ডাঃ শিরীন সাবিহা তন্বী:
আলট্রাসনো টেবিলে উঠতে রুগীনির খুব কষ্ট হচ্ছিল। টেকনিশিয়ানকে বললাম হেল্প করতে। বেশ কষ্টে উঠলেন। বাঁ হাত নাড়াতে পারছিলেন না। এইটুকুতেই উনার ব্যথায় চোখ অশ্রুসজল।
ইউনিয়ন পরিষদের নারী কাউন্সিলর তিনি। সুন্দরী। মোটামুটি শিক্ষিত। মধ্যবয়সী এই নারী দুই কন্যা সন্তানের মা। বড়টি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে আর ছোটটি নবম শ্রেণিতে পড়ে। দুই মেয়েই একাডেমিক শিক্ষা ছাড়াই টুকটাক গান গায়। আবৃত্তি করে। মেয়েদের বাবা বিদ্যুৎ অফিসে লাইন ম্যান। ঘুষের কারণে টাকা-পয়সার দৌরাত্ম্য তার একটু বেশীই।
ভাবছেন সুখী পরিবার। কী রোগ নিয়ে এলো?
আমিও তাই ভেবেছিলাম।
ঘটনাটা শুনলাম।
মেয়েদের বাবা নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ের কাছে স্ক্রু ড্রাইভার চাইলেন। মেয়ে আনতে গেছে। অমনিই অশ্লীল ভাষায় বাবা মেয়েকে গালি দিতে শুরু করেছে, দিতে দেরি হলো বলে। মেয়ের মা প্রতিবাদ করতেই দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে মারতে শুরু করলো বাবা। মেয়েকে বাঁচাতে জাপটে ধরলেন মা। প্রবল শক্তিতে উপুর্যপরি ঘুষি দিতে থাকলেন বাবাটি। মা পাখির মতো দু হাত দিয়ে মেয়েকে রক্ষা করতে গিয়ে হাতে এমন বেশকিছু আঘাতের চিহ্ন, যা আমাকে স্তব্ধ করে দিল।
লক্ষণীয় ব্যাপার।
নিজ গ্রামে বহু সালিশে মধ্যমনি থাকা নারী কাউন্সিলর গ্রামের কাউকে সম্মানের ভয়ে এই ইভেন্টের কথা জানাতে পারেননি।
এই প্রৌঢ় পুরুষটিকেও তার মা, ভাই এবং বোনেরা বৌ এবং মেয়েদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয় সবসময় – পারিবারিক হিংসা এবং সহিংসতা।
এতোখানি অত্যাচার সয়েও অত্যাচারিতরা ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন। জালিম পুরুষটি ঘরে ভাত খাচ্ছেন না। মেয়েরা এবং তাদের মায়ের সাথে কথা বলছে না।
বিয়ে করে পুত্রের জনক হবে এমনও বলছে তার ভাই, বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগে যখন সবাই জানি,স ন্তান ছেলে বা মেয়ে হতে কে দায়ী!
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন নারী পারিবারিক জীবনে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অসম্মানিত জীবন যাপনে বাধ্য হয়।অধিকারহীন সেই জীবনে তার মতামত কখনোই মূল্যায়িত হয় না। তাই বাধ্যতা থেকে মুক্তি পেতে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর শিক্ষা এই বিষয়গুলিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে আসছিল সমাজ সচেতন মানুষরা। কিন্তু নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি যখন পুরুষকে লোভী করে তোলে, তখন এর সুফল কুফলতায় পূর্ণ হয়ে যায়। চাকরীজীবী বা ব্যবসায়ী নারীকে আহত করার সব থেকে বড় উপায় চরিত্রহীনতা বা পরকীয়ার অপবাদ দেয়া। ক্ষমতাধর নারীরা সারা পৃথিবীতে দাপুটে হলেও পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়, নিজের সম্মান টিকিয়ে রাখতে মার খেয়েও মুখ বন্ধ রাখে বলে।সমাজের মন্দ স্বভাব নারীর দিকে অঙ্গুলি প্রদর্শন। আর তাই সচেতন মানুষদের একতাবদ্ধ এবং সহমর্মী হয়ে উঠতে হবে অত্যাচারিত নারীদের সাহস জোগানোর জন্য।
একজন মানুষ কখনই জীবন যাপনের কোন মুহূর্তে কারো অত্যাচারের শিকার হতে বাধ্য না। আর এই বাধ্যতামুক্ত সমাজ আমাদেরকেই গড়ে তুলতে হবে।
এমন সমাজ চাই – নারী বান্ধব, শিশু বান্ধব, প্রতিবন্ধী বান্ধব সে সমাজটা আমাদেরকে এমন ক্ষমতাধর নারীকেও প্রৌঢ় বয়সে জীবনসঙ্গীর হাতে এমন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে আর দেখাবে না।
এই ঘটনাটি আমার মনে দুটি প্রশ্নের জন্ম দিল।
# নারী স্বাধীনতা,নারী মুক্তি শব্দগুলো কেবল অভিধান ভারী করছে। এর আক্ষরিক প্রয়োগ এদেশে আছে?
# যে সকল নাগরিক বিত্তশালী নারীরা পরকীয়া আর জরায়ুর স্বাধীনতা চায় – এই সকল নারীদের তারা চেনেন তো?
# নারীবিদ্বেষী পুরুষগণ, নারীবাদিতা কোনো ভুল টার্ম নয়। এইদেশে নারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুদীর্ঘ রাস্তাটা পঙ্কিল করবার অধিকার কি আপনাদের আছে?
তাই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সহমর্মিতার সমাজ গড়ি যেখানে কেউ অত্যাচারিত নয়। কেউ নয় অত্যাচারী। নারী-পুরুষ সবাই আমরা মানুষ।
কেবলই মানুষ!
ডাঃ শিরীন সাবিহা তন্বী
বরিশাল।