তানিয়া মোর্শেদ:
নারীর জীবনে প্রতিবন্ধকতা পদে পদে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রভেদে কিছু বিষয়ের এবং মাত্রার তারতম্য ঘটে। নারীবাদ কোন রকেট সায়েন্স নয়। এটা সবারই বোঝার কথা। অথচ ক’জন তা বোঝেন, বা বুঝতে চেষ্টা করেন?
নারীবাদ বোঝার জন্য কতগুলো বিষয় মনে রাখা পূর্ব শর্ত। নারীর প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ তা প্রিয়জন, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, ধর্ম যে বা যেখানেই বিদ্যমান তাকে চেনা এবং স্বীকার করা, প্রতিবাদ করা, প্রতিহত করার মতো সাহস থাকতে হবে। নারীর প্রতি কি কেবল বর বা বরের পরিবারই বিরুদ্ধ আচরণ করে থাকে? নিজের জন্মগতভাবে পাওয়া পরিবার করে না? বাবা-মা সবচাইতে ভালবাসেন একথা প্রতিটি শিশুকে ভীষণভাবে আশ্বস্ত করে। কিন্তু একথাও শিশুকে বোঝাতে হবে, ন্যায়-অন্যায় তার সাথে যেই করুক, তা যেন সে চিহ্নিত করতে পারে। বাবা-মা বা প্রিয়জনের অন্যায় আচরণও যেন সে চিহ্নিত করতে পারে, সেভাবে তার মানসিক বিকাশ যেন হয় তা দেখা ভীষণ জরুরি।
বাবা-মা মানুষ। তারা কোনো ধারণা বা আবেগ নন। বাবা-মায়ের ভালবাসা, ত্যাগ যেমন বুঝতে শিখতে হবে, ঠিক সেইভাবে বাবা-মায়ের মানবিক বা অমানবিক আচরণকেও চিহ্নিত করতে জানতে হবে। এশিয়ান সংস্কৃতিতে বাবা-মাকে দেবতা-দেবীর আসনে বসানোর প্রবণতা। যেকারণে অনেকেই নিজের বাবা-মায়ের ভুল বা অমানবিক আচরণ চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়। বাবা-মা বা পরিবারের অন্য কারো ভুলকে ভুল বলতে সাহস লাগে। কিন্তু এটা না বলতে পারার জন্য কত জীবন বদলে যায়! বিশেষত মেয়েদের। কত মেয়ের পড়ালেখাই হয়নি, স্বপ্ন ছোঁয়া তো আরও পরের কথা!
মেয়েকে ভালবাসা মানে তাকে একটি সুন্দর, সুস্থ জীবনের শিক্ষা দেওয়া। পড়ালেখার পাশাপাশি সে যেন সমস্ত অন্যায় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে সে ব্যাপারে শিক্ষা ভীষণ জরুরি। অন্যায়কারী রাস্তার বখাটেই হোক, আর নিজের বর হোক। সে বর অল্পদিনের চেনা বা দশ বৎসরের চেনা প্রেমিক হোক, বা পাঁচ মাস বা পাঁচ বৎসরের সংসার করা হোক। মানুষ প্রেমে পড়ে, বিয়ে করে। প্রেমে পড়লেই যে সে সঠিক মানুষ, বা সঠিক বর হবেই তার নিশ্চয়তা নেই। বিয়ে করলেই যে সে বিয়ে চিরদিন টিকিয়ে রাখতে হবে, তাও নয়।
নির্যাতিত জীবনের ঘানি কোনো যুক্তিতেই টেনে নেবার মানে নেই। মাকে নির্যাতিত হতে দেখলে, সন্তানরা মানসিকভাবে কখনোই ভালো থাকে না। শুধু তাই নয়, সাইকোলজি বলে, নির্যাতিত মায়ের ছেলে অনেক সময়ই নিজে নির্যাতক হয়, আর মেয়ে নির্যাতিত হয় নিজেদের বিবাহিত জীবনে। পুরুষরা যে নির্যাতিত হোন না, তা কিন্তু আমি বলছি না। মানসিকভাবে নির্যাতিত পুরুষ যেমন আছেন, তেমন শারীরিকভাবে নির্যাতিত পুরুষও আছেন। তবে সংখ্যায় নির্যাতিত পুরুষ নারীর থেকে লক্ষ লক্ষ গুণ কম।
আমার লেখা সব নির্যাতিত মানুষের জন্যই। তবে নারীই যেহেতু প্রধান শিকার তাই “নারী” করে লিখছি। শিশুকে যদি ছোট্টবেলা থেকেই ন্যায়-অন্যায় বোধ সঠিকভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহলে সে শুধু তার প্রতি অন্যায়ই নয়, যেকোনো অন্যায়কে চিহ্নিত করতে শিখবে। অন্যায়কারী নিজের নিকটজন কেউ হলে তা শিশু কেন, সবাইকেই প্রচণ্ড আহত করে। সেই অন্যায় নিজের সাথেই হোক, বা অন্য যে কারো সাথেই হোক। কিন্তু অন্যায়কে অন্যায় হিসাবে চিহ্নিত করার শিক্ষা থাকতে হবে। যেমন শিক্ষা থাকতে হবে ব্যক্তি মানুষ ছাড়াও সমাজ-সংস্কৃতি-রাষ্ট্র-ধর্মের ভুল বা অন্যায়কে অন্যায় হিসাবে চিহ্নিত করা, স্বীকার করা, প্রতিহত করা, প্রতিবাদ করা।