আনিস ভাই, তোমাকে সবসময় ভালবাসি

শারমিন শামস্:


বিষন্নতা একটা রোগ। একদিন আমি এই রোগে ভয়াবহ ধরনের আক্রান্ত ছিলাম। ভীষণ সুন্দর কোনো জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি প্রিয় মানুষের সাথে। কথা নাই, বার্তা নাই তীব্র বিষন্নতা আমাকে ঘিরে ধরতো। আমি কোন কিছুতেই কোন উৎসাহ পেতাম না। বিকেলে বাড়ি ফিরলে বিষন্নতা হতো, একা থাকলে হতো, সকলের মধ্যে থেকেও হতো। বিষন্নতা এমনই এক রোগ। রাতের পর রাত আমি জাগতাম। কেন জাগতাম, সে আমি জানিনে।

জীবনের নানা পর্বে এই বিষন্নতা আমাকে ভুগিয়েছে। এমনকি মেয়েকে গর্ভে নিয়ে আমি যে তীব্র ডিপ্রেশনের মুখোমুখি হয়েছিলাম, তা কাটাতে আমাকে যেতে হয়েছে সাইকো থেরাপির ভিতর দিয়ে।
এরপর একদিন বা কোনদিন, কোনো এক সুন্দর সময়ে আমার বিষাদ কেটে গেল। আমি নিজেকে বিষন্নতা থেকে বের করে আনলাম। নিজের সাথে নিজের একটা দারুণ বোঝাপড়ার ভিতর দিয়ে গিয়ে আমি আবিস্কার করলাম, ইচ্ছে করলেই বিষন্নতাকে জয় করে জীবনে খুব আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকা যায়। তবে তার জন্য চাই নিজেকে ভালোবাসবার ক্ষমতা আর ইচ্ছে। তারপরই নিজেকে ভালোবেসে চারপাশটাকে রঙীন করে ফেলতে ইচ্ছে করবে, আর সেই ইচ্ছের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যা যা করা প্রয়োজন তাই করে ফেলতে পারাটাই একটা বিরাট ঘটনা। এই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারলেই জীবন আনন্দময়। শুধু মনে রাখতে হবে, জীবন বহমান। জীবন সুন্দর। কোনো তাড়াহুড়ো নয়। কোনো অর্থহীন প্রতিযোগিতা নয়। শুধু নির্মল সুন্দরের ভিতরে বেঁচে থাকার মধ্যেই আনন্দ লুকিয়ে থাকে। আর কিছু নয়।


আজ বহু বহুদিন পর ভীষণ ডিপ্রেশন হলো। সারাটা বিকেল, সন্ধ্যা সেই তীব্র বিষাদের সাথে যুদ্ধ করলাম। ভয় ভয় লাগলো। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। চেপে ধরছে। মন হু হু করে উঠছে। জীবনটা নিতান্তই তুচ্ছ আর ভয়ংকর মনে হচ্ছিল।
আমি এর কারণ জানি। আমার মাথার উপর থেকে একটা ছায়া সরে গেছে। ভালোবাসার ছায়া, বন্ধুত্বের ছায়া, যখন তখন ছুটে যেতে পারবার ছায়া, যা ইচ্ছে তাই বলবার ছায়া। আমার এনসাইক্লোপিডিয়া, আমার ফিলোসফার, আমার সমস্ত কাজের অন্ধ সমর্থক- আমার বন্ধু- আমার আত্মার আপনজন- আনিস ভাই, আনিস মাহমুদ চলে গেছেন। আর কোনদিন ফিরে আসবেন না।


আনিস ভাইয়ের সেই চেহারাটা মনে করতে চেষ্টা করলাম। সেই লম্বা একহারা গড়ন, ক্রিম কালারের শার্ট প্যান্ট ইন করে পরা স্মার্ট খাড়া হয়ে দাঁড়ানো মানুষটা। মাথার দীর্ঘ চুল পিছনে চুঁড়ো করে বাঁধা, লম্বা দাঁড়ি, গোল রিমের চশমা। আমার বাসায় এসেছেন আমার করা দুইটা খ্যাপের কাজ ডকুমেন্টরি পেনড্রাইভে নিয়ে যেতে। উনি এগুলোর সাবটাইটেল করে দেবেন। নিজের কাজ থেকে ফেরার পথে নিয়ে যাচ্ছেন। চা খেতে খেতে আমার আর সেজানের সাথে কতো যে গল্প করলেন। সবকিছু ছাপিয়ে আমার শুধু সেদিনের সেই কর্মব্যস্ত আনিস ভাইয়ের অবয়বটা মনে পড়ে। এর পরপরই তিনি বিছানায় পড়লেন। সেদিন এক রাতের ভিতরে কতো দ্রুত তিনি দু্‌ইটা ডকুমেন্টরির সাবটাইটেল করে দিলেন, অকল্পনীয় ব্যাপার। পরে অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়েই তিনি করেছেন আমার ডকুমেন্টরি টু ডিফাইন এ ব্যাড গার্লের সাবটাইটেল। আমার অনেকগুলো কাজের সাথে আনিস ভাই মিশে আছে, জড়িয়ে আছে।


আমার বাসায় আড্ডায় সকলের মাঝে বসে একের পর এক গান গাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে, আমার মেয়ের জন্য তার বুকভরা ভালোবাসার স্মৃতি মনে পড়ে, আমার জন্য নিয়ে আসা পতাকা আর বইয়ের কথা মনে পড়ে। এতো এতো সব মনে পড়া- আমি ভুলি কী করে! ক্যামেরা কিনবো। বললাম তাকে, বলে দাও কী ক্যামেরা কিনবো! দিনরাত গবেষণা করে বললো, কিনলে নাইকন ডি এইট টেন। আর কিচ্ছু না। আমি কিনলাম। সব কিনলাম। তবু আমাকে তার ট্রাইপডটা জোর করে দিলেন। এখনও সেটা আমার কাছে আছে। থাকবে সারাজীবন।


কতো কতো সমস্যায় পড়ে আনিস ভাইকে জানিয়ে পরামর্শ চেয়েছি। সব সমস্যার সুন্দর সমাধান দিতেন। অবাক লাগতো, এতো কিছু কীভাবে জানেন তিনি। এতো কীভাবে মনে রাখেন। সব কিছু সম্পর্কেই কিছু না কিছু জানতেন তিনি। যা জানতেন, সেটাও বেশ ভালোভাবেই জানতেন, আধাখ্যাচরা কোন বিষয়ের মধ্যে থাকতেন না। আমি বলতাম, তুমি আমার এনসাইক্লোপিডিয়া।
আমার সব কাজে অক্লান্ত সমর্থন পেয়েছি তার কাছে। বলতেন, তুই আসলে কী মুনমুন? তুই কি ফিল্ম মেকার, নাকি কবি?
আমার কবিতা ভালোবাসতেন। আমার লেখা এগারোটা গল্পের প্রুফ দেখেছেন অসুস্থ অবস্থায়। জোর করে। যাই লিখতাম পড়ে মতামত জানাতেন।

এতো এতো কথা। লিখে তো শেষ হবে না। শেষ যেদিন দেখা হলো, সেদিনও অক্সিজেন মাস্ক মুখে নিয়েই গেয়ে উঠলেন গান। আমার হাতটা ধরে। ভাবী বলতো, আমার মুনমুনকে ফিরোজের নারী সংস্করণ মনে হয়। আমরা হাসতাম। হয়তো আমাদের মধ্যে আসলেই খুব মিল ছিল। কে জানে! আনিস ভাই বলতো, তোর সাথে আরো দশটা বছর আগে দেখা হলে একসাথে অনেক কাজ করা যেতো।
হলো না।
অফুরন্ত প্রাণশক্তি ছিল। অসাধারণ রসবোধ ছিল। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ছিল। অসাধারণ গানের গলা ছিল। অসাধারণ একটা হৃদয় ছিল।

আনিস ভাই….আমি তোমাকে ভালোবাসতাম। আজো ভালোবাসি। সবসময় ভালোবাসি। পৃথিবীতে একদিন ক্যান্সার বলে কোনো শব্দ থাকবে না। কিংবা ক্যান্সারকে তুড়িতে উড়িয়ে দেবে চিকিৎসা বিজ্ঞান। সেই দিনটাতে আমিও হয়তো থাকবো না। কিন্তু আজ নিজেকে খুব অভাগা মনে হচ্ছে। ক্যান্সার নামের ভীষণ শত্রু আমার জীবনে আবার ফিরিয়ে এনেছে বিষাদ। এক বুক হাহাকার নিয়ে বসে আছি। ঈশ্বরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কতো কতো অভিযোগ করতে চাই। যাকেই ভালোবাসি, সেই কেন ছেড়ে যায়? কেন চলে যায়?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.