‘ঘরজামাই’ মন্দ হলে, ‘ঘরবউ’ কেন হই!

সুচিত্রা সরকার:

‘ঘরজামাই’ শব্দটার সঙ্গে একদলা কাদা লেগে আছে। শ্লেষের অন্ত নেই শব্দটিতে! আছে ‘স্ত্রৈন স্ত্রৈন’ গন্ধ! তাই শব্দটা পুরুষের জন্য চরম অবমাননাকর, এই সমাজে।

কোনো এক সিনেমার সংলাপ শুনেছিলাম, ভিলেন শ্বশুর, তার মেয়ের ভাবী জামাইকে বলছে, তোকে আমি ‘ঘরজামাই’ করে রাখবো! ভিলেনের অট্টহাসিতে সিনেমার বাড়িটাও কাঁপছিল! তারপর সেই ‘সিনে’ যত রকমের নাটকীয়তা দেখা গেল, আমার শৈশব মনে গেঁথে রইলো- ‘ঘরজামাই ভারী খারাপ ব্যবস্থা! খুব মন্দ! অপমানের!’

সমাজের চোখে গর্বের বিষয় হচ্ছে – পিতামাতা কন্যাকে খাইয়ে- পরিয়ে-বাঁচিয়ে রেখে জামাইয়ের হাতে তুলে দেবে। জামাই ময়ুরপঙ্খী নৌকায় চড়ে অথবা পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় উড়িয়ে রাজ্য জয়ের মতো একটা ‘টুকটুকে বউ’ নিয়ে বাড়ি ফিরবে! নিজের বাড়িতে! সে বাড়িতে পরের বাড়ির কন্যাটির বসবাসকে কেউ ‘ঘরবউ’ বলে না।

আজ অবধি, এই ব্যবস্থা নিয়ে কারো কোনো নালিশ শুনিনি। কোনো মেয়ে বরকে বলেনি, ‘ছিঃ এসব তুমি কী বলছো! লজ্জা করে না তোমার আমাকে ‘ঘরবউ’ হবার প্রস্তাব দিতে!

শুনিনি কখনো!

আচ্ছা বলুন তো পাঠক, ‘ঘরজামাই’ মন্দ হলে, ‘ঘরবউ’ কেন হই! আমরা? নারীরা?

আমার দিদিমা (‘কেন কন্যাসন্তান চাই না আমি’ নিবন্ধে উল্লেখ) সর্বস্ব বিক্রি করে কন্যাকে পার করতে পেরেছেন। ঘরজামাই প্রথাটি অপমানের না হলে হয়তো তাঁকে আজ বস্তির চৌদ্দ’শ টাকা ঘরে থাকতে হতো না। মেয়ের আলিশান ফ্ল্যাট বাড়িতে ‘দুধভাত’ হয়ে থাকতেন!

যদি ‘ঘরজামাই’ প্রচলিত ব্যবস্থায় বৈধ হতো, তবে গল্পগুলো এতো বেদনার হতো না।

বৃদ্ধ বাবা কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত। দিন গুনছে বাবা! তাঁর একমাত্র সন্তানের (কন্যা) আগামী মাসে বিয়ে। বিয়ের পর চলে যাবে অস্ট্রেলিয়া! বরের কাছে। কন্যাটি কাঁদতে কাঁদতে গতকাল বাবাকে প্রশ্ন করেছে, তোমাদের আর সন্তান নেই কেন? বাবা নিরুত্তর!

আরেকটি মেয়ে সবে অনার্স পাস করেছে। পাত্রপক্ষ প্রায়ই দেখতে আসছে তাকে। যারাই বলছে, গ্রামে গিয়ে থাকতে হবে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে, মেয়েটি তাদেরই ফিরিয়ে দিচ্ছে। কারণ ও গ্রামে চলে গেলে বাবা-মাকে দেখবে কে? ওদের যে আর কেউ নেই! এমন করে করে হয়তো, ওর বয়সটাই বেড়ে যাবে!

সমাজেরও চাপ বাড়বে কন্যা দায়গ্রস্থ পিতামাতার প্রতি। তারপর একদিন কোনো দূরে গাঁয়েই চলে যাবে কন্যাটি! আর অসুস্থ পিতা হয়তো কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের ওষুধটা নিজেই খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে! অথবা তারচে’ও নিদারুণ কোনো ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে!

আবার যদি এমন হয়, পরিবারে ছেলে আছে, মেয়েও। ছেলেটি বাবা-মায়ের দায়িত্বই নিল না কোনোদিন! বৃদ্ধ পিতামাতা একা একা ‘অসহায়’ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন! আর মেয়েটি? সে দায়িত্ব নিতেই পারে না! শ্বশুরবাড়ির অমোঘ উক্তি, ‘তোমার কী করার আছে ওদের জন্য! তোমার তো করার কথা নয়!’

এরকম আরো আছে। শত উদাহরণ। আরো তৈরি হচ্ছে শত- হাজার গল্প। নিউক্লিয়ার পরিবারের বৃদ্ধ পিতামাতার গল্প। যে গল্পগুলো সুন্দরভাবে শেষ হতে পারতো, ‘ঘরবউ’ সিস্টেমের বদলে ‘ঘরজামাই’ ব্যবস্থাটা বেছে নিলে! তা আর হবে না!

কারণ বাবা- মা (ব্যাকরণ বইও একথা মানে) জানে, কন্যাসন্তানটি ‘সম্প্রদান কারকে’র ছাড়া আর করো নয়!

অথচ ইতিহাস কিন্তু বলে অন্য কথা! এই ইতিহাসটা অনেক পেছনের! মাতৃতান্ত্রিক এক অসাধারণ সমাজ ব্যবস্থার খোঁজ আমায় দিয়েছিলেন রাহুল সাংকৃত্য়ায়ন আর দেবী প্রসাদ মুখোপাধ্যায়!

সেই ব্যবস্থা নিয়ে তারা বলেছেন বিস্তর! আর আমি জেনেছি এই, মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে পরিবারের মাকে কেন্দ্র করে! মেয়েকে কেন্দ্র করে। সম্পত্তির অধিকার শুধু মেয়েদের! সেখানে অন্য গোত্রের পুরুষরা বিয়ে করে নারীর গোত্রে সংযুক্ত হয়! আবার পুরুষটির মাও তার (পুরুষটির) পরিবারের সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির কেন্দ্রে তখন মেয়েরাই। তখন সকলে আজকের সমাজে যে ‘ঘরজামাই’ ব্যবস্থা, সেই ব্যবস্থাতেই থাকতো! মেনেও নিতো। কারণ সম্পদের বন্টন ব্যবস্থাই ছিল এরকম যে, ছেলেদের সেখানে কোনো অধিকার ছিল না। মায়ের পরিচয়েই সন্তান পরিচিত হতো!

তারপর একটু একটু করে সম্পত্তির অধিকার চলে গেল পুরুষের হাতে। পুরুষের ঘর হলো। নারীর প্রতি কর্তৃত্ব পেল। এবং ‘ঘরজামাই’ ব্যবস্থাটা ঘৃণার সঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে, ‘ঘরবউ’ ব্যবস্থার আইন জারি করলো!
সবই অর্থনীতি আর সম্পত্তি বন্টনের কারসাজি! নারী বা পুরুষ সেই সিস্টেমের দাস মাত্র!

তাই ‘ঘরজামাই’ শব্দটার মধ্যে বিষ ঢেলে দেয় সমাজ! যার অর্থনৈতিক শক্তি আছে, সম্পদের প্রতি যার পূর্ণ অধিকার, সে কেন অন্যের বাড়িতে থাকবে?

হয়তো (কল্পনা করি) মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ভাঙার জন্য এটাও একটা কারণ ছিল। পরিবারের অর্থনীতির, সম্পদের অধিকার ছিল শুধু মেয়েদের উপর! যদিও পরিবারটা নারীপুরুষ উভয়েরই!

কিন্তু এভাবেই কি চলতে থাকবে? কয়েক হাজার শতাব্দী ধরে নারী রাজত্ব করবে? তারপর আবার পুরুষ! তারচে আমার মনে হয় (একান্ত নিজের মত) পরিবারে, সমাজে সকল কিছুর অধিকার যদি দুইজনকেই দেওয়া যায়, অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়!

যেমন, এই ঘরজামাই বা ঘর বউ কনসেপ্ট! যদি পরিবারে ছেলেমেয়ে সম্পদের সমান ভাগ পায়, তাহলে সেখানে লৈঙ্গিক বৈষম্য হবে না। নারী পুরুষ সেখানে সমান। পরিবারে ছেলেটার যে মর্যাদা, মেয়েটাও তাই।

সন্তানকে বিয়ে দেয়া তখন দায়িত্ব হবে পিতামাতার। কোনো কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা রাস্তায় ভিক্ষে করতে বেরোবে না কন্যাকে পার করার জন্য! ব্যাকরণে (সমাজেও বৈকি) ‘কন্যাকে সম্প্রদান করো’ বাক্যটি আর ‘সম্প্রদান কারক’ সেকশনে থাকবে না। ‘কর্তব্য কারকে’ আনন্দে হুটোপুটি খাবে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান!

আর বিয়ের পর বর-কনের সুবিধা, ইচ্ছা, পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী তারা বসবাস করবে! হয়তো বরের বাড়িতে! বা কনের! ততদিনে ‘ঘরজামাই’ বা ‘ঘরবউ’ শব্দটি জাদুঘরে স্থান পাবে! তারপর কোনো একজন পাঠক নৃ বিজ্ঞানের বইয়ে আবিষ্কার করবে, অতীতে এমন দুটো শব্দের চল ছিল, যা নারীপুরুষকে শুধু লাঞ্ছনাই দিয়েছে!

ভবিষ্যতের পাঠকটির অদ্ভুত হাসিমাখা মুখটা (অতীত ব্যবস্থার জন্য শ্লেষ থাকবে সে হাসিতে) কল্পনা করতে মন্দ লাগছে না!

২২.০৮.২০১৭
লালবাগ, ঢাকা
রাত ১০.২৭ মিনিট

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.