কেমোথেরাপির কারণে তখন আম্মুর সব চুল পড়ে গিয়েছিল) এই মহিলা দেখি মচমচ করে একা একাই চলাফেরা করে, তখন তাদের ধারণা হলো, এর আসলে কিছুই হয় নাই। তাই তারা চাইলো, নিজেদের অসুস্থতার চিকিৎসার জন্যে আমার অসুস্থ মায়ের বাসায় আসতে। আম্মু প্রথমে একবার না করলেও পরে ভাবলো, আহা, আমারই তো আত্মীয়, বিপদে আপদে তো একে অন্যের পাশে থাকাই দরকার। থাক আসুক।
এই হলো আম্মুর জীবনের অনেকগুলো ভুলের একটা। এই লোকগুলো আমাদের বাসায় এসে যখন দেখলো, আম্মু নিজেই সব কাজ করতে পারে, তাদের মাথা খারাপ হয়ে গেল! তারা ধরেই নিলো এই মহিলার উচিত আত্মীয় স্বজনের সেবায় নিজেকে আগের মতই নিয়োজিত রাখা। আম্মু কেন প্রথমদিকে তাদেরকে বাসায় আসতে নিষেধ করেছিলো এই ব্যাপারটা নিয়ে তারা রীতিমতো হইচই শুরু করে দিলো! যদিও তারা দেখে গিয়েছিলো যে, কাশতে কাশতে আম্মুর অবস্থা খারাপ, কেমোর প্রকোপে তার মাথার একটা চুলও নাই। যদিও তারা জানতো, চিকিৎসার পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় এই মহিলার ব্যাঙ্কের টাকা পয়সা এখন তলানিতে, তারা এও জানতো, তিনি একাই ঘরের বাজার সদাই করেন। কিন্তু, তাতে কী? এই মহিলা তো এখনো বিছানায় পড়ে যায় নাই! একজন সহায় সঙ্গীহীন নারীর উচিত আত্মীয়-স্বজন যখনই বলে তখনই যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া।
তাদের এই আচরণে আম্মু যে কী ভয়ানক মানসিক কষ্টে ছিলেন সেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাই আবার যখন অনেকে বলে, থাক, মাফ করে দাও। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। যারা এতো বড় অন্যায় আচরণ করলো, তারা তো আজ পর্যন্ত মাফ চাইলো না! আমার মা কেন আগ বাড়িয়ে মাফ করে দিবে?
এই যে ওই মেয়েটার সাথে যে এতো বড় অন্যায় করলো তার আশেপাশের মানুষেরা, তারা কি মাফ চেয়েছে? তারা কি একবারের জন্যেও অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছে? উলটো কী করেছে জানেন? এই মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে এই ‘অপরাধে’ তাকে জানাজা ছাড়াই মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে চেয়েছে!
মানুষ যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, এই সমাজের দিকে ভালো করে না তাকালে আমরা এটা বুঝতেই পারবো না!